আমি সাইন্সের ছেলে হয়ে কেনো সামাজিক বিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান সহ আরো কত খটোমটো সাব্জেক্ট পড়তে হবে – এটা মানতেই পারতাম না! এখনো বুঝতে পারিনা আলু-ভুলু কতো কি যে পড়ালো স্কুলে যেগুলার লাইফে কোন দরকারই নাই। ইতিহাসের রাজা বাদশাহর পিটাপিটির সাল মুখস্হ করতে গিয়ে গলদঘর্ম অবস্হা!
মাকে বলি- আপনার অন্য ছেলেমেয়েরা তো ঢের পড়ে, একজন না হয় খেলার দিকে গেলো, কি হবে তাতে?
-তাইলে বল, একটা কোচ রেখে দিই, স্কুল-টিচার সব বাদ দিয়ে।
মুখ ফুটে আর মনের কথা বলা হয়নি, বাসায়ও আর কেউ বুঝে নেয়নি। *sigh*
আমার স্কুল ক্রিকেটের শুরুটা মনে হয় তারো আগে। ওই যে সেন্ট মেরীস স্কুলে যে বড়-বড় বাদাম পাওয়া যেতো ! খাওয়া যেতো না, কিন্তু বেশ ক্রিকেট খেলা হতো ছুটির পরে ওগুলোকে বল বানিয়ে, আর খাতাটাকে ব্যাট বানিয়ে। সেই যে শুরু…আর থামিনি গুরু! গভ। হাই স্কুলে গিয়ে তা হলো আরেক ধাপ পুরু। এই খেলা থামানোর জন্যই গভ. হাই থেকে ইস্পাহানীতে ঢুকানো হলে জোর করে।
ইস্পাহানীর স্কুল টিমে স্টার্টিংটা খুব ইন্টারেস্টিং ছিলো। এখানে আসার পর কতদিন ট্রায়ালে বসে ছিলাম, চান্সই দিতো না সিনিয়ররা। ২-৪টা বল ঠেকালেই ডাকাডাকি শুরু হয়ে যেতো- ‘আরে! নামসে আমার টেস্ট ব্যাটসম্যান!!’ অথচ আমি তখন গভ. হাই-এ কয়েকটা ফিফটি মেরে আসলাম, আবাহনীতে আন্ডার-19 এর ছেলেপিলের সাথে রেগুলার নেট করছি। এগুলো অবশ্য নতুন স্কুলে কেউ জানতোনা।স্রেফ অহমে লেগেছিলো। CGHS নির্মাণ ক্রিকেটে রাঘব বোয়াল, আর ইস্পাহানী বলতে গেলে চুনোপুঁটি।
সৌভিকদা তখন স্কুল ফাস্টেট। নেটে আগুন ঝরাচ্ছেন। এই বড় ভাইগুলার গাবুর-গুবুর শরীর দেখলেই ভয় লাগে। সবার পরে চান্স পেলাম নেটে।২-৪টা কভারে ড্রাইভ করলাম। মনে হলো পারবো।আবাহনীতে আমাদের পেসার এর চেয়ে ফাস্ট।
-আর দশ মিনিট!….নেটের বাইরে থেকে ডাক ক্যাপ্টেন সাইদ ভাইয়ের।
-ভাই!একদিনও ঠিকমতো খেলতে পারিনা, আজকে ১০ মিনিট বাড়িয়ে দেন, প্লীজ!
-OK.আর ৫ মিনিট।
লেগ স্টাম্প গার্ড নিয়ে স্ট্যান্স নিলাম। আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম ডাউন দ্য ট্র্যাক যাবো। সৌভিকদার ফুল লেংথ বল….সফট টাচ, ওভার দ্য টপ..বোলারের মাথার উপর দিয়ে। পরের দুইটা লং অফ আর মিড উইকেট দিয়ে ফুল পাওয়ার শট। ২টা বল ঠেকালাম। এরপর অতিপ্রীয় ফ্লিক শট। সৌভিকদার গুড লেংথটা হাফ ভলি হয়ে গেলো ফুটওয়ার্কের কাছে। অনেক ঘাম ঝরিয়ে শেখা এই শট, বিফলে যাওয়ার নয়। স্কুল বিল্ডিংয়ের ৪ তলায় গেলো একজন বল আনতে।
…..
স্কুল সেরা পেসার মাইর খাইসে। নিজে ফাস্টবল করেছি, তাই জানতাম খবর আছে এরপর। কনক্রীট পিচ, বল পড়ে স্কীড করছিলো খুব। হেলমেট, আর্ম-থাই-চেস্ট একটা গার্ডও ছিলোনা। একটু তো ভয় ছিলোই।
Yaaak- সৌভিকদার ফুল পেসের শর্টবল আর বিকট চিৎকার ফলো থ্রুতে। ব্যাকফুটে শাফল করে অফ থেকে টেনে এনে পুরা শক্তি নিয়ে পুল করলাম। নেটে বল আটকে গেলেও ওই নেট কেঁপে উঠতে দেখেই বুঝেছি টাইমিং এর এতটুকু হেরফর হয়নি।
….
এরপর আর কিছু খেয়াল নাই। খালি এটা মনে আছে ১০ মিনিটের নেট ২০ মিনিট পর থামলো। নেট শেষে সাইদ ভাই নিজে প্যাড খুলে দিলেন। হাতে পানির বোতল আর লাঞ্চ প্যাক ধরিয়ে দিয়ে বললেন- তুই ইন নেক্সট ম্যাচে। শাহাদাতের পর নামবি। শতদলে নাকি নাফিসের ছোটভাই(তামিম)খেলবে।ওইটারে ভালোমতো হেন্ডেল করতে হবে। নাসিরাবাদের লম্বা ছেলেটার অনেক পেস। লাস্ট ম্যাচে মুখ ফাটাইসে একজনের। রক্তারক্তি কান্ড! তুই আটকে দিস, লোয়ারে আমরা মারব, পারবিনে?
সবকটা দাঁত বের করে দিয়ে বললাম- আবার জিগস!
সেভেন-এইট থেকে দুজন চান্স পেলাম আমরা। বাকি সব সিনিয়র। গভ. হাই টিমে আমার দুইটা ফ্রেন্ড চান্স পেলো। সব ঠিকঠাক থাকলে সেমিফাইনালে দেখা হওয়ার কথা।
মেডিক্যাল ফিল্ডে ওই পেসারকে খেলার অভিজ্ঞতাটা অবশ্য খুব একটা সুখকর ছিলোনা। অফ স্ট্যাম্পের এক হাত বাইরে থেকে এয়ার সুইং গুলা পায়ের উপর এসে পড়ছিলো ইয়র্কার হয়ে। তাল সামলাতেই হিমসিম। নাসিরাবাদ এমনিতেই চ্যাম্পিয়ন। গেলো বছর আরো আফতাবকে নিয়ে গেলো গভ. হাই থেকে। ওই বছর তাই ওদেরকে আসলেই কেউ আটকানোর ছিলোনা।ওই ম্যাচটা ইস্পাহানী হেরেছিলো শাহাদাত ভাইয়ের অসাধারণ একটা ইনিংসের পরও।
ম্যাচের দিন সকালে আমাদের ওপেনারের স্ট্যাম্প উড়ে যেতে দেখেই বুঝেছি অনেক পেস।
-কি-রে পেস কেমন? ……… মাত্র প্যাড আপ করছি তখন।
ব্যাথায় মুখ বাঁকা করে প্রিন্স কোঁকাতে কোঁকাতে বললো – ‘দোস্ত! পুরা পশু! খালি দেখি বল ছাড়ে আর গায়ে এসে লাগে। সামনে পা নিলাম খালি, আর পিছনে তাকায় দেখি স্ট্যাম্প নাই ’
এত বড় মাঠে এমনিতেই আগে কখনো খেলিনি। আরো নামার আগে এভাবে বললে ভয় তো লাগেই। কত্ত আগের কথা। ৯৮-৯৯ এর দিকে। এখনো ওই ম্যাচের একটা ঘটনা মনে দাগ কেটে আছে আজীবনের জন্য।
নামতে যাবো এই সময় সৌভিকদার ডাক। -‘এই শোন! আগে নামছিস নাম। কিন্তু উইকেট থ্রো করবি তো তোর খবর আছে! দরকার হলে পড়ে মাইর খাবি। ব্যাক করবি তো তোর খবর আছে, পানিতে চুবায় মারব ’
সিনিয়র-জুনিয়র বাঁধা ডিঙ্গিয়ে সৌভিকদা এখনো অনেক কাছের মানুষগুলার একজন। ম্যা’রিকায় এখন। এতযুগ পরেও ওই কথাগুলো যেনো কানে লেগে আছে। এরপর যতবারই যে কোন কারনেই কোন কাজে হাল ছেড়ে দিতে গেছি, তখনি পিছন থেকে সৌভিকদার গলা যেনো কলার চেঁপে ধরে, তর্জনী তুলে বলে – ব্যাক করবি তো তোর খবর আছে!
ওপেনিং, ওয়ান ডাউনে ঘুরা ফিরা করেই স্কুল জীবন পার।
আমার লং টাইম ওপেনিং পার্টনার দুজন। ১. ক্লাস ফ্রেন্ড ইমতি ২. কাজিন শিহান।
… আমার চাইল্ডহুড ফ্রেন্ড … আমার গুল্টু সোনা ইমতি। (মোবাইলে এখনো নাম্বারটা ‘গুল্টু সোনা’ নামেই সেভ করা)। বিশাল শরীর নিয়ে দারুণ রানিং বিটুইন দ্য উইকেট…মামা আসো, আজকে কোপাই দিই!… বলে সাইন্স- কমার্স কতো ম্যাচ দুজনেই শেষ করে দিলাম। আর্টস রে তো গোনাতেও ধরিনি কোনদিন। মিস উ ফ্যাটম্যান। আর শিহাইন্যার তো ডিজিটাল স্বভাব। আজকে 1 তো কালকে 0, পরশু বড়জোর 10 । শিহাইন্যা মিনস শিহান আর কি! গীবত হবে না, সামনে পিছনে এই এক নামেই ডাকি!, তবে এই লেখা তুই এক্সিডেন্টলি পরে ফেললে..সরি।
পুরা স্কুল লাইফে একদিনও হেলমেট ইউজ করতে পারিনি। স্টেডিয়াম মার্কেটে ছোট হেলমেট পাওয়া যেতো না, বড় হেলমেটে খুব অস্বস্তি হতো। স্রেফ ব্যাগের মধ্যে পারসোনাল এবডোমেন গার্ডটা ভরেই প্র্যাকটিসে চলে যেতাম।
স্যারের বাসার নাম করে কত বিকেল স্কুল মাঠে কাটায় দিলাম। ধরা খেয়ে সমীরণ স্যারের বেধড়ক মার সবকটা ছেলেকে। পুরা ব্যাচের বিদ্রোহ! স্যারের এক মাসের বেতন মারা হল, কেনা হলো জার্সি। ক্লাস নাইনেই স্কুল চ্যাম্পিয়ন। পুরা স্কুলের সামনে এক হপ্তার হিরো। একটা ছেলেও কলার নামায়নি ওই এক হপ্তায়। আর আমি তো ক্লাব ক্রিকেট খেলে এসেছি তখন। ক্লাসে তো মহা নায়ক। জার্সিগুলা এত বছর পরেও সযতনে রাখা।
আমাদের আগের ব্যাচ ছিল আমাদের চির শত্রু। সাপে-নেউলে সম্পর্ক। ওদের স্কুল বিদায়ের শেষদিনে আমরা তখন নিউ-টেন। রাম-ধোলাই দেয়ার এমন চান্স কেউ ছাড়ে? টসে জিতে নিলাম ব্যাটিং। ইচ্ছেমত ব্যাটিং করলাম ইনিংস জুড়ে থার্টি প্লাস গরমে। এরপর ইনিংস ব্র্যাক। আর আমরা নাই!! ওদের আর ব্যাটিং দিই নাই। আহা!কি এক পৈশাচিক আনন্দ.. তা বলে বুঝানোর নয়! আনন্দ রে আনন্দ তুই কোথায় থাকিস বল!
পরে আমাদের ব্যাচের ছেলেপিলেকে পিটানোর জন্য MESকলেজের একগাদা গান্ডু-গুন্ডু ভাড়া করে আনলো সিনিয়র ব্যাচ। আমরাও কম যাই না-কি? চিটাগং কলেজ, মহসীন কলেজের বড় ভাইরা আছে না!! সে আরেক লম্বা কাহিনী!! আরেক খেলা! পরে আরেক দিন বলব নাহয়! *পুওর কিডস!*
দু –চার কান ঘুরে পরে ঘটনা কানে গেলো গার্জিয়ান আর টিচার মহলে। এরপর আর কি? উত্তম মধ্যম… ঘরে বাহিরে। ক্রিকেট নিষেধাজ্ঞা। গেল ব্যাচের রেজাল্টটা নাকি মনমতো হয়নি। এই ছুঁতোয় বন্ধ করে দেয়া হল নির্মাণে খেলা। সব কটা ছেলের মাথায় হাত। এত পরিশ্রম, এত প্র্যাকটিস সব মাঠে মারা! ধ্যাঁত!
চোখের সামনে দুচোখের বিষ তখন গার্জিয়ান আর টিচার সম্প্রদায়। মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেল। স্কুল ছেড়ে আসার এত বছর পরেও ওই মাঠে পা দিলে আলাদা একটা শিহরণ খেলে যায়। ম্যাট্রিক রেজাল্টের পরে সব কটাকে স্যার ম্যাডামরা হেসে কান মলে দিলেন- রেজাল্ট ভাল তো সাত খুন মাফ!
আনন্দ রে আনন্দ তুই কোথায় থাকিস বল!
=))
পিচ্চিকালের কথকতা! আমরা যাইতাম আবাহনী মাঠে আর বেড়িবাঁধ এ খেলতে। সেখানেও নানান পাড়া ঘটিত টেনশান কাজ করত!
(সাইন্স এর বদলে সায়েন্স লেখা ভাল মনে হয়)
ওস্তাদের ব্লগে সালাম না দিয়ে ঢুকলি……. কে রে তুই!!
আবার বানান শিখাতে এসেছিস!! সাহস কত বড়!!!
আসিস একদিন প্র্যাকটিসে…………………
…………..তোকে…………
……………………
……
…
..
..
.
…
পরটা ভাজি খাওয়াবো 🙂
এত ভাল লাগলো!
ঘটনা গুলো নস্টালজিক আর লেখার ভংগীটা চমৎকার। এত সেলিব্রেটির পেছনের কাহিনীও জানা হলো।
ভাই আপনার নাম কি?
ভালো থাকবেন- :love: :love:
সুন্দর করে লিখেছেন। খেলাধুলা মাথার ওপর দিয়ে যায় (এই কথাটা এই ব্লগে যে কতবার বললাম এই নিয়ে!) তারপরও পড়লাম। ভাল লাগলো। 😀
খেলাধুলার গল্প পড়তে বেশ…………
সায়েন্সের স্টুডেন্ট হলেও অন্য বিষয় গুলোই ভালো লাগতো বেশি, লিটারেচার পড়তে চেয়েছিলাম, কিন্তু সম্ভব হয়নি……
পিচ্চিকালের খেলাধূলা মানেই মজা আর মজা।
এই পোস্টটাও মজা নিয়েই পড়লাম। 😀