নিউইয়র্কে সাবওয়ের এক লোকাল ট্রেনে বসে ঢুলছেন নাম না জানা ভদ্রলোক, অফিস ফেরত, মধ্যবয়সী। চেহারায় দেশী ছাপ স্পষ্ট। আমেরিকায় কত প্রজন্ম চলছে কে জানে। ন’টা পাঁচটা অফিস করে পৌনে এক ঘন্টা জার্নি করে পড়ন্ত বিকেলে বাড়ি ফিরছেন, সঙ্গী এক রাশ ক্লান্তি।
অফিস শেষ হলেই মুহিব সাহেবের মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়। সেই ত ঘরে ফেরা, স্ত্রীর সাথে দূরত্ব, ছেলে মেয়েদের বেয়াদবি দেখেও না দেখার ভান করা। ধূউউউর.. কীসের জন্য এত কিছু করা? সারাদিন গাধার খাটনি খেটে ফিরি, কারো কোন খেয়াল আছে, মানুষটা বেঁচে আছে না মরে গেছে? খেয়াল হবে মাসের শেষে টাকা দিতে না পারলে। হালের গরুর সাথে আমার আর পার্থক্য কী?
ল্যাব থেকে আজকে তাড়াতাড়ি বের হচ্ছে লুসিয়া। তার প্রিয় কুকুর স্প্রকেট কে নিয়ে বেড়াতে বের হবে। সামারটা স্প্রকেট এর খুব প্রিয়। সপ্তাহে দু’দিন অন্তত ওকে নিয়ে বেড়াতে না গেলে ভীষণ মাইন্ড করে। লুসিয়া ঘরে ফিরলেই ভৌ ভৌ, হুফ হুফ করে লাফালাফি করে আর রাখেনা। লুসিয়াও প্রাণ দিয়ে ভালবাসে স্প্রকেট কে।
ঘরে ফেরার সাথে কীভাবে কীভাবে যেন আমাদের খুব গভীরে গেড়ে থাকা একটা আকাঙ্ক্ষা জড়িয়ে আছে। আমরা কল্পনা করতে ভালবাসি এই যে আমি বাইরে – ঘরে গেলেই একটা বিরাট কিছু ঘটে যাবে। একটু চিন্তা করে দেখুন ত, কড়া জ্যামে আটকা পড়ে ঘরে ফিরতে দেরি হলে কেমন অস্থির লাগতে থাকে! তা কি শুধু বিশ্রাম পাওয়ার জন্যই? কাজের জায়গা থেকে বাসা বেশ দূরে হলে প্রতি সেকেন্ডে বাসার জন্য টান টা কেমন বাড়তে থাকে? কখনও কি ভাল করে চিন্তা করে দেখেছেন এই টানটার উৎস কোথায়? এর পরের বার বাড়ি ফেরার সময় একটা একটা করে জিনিস ধরে চিন্তা করে দেখেন, আলাদা আলাদা করে সবগুলোই মনে হবে এটার জন্যই ত যাই।
যেমন খাবার। ক্ষুধা লাগলে ঘরের টানে ফিরে আসা, কিন্তু খাবার টা এমন কী? বাইরে খেলে কী হয়? নিজের বিছানা। তাহলে গ্র্যাড স্টুডেন্টদের ঘরে ফিরতে এত অনীহা কেন? ঘরের মানুষ – তাহলে মুহিব সাহেবের ঘর নরক কেন? আর লুসিয়ার ঘরে কেউ না থেকেও এত আনন্দ কেন?
আমার মনে হয় ঘরে কেউ একজন অপেক্ষায় আছে – এই অনুভূতি টা ঘরের জন্য টান এত বাড়িয়ে দেয়। এই এক থিমের উপর কত গল্প উপন্যাস পড়ে ফেললাম। আপনারাও একটু চিন্তা করে দেখেন, ঘরে ঢুকে সবাইকে যার যার মত কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখলে কেমন কষ্ট লাগে, অভিমান লাগে। তার বদলে কুকুরটাও ঝাঁপিয়ে পড়লে মনে হয় আমার এই ফেরার প্রয়োজন ছিল, আমি না আসলে একটা শূন্যতা থেকেই যেত।
ঘরটাকে ঘরের মত রাখার জন্য এই ছোট্ট বিষয়টা খেয়াল রাখা খুব গুরূত্বপূর্ণ। ছেলেমেয়েরা বাবা মায়ের বাসায় ফেরার জন্য অপেক্ষায় থাকে, বাবা মায়ের খুবই খুবই উচিৎ ফেরার পরপরই ছেলেমেয়ের সাথে গল্প করা, সারাদিন কী করেছ, কেমন গিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। স্ত্রী স্বামীর অপেক্ষায় থাকে, তার ইচ্ছে করে ঘরের খুঁটিনাটি বিষয়গুলি নিয়ে স্বামীর সাথে কথা বলতে, কারণ সে তার কাজের ক্ষণগুলোতে স্বামীর অভাব বোধ করেছে, সেটা প্রকাশ করার মত ভাষা তার নেই, তাই ‘এইটা হয়েছে ওইটা হয়েছে’ এসব বলে বলে সে চায় স্বামীকে তার দিনের সাথে রিলেট করতে, যেন স্বামী তার কষ্টগুলোর ভাগীদার হতে পারে। স্বামী স্ত্রীর কাছে তার অভাববোধটুকু দেখার অপেক্ষায় থাকে। তার চিন্তায় থাকে, এতটা সময় আমি ছিলাম না, আমাকে মিস করলে এখন নিশ্চয়ই তার প্রতিফলন হবে ভালবাসা, যত্ন দিয়ে!
একজন বাবার বা স্বামীর ঘরে ফেরা নিয়ে যে তাড়া বা উৎসাহ থাকে, ফেরার পর তার প্রতিফলন হওয়া উচিৎ কে কেমন ছিল তার খোঁজখবর নিয়ে, খুবই হালকা কথাবার্তা বলে, just to show that I really thought about you when I was away. স্ত্রী যদি বাইরে কাজ করে তারও একই ভাবে বাচ্চাদের আর স্বামীর সারাদিনের খোঁজ নেয়া উচিৎ। পাশাপাশি স্বামী বা স্ত্রী যেন ঘরে ফিরে অনুভব করে অন্যরা তার আসার অপেক্ষায় ছিল, সে ব্যাপারটা খুব যত্ন করে মেইনটেইন করা উচিৎ। এটা করা যায় আসার পর অন্তত পাঁচ দশ মিনিট তার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে। অফিস শেষে বাড়ি ফিরে পরিবারের মানুষগুলোকে বিনোদন এ ডুবে থাকতে দেখলে কী যে খারাপ লাগে সেটা বলে বোঝানো যায় না। মনে হয় টেলিভিশনের কাছে আমি হেরে গেলাম। আমার চেয়ে টেলিভিশনের/কম্পিউটারের আকর্ষণ বেশি। তাই বলে পরিবারের সদস্যরা কাজে ব্যস্ত থাকলেই যে খুশি তে মন ভরে যাবে তাও না। তখন মনে হয়, সবাই যার যার মত ব্যস্ত। আমি আসলেই কী আর না আসলেই কী। বেশি না, পাঁচ দশ মিনিট। তারপর ঐ মানুষটা নিজের মত ব্যস্ত হয়ে গেলে আর কিছু লাগবেনা।
আমাদের ডিপার্টমেন্টের গ্র্যাড স্টুডেন্ট জেফারি কে অনেক ধন্যবাদ, ওর একটা কথাই আমার জন্য eye opener ছিল। ওর সারাদিন ল্যাব এ পড়ে থাকা দেখে রনি দরদ দেখিয়ে বলছিল, তুমি ঘরে যাওনা কেন? সে দুষ্টুমি হাসি হেসে বলল, আমার তোমার মত ঘরে বউ নেই যে! এই দেশে বেড়ে ওঠা একটা ছেলের জন্য বউয়ের অল্টারনেটিভ খুঁজে পাওয়া ত এমন কঠিন না, ওর আর আমাদের ঘরের মধ্যে কমফোর্ট জনিত বেশি পার্থক্যও হবেনা। বোধহয় পার্থক্য এখানেই, প্রতীক্ষায়।
– নূসরাত
অনেক সুন্দর লেখা।
থিমটাই অসাধারন-
আমার মনে হয় ঘরে কেউ একজন অপেক্ষায় আছে – এই অনুভূতি টা ঘরের জন্য টান এত বাড়িয়ে দেয়। এই এক থিমের উপর কত গল্প উপন্যাস পড়ে ফেললাম। আপনারাও একটু চিন্তা করে দেখেন, ঘরে ঢুকে সবাইকে যার যার মত কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখলে কেমন কষ্ট লাগে, অভিমান লাগে। তার বদলে কুকুরটাও ঝাঁপিয়ে পড়লে মনে হয় আমার এই ফেরার প্রয়োজন ছিল, আমি না আসলে একটা শূন্যতা থেকেই যেত।
তবে সবচেয়ে ভাল ব্যাপার হলো আপনি ফ্যাক্ট দেখিয়েই থেমে না গিয়ে সলভ কিভাবে করতে হবে সেই পথও বাতলে দিয়েছেন। পরামর্শ গুলো অবশ্যই কাজে দিবে আশা করি।
অনেক ধন্যবাদ। সরবে কিছু পুরনো লেখা দিচ্ছি, একাউন্ট এখনো খুলতে পারিনি, সমস্যা হচ্ছে। আপনি সরবে আমার প্রথম মন্তব্যদাতা। অভিনন্দন।
এই লেখাটা আমি অনেক আগেই পড়েছিলাম। এত বেশি সুন্দর, আর এত এত সত্যি কথা – নতুন করে আর কী বলবো!
এইসব আপাতদৃষ্টিতে ছোট ছোট ব্যাপারগুলো কত বড় কিছু বদলে ফেলতে পারে, ভাবলে অবাক লাগে।
:welcome:
ধন্যবাদ। আমার লেখা আমার ফেসবুকের বন্ধুরা ছাড়া আর কেউ পড়েছে শুনলে বোকার মত অবাক লাগে! 🙂
আমি আছি তো আপনার ফেসবুকে! আপনার সব লেখাই পড়ি। 🙂
দারুণ লাগল লেখাটি।
নতুন লেখা প্রকাশের চেষ্টা করলে ভালো হয়।
সরব এ স্বাগতম।
নির্মলেন্দু গুণ এর এই কবিতাটা দিতে চেয়েছিলাম কাল। ভুলে গিয়েছিলাম
বেশ প্রিয়!
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে , আমি চাই
কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,
শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য ।
বাইরে থেকে দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত ।
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ আমাকে খেতে দিক । আমি হাতপাখা নিয়ে
কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না,
আমি জানি, এই ইলেকট্রিকের যুগ
নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী -সেবার দায় থেকে ।
আমি চাই কেউ একজন জিজ্ঞেস করুক :
আমার জল লাগবে কি না, নুন লাগবে কি না,
পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরও একটা
তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কি না ।
এঁটো বাসন, গেঞ্জি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি ।
আমি বলছি না ভলোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরোজা
খুলে দিক । কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক ।
কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে
জিজ্ঞেস করুক : ‘তোমার চোখ এতো লাল কেন ?’
চমৎকার একটা লেখা। ‘প্রতীক্ষা’ জিনিসটা আছে বলেই জীবন এতো সুন্দর!
লেখাটা আগে পড়েছি বলে মনে হচ্ছে।
সরব এ স্বাগতম 😀
খুব সুন্দর একটা লেখা!
এই সুক্ষ জিনিস গুলোই জীবন কে কতো অপূর্ব করে দেয়………।
চমৎকার লেখা!