মানুষ হিসাবে আমি কেমন? মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না…
এখন আবার সন্ধ্যা হচ্ছে, আকাশ মেঘলা আমার জ্বর আর এর মধ্যেও লেবু গাছের লেবুগুলি জ্বল জ্বল করছে। আব্বার কাশির শব্দ ভেসে আসছে বসার ঘর থেকে। আম্মা ইলিশ মাছ ভাজছে রান্নাঘরে, টের পাই এখান থেকেও। আশিক আর কড়ি এসেছে। ইফা অফিসে। সানিয়ার কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না আপাতত। আমার দিনগুলি সরল, ছাপোষা…চাকার মতো গড়ায় নাকি পানির মতন? যেমনই হোক, শেষ হয়। এক একটা নতুন সকাল, দুপুর, বিকাল, সন্ধ্যা অথবা রাত আজকাল হাজির হয় পুরানো মলাটের ভেতর। মনে হয় ঠিক এরকম আগে কোথায় দেখেছি? এক শীতের দুপুর মনে আনে বহু বছর আগের কোন দুপুরের কথা। মনে হয় একই ঘটনা আবার আবার আবার আবার…ঘটে চলেছে। মার্ক স্ট্র্যান্ডের কবিতা মনে পড়ছে –
“once, as my thought was being drawn through daylight into
the bronze corridores of dusk and thence into the promise of
dark, i heard out there the strained voice of the hourglass
calling for someone to turn it over and show that the future is just
an illusion, that what lay ahead was only the past again and
again. i was too young for such an idea, so it came back years
later as if to prove its own point.”
আমার জীবনে পরিবর্তণগুলি হয়েছে আলগোছে, আমি বুঝতেই পারিনি, তার মধ্যেই ঘটে গেছে কখন! খুব কিছু ওলট পালট হয়ে দুনিয়া লন্ড ভন্ড হয়ে যায় নাই আমার কোনদিন।
নিউজিল্যান্ডে একবার একটা পার্কে বেড়াতে গেছিলাম। ঝিরঝির বৃষ্টি ছিল সেইদিন। আমি দেখলাম একদল হাঁস কই থেকে প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে হেলতে দুলতে চলেছে দল বেঁধে। একটা হাঁস পিছিয়ে পড়ছিল। তার একটা পা থ্যাঁতলানো, খুব খুঁড়িয়ে পা টেনে টেনে তবুও সে প্রাণপনে চলছিল। খুব মনটা মুচড়ে উঠেছিল তার জন্য। আমার এক বন্ধু খুব হাসছিল আমাকে নিয়ে, হাঁসের দুঃখে কাঁদছি বলে। ওই হাঁসটাকে বাসায় ধরে নিয়ে গিয়ে কেটে কুটে কি রকম ঝাল তরকারী রান্না করা যাবে এই সব বলে বলে আরো বেশি করে ক্ষেপাচ্ছিল আমাকে। সেই মেঘলা বিকালে বৃষ্টির গন্ধের সাথে মিলেমিশে হাঁসটার খোঁড়াতে খোঁড়াতে বার বার পিছিয়ে পরা আমাকে বিষন্নতর করে তুলছিল। এরকম শুধু একবার না, কতবার কতভাবে হয়েছে…কখনো বিড়াল, কখনো কুকুর, কখনো পাখি।
শুধু তাই না, আমি বই পড়ে কাঁদি, সিনেমা দেখে কাঁদি, গান শুনেও! একবার ট্রেনে আসতে আসতে ‘পূর্ব পশ্চিম’ পড়ে কেঁদে কেটে অস্থির হলাম। এক সহযাত্রী তাঁর রুমাল দিয়ে দিলেন আমাকে। ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ পড়তে পড়তে এরকম আকুল হয়ে কাঁদছিলাম যে আম্মা ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিল। বন্ধুরা মজা করে কত নাম দিল আমার – পানির ট্যাংকি, শাবানা, ওয়াটার গান! আমার নাকি অনেক মায়া, বড়রা বলে। আমারো ভালো লাগে শুনতে।
অথচ আমার চারপাশে, আমাকে ঘিরে ঘটতে থাকা ঘটনা স্পর্শ করে না। ছোটবেলায় ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারসে থাকতাম। প্রায়ই ছাত্র-পুলিশ মারামারি হতো, গুলির শব্দ শুনতে পেতাম বাসা থেকে। আত্মীয় বন্ধুরা আমাদের বাসায় আসতে ভয় পেত, বিপজ্জনক এলাকা নাকি! আমাদের কাছে অন্যরকম কিছু লাগতো না, বরং কেমন গর্ব গর্ব একটা ভাব হতো, ‘জীবন মৃত্যু, পায়ের ভৃত্য’ টাইপ। ‘জান হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হতে হয়’, ‘দেশ টা আর থাকার যোগ্য থাকলো না’, ‘খবর পড়ে কি করবা? হয় খুন, নাইলে ধর্ষন, নাইলে ছিনতাই’। বাক্যগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসের মতন ই পরিচিত হয়ে গেছিল। আমরা জেনেছি এরকমই হয়, এরকমই চলে। তবুও মটরশুঁটির মধ্যে মটর দানার মতন গুটিশুটি বেঁচে নিতে হয় যেটুকু পারা যায়।
আমি রাজনীতি অসচেতন মানুষ। মাঝে মাঝে ভাবি যে এই পৃথিবীতে এই সময়ে থাকছি অথচ ঠিক মতন ঠাহরই করতে পারছি না কি ঘটছে চারপাশে। তখন কিছুদিন খুব খবর রাখতে চেষ্টা করি, কিন্তু এত এত খবরের তোড়ে টালমাটাল হতে হতে হাল ছেড়ে দেই। নিজের কাছে স্বীকার করে নেই যে এতসব বড় বড় বিষয় নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার জন্য আমার জন্ম হয় নাই, আমার জীবনটা এই ছোটখাট গন্ডীর ছোটখাট সুখ দুঃখেই কাটবে। যদিও ভাসা ভাসা জানি ফিলিস্তিনিদের কথা যারা কয়েক পুরুষ ধরে রিফিউজি ক্যাম্পে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে, অথবা গুয়ান্তানামো-বের বন্দীদের অসহনীয় আর অনিশ্চিত জীবনের কথা, আমি খুব বেশি বিচলিত হই না। আমি তবুও খুশি মনে আমার নতুন বুক শেলফ সাজাতে পারি, কোন রঙের কার্পেটে আমার ঘরটা একটু লাইভলি দেখাবে ভাবতে ভাবতে সময় পার করতে পারি।
কোন না কোন এনজিও টিভির পর্দায় বিজ্ঞাপিত করে অপুষ্ট হাড় জিরজির করা শিশু, মুখের চারপাশে মাছি, ভারি ভারি পানির বালতি মাথায় করে বয়ে চলেছে শিশু শ্রমিক। আমি চ্যানেল বদলাই। আমরা বলাবলি করি ‘হায়রে ক্যাপিটালিজম! গরীবীও পণ্য এখানে!’ এনজিও র সুযোগ সন্ধানী কার্যকলাপ ও ক্ষেত্র বিশেষের অসততা গ্লানিমুক্ত করে আমাকে… আমার মানবতাবোধকে। সারা দুনিয়ায় এত অভাব, এত বিশৃংখল অবস্থা, এত বেশি দুর্নীতি কয়জনের অভাব মিটাবো? তাই চেষ্টা করি না, তার চেয়ে অনেক সহজ একটা নতুন বই কেনা, একটা সিনেমা দেখা, কোন ক্যাফেতে বসে আড্ডা দেয়া।
খবরের কাগজ পড়তে আমার ভালো লাগে না। রাজনৈতিক ঘটনা পরম্পরা মনে রাখতে পারি না। সেই তো কেউ খুন হয়, কেউ গুম হয়, কেউ মার খায়, কারো অ্যাক্সিডেন্ট হয়, শেয়ার বাজার ধ্বসে যায় – আরো কিছু মানুষ সর্বশান্ত হয়, পাঁচ বছরের শিশু ঘুম ভেঙে উঠে এসে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে বাবা মায়ের রক্তাক্ত লাশ, তার বিস্মিত, ভয়ার্ত, বিষন্ন দৃষ্টি ল্যাপটপের মনিটর ফুঁড়ে বিঁধতে থাকে আমাকে। যোগ হয় আরেকটা দীর্ঘশ্বাস, বাতাস আরেকটু ভারী হয়ে ওঠে। কি হয় তাতে? সংবাদপত্রের বিক্রী বাড়ে, ঝড় ওঠে ফেইসবুকে, ব্লগে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের নিজস্ব রঙে ছোপানো ভিন্ন ভিন্ন গল্প শোনায় – কেউ ব্যবহার করে ধর্ম আর কেউ ইতিহাস।
জন্মের পর থেকেই দেখি অবিচার, অনাচার, অত্যাচার, অসততা, বিশ্বাসঘাতকতা। এতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। সমাজ এরকমই, ভাবতে শিখি। তাই নিউইয়র্কের কোন গরীব ট্যাক্সিওয়ালা অথবা ঢাকার কোন রিকশাওয়ালা যখন তার যাত্রীর ফেলে যাওয়া হাজার হাজার কিংবা লাখ লাখ টাকায় ভর্তি ব্যাগটা তাকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য খুঁজে বার করে, তাকে মনে হয় রূপকথা! একজন সৎ রাজনীতিবীদ অথবা এমন একটা সংবাদপত্র যা কোন না কোন রাজনৈতিক দলের কাছে বিক্রী হয়ে যায় নাই, মনে হয় অলীক কল্পনা।
মানবতা থাকে প্রেক্ষাগৃহে আর পরীক্ষার খাতায় ভাবসম্প্রসারণে –
‘শোনো হে মানুষ ভাই,
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’
অথবা
‘গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই
নহে কিছু মহিয়ান…’
অবিশ্বাস করতে আর ভয় পেতে শিখেছি শৈশব থেকে –
‘অচেনা কেউ কিছু খেতে দিলে খাবা না কিন্তু!’
অথবা
‘একা একা কোথাও যাবা না, ছেলেধরা নিয়ে যাবে!’
কে না শুনেছি এইসব? যত বড় হই, বাড়তে থাকে এই অবিশ্বাসের বিস্তার। আমরাও শেষমেষ একই কথা বলি বাচ্চাদের।
innocent until proven guilty
– ওই আইনের বইয়েই থেকে যাচ্ছে। আমাদের সন্দেহগুলিও অমূলক না। মানুষ ঠেকেই তো শেখে। মানুষের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ঘটে যাচ্ছে কতরকম হত্যাকান্ড – সংবাদপত্র সাক্ষী। তারপরও ভাবি কোন ভীষণ দুর্দিনে আশ্রয়হীন, মৃত্যুভয়ে ভীত কেউ যদি আমার দরোজায় কড়া নাড়ে – আমার সন্দেহ বা ভয় কি এতটাই স্বার্থপর করে তুলবে আমাকে যে তার মুখের উপর দরোজা বন্ধ করে দেব? আমি জানি না…
* * * * *
কিছুতেই দূরে সরতে পারছি না ছবিটা থেকে।
গত কয়েকদিন ধরে কত তর্ক বিতর্ক চোখে পড়ছে। কেউ ফেইসবুক স্টেটাসে ‘মুসলিম ভাই’ দের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে বলছেন কেউ বলছেন রোহিঙ্গারা জামাতের ভোট ব্যাংক। শেষ পর্যন্ত তাই হচ্ছে যা হয়ে এসেছে এযাবত – গালাগালি, গলাবাজি আর নিজের নিজের রাজনৈতিক সানগ্লাসের বাইরে আর কোনকিছুর অস্তিত্ব অস্বীকার করতে থাকা। এই আশ্রয়হীন মানুষগুলির ক্লান্ত করুণ ভাসমানতা দুলতেই থাকছে চোখের সামনে…
আম্মা ঘরে ঢুকলো খেতে ডাকার জন্য। বললো – কি দেখিস?
আমি ছবি টা দেখালাম। বললাম – এদেরকে বাংলাদেশ সরকার ঢুকতে দিচ্ছে না।
আম্মার উত্তর – কি ভাবে দিবে? আমাদেরই তো থাকার জায়গা নাই।
খুব রাগ হলো আম্মার উপরে। বাচ্চা মেয়েটার ছবি দেখিয়ে বললাম – এই মেয়েটা কড়ি হলে তুমি কি বলতা?
আম্মা কিছু বল্লো না। আমি বললাম – তুমি আমার ঘর থেকে যাও!
আম্মার উপর রাগ করা সহজ। দেখলাম বাইরে অন্ধকার, হিম জমে উঠছে জানালায়।
* * * * *
Human Rights Petition: Open Borders to Rohingya Refugees in Distress
https://www.change.org/petitions/open-borders-to-rohingya-refugees-in-distress
আমি পড়শুদিন আমার এক বন্ধুর সাথে অনেক ঝগড়া করে শেষে রেগে চলে আসতে বাধ্য হয়েছি।
তারও এক যুক্তি- আমাদের দেশে থাকার জায়গা নেই!
মানুষের জীবনের অজুহাত হিসেবে খুবই ঠুনকো- এরা সে কথাটাই বোঝে না!
ঝগড়া করে তো কিছু হয় না আসলে, নিজের নিজের যুক্তি তো থাকে সবার…
সব কিছু এড়িয়ে যেতে শিখছি দিনকে দিন। তবুও কিছু জিনিস খুব আহত করে, এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় বুকের ভিতরটা।
সত্যই, এড়াতে এড়াতেও অনেক কিছু থেকে চোখ ফেরাতে পারি না…
অনেক সুন্দর লিখেছেন। অনেক কিছুই মিলে গেল।
পড়েছেন বলে ধন্যবাদ 🙂
এই বিষয়ে সবচেয়ে খারাপ যেটি লেগেছে বিভিন্ন ব্যক্তির উগ্রতা। পর্যাপ্ত জ্ঞান না রেখে, না পড়ে, না যাচাই করে যাচ্ছেতাই বলছিলো/ লিখছিল
জাতীয়তাবাদ ও ধর্মান্ধতার মত উগ্রতা তৈরি করে। হয়ত তার চেয়েও ভয়াবহ কিছু তৈরি করে!
একদম ঠিক বলেছেন। তীব্র জাতীয়তাবাদ নিজেই একটা ধর্ম।
‘গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই
নহে কিছু মহিয়ান…’
মানতে তো পারি না সব সময়…
আপু আপনার লেখা খুবই অন্যরকম,কেমন আপন আপন লাগে আমার…লেখা চলুক :huzur:
এই কমেন্ট টাও তো অনেক আপন আপন। 🙂 কালবলার ‘মাধবীলতা’ আমার খুব প্রিয় চরিত্র। অনেক ভালো থাকবেন।
লুনা আপি অনেক ধন্যবাদ। :beshikhushi:
“মাধবীলতা” আমারও অনেক প্রিয়। 🙂
অনেক বড় বড় থেকে শুরু করে অনেক ছোট ছোট ঘটনায়, দুঃখ পেয়ে যাই।
করার কিছু থাকে না। আপনার এসব লেখা পড়ে সান্ত্বনা খুঁজি।
ভাল থাক মানুষেরা।
আপনিও ভাল থাকেন। 🙂
মানবতা থাকে প্রেক্ষাগৃহে আর পরীক্ষার খাতায় ভাবসম্প্রসারণে……….
নিস্পৃহ হয়ে গেছি আমরা…..
অনেক ভালো লেগেছে লেখাটা………
কিছু উত্তর জেনেও না জানার ভান করে থাকতে হয় আজকাল।
বড় কষ্টের সে কাজ, বড় যন্ত্রণার।