(এখানে গুছানো কথার বড়ই অভাব। আবেগে মানুষ অগোছালো হয়, আবেগে মানুষ ইতর হয়, আবেগে মানুষ মহান হয়।)
নমঃ পিতাস্বর্গঃ পিতা ধর্মঃ পিতাহিপরমংতপঃ
পিতৃ প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতা
নমঃ পিতৃ চরনেভ্য নমঃ
পুত্র সন্তানের জন্মের কথা শুনে লোকটি ছুটে এলো। পরম আনন্দে পানি চলে আসা চোখে ঝাপসা ঝাপসা দৃশ্যে চিৎকার রত ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। পরক্ষনেই, বাবা’র বিশাল বক্ষে আশ্রয় করে নিলো শিশুটি, সে বক্ষ সকল বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করবার জন্য বিশাল এক ঢাল, বাবা’র বক্ষে থাকা শিশুটির কোনও ভয় নেই, এই নিশ্চয়তায় সে কান্না থামিয়ে ছোটো ছোটো চোখে ইতি উতি করে এদিক ওদিক তাকালো।
সদ্য দ্বিতীয় সন্তানের জনক হওয়া পিতাটির মাথায় হঠাৎ করেই একটা ব্যাপার ঠোকর দেয়া শুরু করলো, রিলিজ নেয়ার টাকা তার কাছে আছে তো ?
সেদিনের সেই মেকু বাচ্চাটি আমি, আর লোকটি আমার বাবা। একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে যখন হই আমি, আব্বুর তখন বিশাল টানাটানি চলে। যদ্দুর জানি, ধার-দেনা করে, বিশাল রকম এর দৌড়-ঝাপ করে নির্দিষ্ট দিনেরও তিনদিন পরে আমাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়ে আনা হয়েছিলো। সেদিন থেকেই আমার এই সংগ্রামী-বিনয়ী মানুষটার সাথে পথ চলা শুরু।
একেবারে ল্যাদাকালে আব্বুকে খুব কম কাছে পেয়েছি। সকাল ৯টায় যেতো, রাত ১০টায় আসতো। আম্মুর থেকে যদ্দুর শুনেছি, রাতে ঘুম পাড়ানো থেকে শুরু করে, হাগু-মুতু পরিষ্কার, দুধ বানানো – মোটামুটি সবই করতো আব্বু।
আব্বু পাটিগণিতে একেবারে সেই পর্যায়ের ছিলো। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পাটিগণিত আব্বুর কাছেই করতাম। পরে আব্বুও সময় পায় না, তখন আব্বুর এক খালাতো না কেমন যেনও ভাই আমাকে পড়াতে আসতো। মনে হয় উনার নাম বাবুল ছিলো, বাবুল চাচ্চু, উনি পরে কারওয়ান বাজারে মাছের ব্যবসা ধরেন। আমার আব্বা আবার মারাত্মক পর্যায়ের মাছ ভক্ত। হাতে ৫ হাজার টাকা আছে, দেখা যাবে ইয়া বড় পাঙ্গাশ আর নাইলে রিডা মাছ নিয়ে আসছে।
আব্বা ইয়াং কালে সিগারেট খেতও। এক রাতে কি জানি হইলো, আমি মরা কান্না শুরু করলাম। তখন নার্সারিতে পড়ি। সে কান্না এতোই ভয়াবহ ছিলো যে ঘন্টাখানেকের মধ্যে আমার শ্বাস প্রশ্বাসে টান পরে গেলো। কান্নার বিষয়-আব্বু আর সিগারেট খেতে পারবেনা। আব্বা আমার সেইদিন ঘোষণা দিয়ে সিগারেট খাওয়া বন্ধ করে দিলো, আমার জীবনে সংগ্রাম করে পাওয়া অর্জন গুলোর মধ্যে এটি একটি।
আগে একবার বলেছিলাম, যে আব্বু-আম্মুর ১৩ বছরের প্রেম করে বিয়ে। নানা আম্মুকে ডাক্তারের কাছে বিয়ে দিতে চেয়েছিলো, আম্মুর আর আম্মুর দাদীর মত ছিলোনা। আব্বু তখন ঢাকায় স্টেডিয়ামে নতুন ব্যবসা শুরু করেছে, বলতে গেলে পকেটে বাতাস আসে যায় অবস্থা। এর মধ্যেই আব্বা দাদুর থেকে কিছু টাকা নিয়ে, নিজের টাকা দিয়ে বিয়ে উঠালো। শূন্য সে ঘরটাকে আম্মু প্রচণ্ড শক্ত মনোবল আর তীব্র ভালোবাসা দিয়ে আস্তে আস্তে আসবাব কিংবা দরকারি জিনিস দিয়ে সাজাতে লাগলো। এমনও হয়েছে, আব্বু ঈদের জন্য আম্মুকে কেনা-কাটা করতে নিয়ে গেছে, আম্মু নিজের জন্য কিছু না কিনে বিছানার চাদর কিনেছে কিংবা সোফার জন্য কুশন।
একবার হলও কি, হঠাৎ করেই আম্মুর মধ্যে ভীষণ রকমের মৃত্যু ভয় ঢুকে গেলো। কোনোভাবেই আর স্বাভাবিক হতে পারে না। চিৎকার করে কান্নাকাটি করে, দাপাদাপি করে। আমার যুক্তিবাদী পিতা ভালোবাসার মানুষটির জন্য মুন্সিগঞ্জের ফকির, উত্তরার ফকির এর কাছে যেমন গিয়েছেন, দেশবরেণ্য মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ড. বি. চৌধুরীর কাছেও গিয়েছেন, গিয়েছেন সেরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. ফিরোজের কাছেও। কড়া ডোজের ঘুমের ঔষধ খাওয়া ছাড়া আম্মুর আর কোনও কাজ রইলো না। শেষে আব্বু সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেকে আত্মোৎসর্গ করে দিলেন। আব্বু সব সময়ই নামাজী ছিলো, আম্মুর সুস্থতা কামনা করে আব্বু লম্বা দাঁড়ি রাখলো, আরও কঠিন ভাবে নামাজ ধরলো, ৫ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে পড়া শুরু করলো। সব ছেড়ে সাদা পাঞ্জাবি পড়া শুরু করলো। আজকে দশ বছর হয়ে যায় প্রায়, আব্বা এখনও সেমনই আছে। জানি না কে কিভাবে দেখবে ব্যাপারটা, আমি ব্যাপারটাকে দেখি প্রেমিকার জন্য, ভালোবাসার মানুষটার জন্য কতো রকমের আত্মত্যাগ করা যায়, তার উদাহরণ হিসেবে। উল্লেখ্য, আম্মা তার দিন কতকের মাঝেই আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠেন।
উল্লেখ্য, আব্বু বিরাট গনতান্ত্রিকমনা। ব্যবসায়িক কিংবা সাংসারিক যে কোনো কাজে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া মানে হলো, আমি আম্মু, আপু আর আব্বু একসাথে বসে সেটা নিয়ে আলোচনা করা। এ ক্ষেত্রে আব্বুর একটা ডায়ালগঃ “খাবার টেবিল হলো একটা পরিবারের সংসদ, বুঝছো?” আব্বার সাথে আমার সম্পর্ক অনেকটা ইয়ার দোস্তের মতোই, রাস্তায় গলায় হাত দিয়ে হাঁটি কিংবা রসিকতা-পঁচানি সবই চলে। আর সবচেয়ে বেশী যেটা চলে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আব্বু আর আমার সেই পর্যায়ের বিচার বিশ্লেষন।
বুঝ হবার পর থেকেই বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, জাতীয় পতাকা, জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। আগেও বলেছি, এখনও বলি – আমার মধ্যে যদি সামান্য থেকে সামান্য তম দেশপ্রেম থেকে থাকে, যদি দেশের জন্য সামান্য ভালো কাজ করার তীব্র ইচ্ছা থেকে থাকে, সেটা একমাত্র আমার বাবা’র কারণে। ২৬শে মার্চে, ১৫ই আগস্টে, ১৬ই ডিসেম্বরে যখন টিভি চ্যানেল গুলাতে বঙ্গবন্ধু হত্যা আর মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী শিবিরের নির্মম ডকুমেন্টারি গুলো দেখায়, বাপ-বেটা কেউ কারও দিকে তাকাতে পারি না। অন্যদিকে তাকিয়ে যার যার চোখের পানি মুছে নেই।
আমার আব্বা বিশেষ রকমের আবেগী মানুষ। আগে যখন শুক্রবারে বিটিভিতে দুপুরে বাংলা সিনেমা দেখতাম, মাঝে মাঝেই শাবানাকে রিক্সা চালাতে দেখে কিংবা রাজ্জাককে ঠেলাগাড়ি ঠেলতে দেখে আব্বার চোখে পানি আসতে দেখেছি। আপু যখন মেট্রিক ইন্টার দেয়, আপু’র বান্ধবীরা দল বেধে আব্বুর থেকে দোয়া নিতে আসতো পরীক্ষা শুরু হওয়ার ঠিক আগে দিয়ে। আব্বু সবার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করতে করতে দেখতাম আকাশের দিকে তাকিয়ে কিভাবে একটা মানুষের চোখ ভিজে যায়।
আব্বু জীবনে কম হোঁচট খায়নি। আব্বুর জায়গায় থাকলে এতদিনে কয়টা খুন খারাবি করে হাজতে থাকতাম, আল্লাহই ভালো জানে। অথচ আব্বুর এক কথা, “আল্লাহ তো খারাপ রাখে নাই। বৌ-বাচ্চা নিয়ে এরকম খরচান্ত ঢাকা শহরে খেয়ে দেয়ে ভালোই তো আছি”। আব্বু সবসময়ই সন্তুষ্ট শ্রেণির মানুষ। স্টেডিয়ামে সব হারিওয়ে মাস কতক বাসায়, এরপরে মোতালেব প্লাজায় বহু কষ্টে একটা দোকান কিনে আবার কিছু দিনের মাথায় চার লাখ টাকা ঋণ পরিশোধের জন্য প্রায় অর্ধেক টাকায় সে দোকান বিক্রি করে দেয়। সত্যি বলতে, এমনও সময় গিয়েছে আমাদের, তিন মাসেও মুরগী কাকে বলে দেখি নি। সে সময়টাতে আমি দেখেছি, মা কাকে বলে। কিভাবে সংসারের হাল ধরে আর কিভাবে সেটা উত্তাল সমুদ্রে চালিয়ে নিতে হয়, আমি দেখেহি। আমার দেখার দরকার নেই যে হিলারি ক্লিনটন কিভাবে আমেরিকা চালায়, আমি ১০০% নিশ্চয়তা দিতে পারি, আমার মা যেভাবে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছিলো, দুই ভাই-বন আর আমার বাবা – এই ৩ শিশুকে নিয়ে যেভাবে বৈরী পরিবেশ থেকে টিকিয়ে রেখেছিলো আমাদের, হিলারি জাস্ট হার্ট এটাক করতো। প্রচণ্ড বৈরী সে সময়ও আব্বুকে বিচলিত হতে দেখিনি। আমার আব্বার খুব অসাধারণ বৈশিষ্ট্য গুলোর একটা হলো – “ যতো বড় বিপদ, মাথা ততো বেশী ঠাণ্ডা”
আমার আব্বা’র দাবী, তার জীবনে অর্জিত সবচেয়ে বড় অর্জন হলো কারও দশ টাকা না মেরে খাওয়া। একটা বাজে সিস্টেমের মধ্যে ব্যবসা করে এতোটা সততা ধরে রাখা কতোটা কঠিন কাজ, আমরা দেখেছি। ৯০ এর দশকের কথা। তখন, দেশে মাত্র চাইনিজ ডেক-সেট ঢোকা শুরু হয়েছে। এর আগ পর্যন্ত সনি কোম্পানির মালয়েশিয়ান ডেক-সেট বিক্রি হতো। লোভী ব্যবসায়ীরা সনি’র মালয়েশিয়ান ডেক-সেটের আদলে চাইনিজ সেসব ডেক-সেট বানিয়ে এনে একই দামে বিক্রি করা শুরু করলো। ক্ষতির মুখোমুখি আব্বা তখনও সে মালয়েশিয়ান ডেক-সেট বিক্রি করেছে। শেষে টিকতে না পেরে সে ডেক-সেট বিক্রিই বন্ধ করে দিয়েছিলো, তবুও ঠকায়নি কাউকে।
অল্প কয়টা টাকা যা সঞ্চয় করেছে জীবনে, তার বেশীর ভাগই বারে বারে বিশ্বাস করে হারিয়েছে আব্বা। এই লোক খুব ভালো – ভেবে ব্যবসা করতে গিয়েছে, টাকা মেরে পালিয়েছে। এই ধরণের ঘটনা এই পর্যন্ত ৩ বার ঘটেছে। জানি না শিক্ষা হয়েছে কি না। তবে, আমার আর আপুর পড়াশুনার পেছনে আব্বা অকাতরে টাকা ঢেলেছে। যেভাবে পেরেছে, খরচ করেছে। আব্বা আমাকে অনেক ছোটো বয়সেই একটা কথা একেবারে ক্লিয়ার করে দিয়েছে – “আমি কিন্তু তোমাকে বাড়ি গাড়ি করে দিয়ে যেতে পারবো না। পড়াশুনা করিয়ে যাবো, শিক্ষা দিয়ে যাবো।“ আগে খুব মন খারাপ হতো, বন্ধুদের গাড়ি আছে, বাড়ি আছে। আব্বু কেমন মানুষ? কিচ্ছু করলো না! এখন বুঝি, তিনি আমাকে সেরা জিনিসটাই দিয়েছেন।
একবারের ঘটনা। তখন বোধ হয় ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। প্রচণ্ড জ্বর আসছে। তো, খুব হিসু চেপেছে, আমি করলাম কি টয়লেটে গিয়ে দিলাম ছিটকিনি আটকিয়ে। অথচ সবসময় শুধু লক আটকাই। কি হলো কিছুই জানিনা, ধপ করে বাথরুমের ভেতরে মাথা ঘুরিয়ে পরে গেলাম। কতক্ষণ ছিলাম ভেতরে জানি না, একটু পরে জ্ঞান আসলে শুনি দরজা লাথি দিয়ে ভেঙ্গে ফেলার আওয়াজ। আর সব কিছু ছাপিয়ে আম্মু দাপা-দাপি করে কান্না কাটির আওয়াজ। আব্বু চিৎকার করে আমার নাম ধরে ডাকছে। আমি কোনোমতে পানি ভরা বালতির উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ছিটকিনি খুলতেই আব্বু দরজা খুলে ফেললো। আরেকবার জ্ঞান হারাবার আগে শুধু দেখতে পেলাম, আব্বুর চেহারা টকটকে লাল, কাঁদতে কাঁদতে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আম্মু তখন জ্ঞান হারিয়েছে। আমাকে আর আম্মুকে নিয়ে আব্বু সে কী বিপদ। ভাবলেই কেমন অবাক লাগে, জীবনে এরকম বাবা হতে পারবো কি না আল্লাহই জানে!
আব্বুর হাতে জীবনে পিটুনি তো দুরের কথা, বকা কয়বার খেয়েছি মনে নেই। স্কুলে আমার রেজাল্ট ছিলো বলতে গেলে অনেকটা ধ্রুবকের মতো। ফার্স্ট টার্ম ভালো হবে, সেকেন্ড টার্ম খারাপ হবে, বার্ষিকে একেবারে ফাটাফাটি রেজাল্ট! তো, খারাপ হলে সব বন্ধুদের থেকে শুনতাম “আজকে খবর আছে বাসায় গেলে” কিংবা” আজকে মাইরাই ফেলবো আব্বা আমারে”। কাউকে কাউকে শুনতাম পর্দার রড দিয়ে নাকি মারতো। আমার আব্বা যেটা বলতো, “ উহহ। পরেরবার ভালো করতে হবে”, ব্যাস এইটুকুই! এবং আমি বিশ্বাস করি, এই কথাটাই আমাকে অনেক অনেক প্রেরণা জাগিয়েছে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে।
আব্বা খুব নামাজ-রোজা করলেও কোনও কিছু নিয়েই অন্ধ নয়। যেমন সেদিন মসজিদে কিছু লোক আব্বাকে জাপটাজাপটি করছিলো তাবলীগে যাবার জন্য। আব্বা তখন বললো, “ শুনেন ভাই। আমার ছেলে-মেয়ে আছে, স্ত্রী আছে। এদের ভরন-পোষন আমার জন্য ফরজ। আপনার তো ভাই ৩ টা বাড়ি আছে, তো মদীনায় যখন মুহাজিরেরা হিজরত করছিলো, মদিনার লোকজন নিজেদের দুইটা বাড়ি থাকলে মুহাজির ভাইদের একটা বাড়ি দিয়ে দিয়েছিলো। আপনে যখন ফরজ বাদ দিয়ে এতো নফল নিয়ে দৌড়ান, তাইলে সেই হিসেবে আপনার একটা বাড়ি আমার নামে করে দেন! করবেন? সেইটা তো করবেন না”, এরপরে আর আব্বারে বিরক্ত করার সুযোগ পায় নাই উনারা।
একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য বর্তমান সময়ে একটা আইপিএস কেনা মোটামুটি ঘামানোর মতো ব্যাপার। আমার টার্ম পরীক্ষা দিতে কষ্ট হচ্ছে দেখে, আব্বা কিভাবে কিভাবে যেনও ক’দিন আগে আইপিএস কিনে এনেছে। লজ্জায় ইচ্ছে করেছে মাটির নিচে চলে যাই, কি এমন পড়াশুনা করি আমি! আর, এই টাকা যোগাড় করতে আব্বুর কতো কষ্ট করতে হয়েছে, আমি জানি। আমি জানি না, একটা মানুষের এক-দেড় ফুটের মতো বুকে এতো ভালোবাসা, এতো আবেগ, এতো মমতা কিভাবে জমিয়ে রেখেছে?
এখনও আব্বু খাটে পরে থাকা আমার কাপড়টা গুছিয়ে দেয়, মশারিটা টাঙ্গিয়ে দেয়। আমি চাইলে বলে, “ তুমি পার বানা। তুমি পড়ো”, এখনও এসে মলমটা লাগিয়ে দিয়ে যায়, ওষুধটা দিয়ে যায়। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, শুকিয়ে যাওয়া দেহটা এখনও রাত জেগে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সমগ্র পড়ে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাওয়া যে কোনও বই পড়তে বসে পরে। আব্বার সাথে আমার এখানেই মিল, আদর্শের মিল।
বাবা, তোমাকে ক্লাস ফাইভে, ক্লাস এইটে বৃত্তি এনে দিতে পারি নাই। আমি জানি, তুমি বিশাল কষ্ট পেয়েছিলে। অথচ বলেছিলে, “পরেরবারে ভালো করতে হবে”, সে মিথ্যা সান্ত্বনায় তুমিও জানতে আর কখনও বৃত্তি পরীক্ষা দিতে পারবো না। এসএসসি আর এইচএসসিতে যখন গোল্ডেন পেলাম না, কি বললা? “পরেরবার ভালো করতে হবে”, অথচ তুমিও জানো আমিও জানি, আর কোনোদিন মেট্রিক-ইন্টার দিবো না। গোল্ডেনহীন আমাকে যখন কোনও কলেজ নিতে চাইলো না, তুমি আমি কি কষ্টটাই না করলাম! ১০-১২ ঘণ্টা রাইফেলস কলেজ, সিটি কলেজের সামনে পথের ফকিরের মতো দাঁড়িয়ে থাকতাম। অথচ, তোমার ব্রিগেডিয়ার ভাইকে দিয়ে লবিং করালেই বিএফ শাহীন কলেজে হয়তো একটা সিট পেয়ে যেতাম। তুমি করাও নাই, এখানেই তোমার আমার মিল, আদর্শের মিল।
আমি জানি, এখনও তুমি ভরসা রাখো আমার উপরে। আম্মুকে যখন তখন কোলে নিতে পারি, চুমু খেতে পারি, জড়িয়ে ধরতে পারি। কিন্তু, কেনো যেনও তোমাকে অমন ভাবে আবেগটা দেখাতে পারি না। লজ্জা লজ্জা করে। তুমি হয়তো জানো না, জেমসের বাবা গানটা শুনে আজও আমি রাতের বেলা দরজা বন্ধ করে একা একা দম বন্ধ করে কাঁদি। বাবা, তোমাকে ভালোবাসি। আমার জীবনে মহাপুরুষ দেখার সাধ নেই, মহাপুরুষ হবারও সাধ নেই। আমি আরেকটি মোঃ সোলায়মান সরকার হতে চাই, যে কিনা অন্যায়কে নিজের জীবনে জায়গা দেয় নি কোনোদিন, যে কিনা ভালোবাসাকে জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ বিবেচনা করেছে, যে কিনা কখনও কারও আবেগকে অপমান করে নি। বাবা, দু লাইন গান শোনাই তোমাকে ?
ছেলে আমার বড় হবে,
মা-কে বলতো সে কথা।
হবে মানুষের মতো মানুষ এক,
লেখা ইতিহাসের পাতায়।
নিজ হাতে খেতে পারতাম না,
বাবা বলতো, “ও খোকা!”
“যখন আমি থাকবোনা,
কি করবিরে বোকা”
এতো রক্তের সাথে রক্তের টান,
স্বার্থের অনেক ঊর্ধ্বে।
হঠাৎ অজানা ঝড়ে তোমাকে হারালাম,
মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরলো।
বাবা কতদিন,
কতদিন দেখিনা তোমায়।
কেউ বলেনা তোমার মতো,
“কোথায় খোকা ওরে বুকে আয়।“
বাবা কতো রাত,
কতো রাত দেখি না তোমায়।
কেউ বলে না “মানিক,
কোথায় আমার ওরে বুকে আয়।“
উৎসর্গঃ পৃথিবীর সব বাবাকে, যারা জীবন থেকে প্রতিটি দিন সন্তানের জন্য উৎসর্গ করে যাচ্ছেন।
আংকেলকে স্যালুট! আমাদের বাবাদের নিয়ে কত কথা আছে!
দারুণ লাগল! দারুণ!
অসাধারণ লাগলো নিশম।
উফফফফ……অসসাধারণ !! কখন যে চোখে পানি চলে আসলো……
আঙ্কেলকে কি লেখাটা দেখিয়েছেন ?? না দেখিয়ে থাকলে প্লিজ দেখাবেন……
দেখাইনি। লজ্জা লজ্জা লাগে 😛
না দেখিয়ে থাকলে প্লিজ দেখাবেন……
আংকেলকে আমার অনেক শ্রদ্ধা… 🙂
অসাধারণ! অসাধারণ!! অসাধারণ!!!
সেলাম।
শ্রদ্ধা………
নিশম, অসাধারণ বললেও কম বলা হবে রে।
চোখে জল এসে গেল!
আংকেলকে আমার সালাম!