এক পশলা বৃষ্টি আর আমাদের গল্প ….

একাকী এক বৃষ্টিভেজা রাতে

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, ঝুম বৃষ্টি। সকাল অবাক হয়ে এই বৃষ্টি দেখে। বৃষ্টি তার কখনই ভালো লাগেনা। বৃষ্টির শব্দ তার কাছে কেমন যেন সুরহীন মনে হয়। তাল নেই, লয় নেই। মানুষ এই বৃষ্টি এত পছন্দ কিভাবে করে ভেবে পায়না সকাল। “আচ্ছা রুদ্র কি করত এমন সময়?”,সকাল ভাবে। ঝুম বৃষ্টি রুদ্রর অনেক প্রিয় ছিল। রাত হোক বা ভোর, বৃষ্টি হলেই সে খালি পায়ে বের হয়ে পড়ত। অনেকদিন রুদ্রকে এভাবে বৃষ্টির মাঝে খালি পায়ে হেঁটে যেতে দেখেছে সকাল। তার মনে হত ছেলেটা পাগল। কিন্তু এই পাগল ছেলেটাই যে তার জীবনটাকে এভাবে বদলে দেবে কে জানত!

“এই সকাল শুনছ?”, পাশের ছাদ থেকে রুদ্র ডাক দেয় সকালকে।
“জ্বী ভাইয়া।”
“কী কর ছাদে?”
“ভাইয়া এমনিতেই আসলাম,বিকাল বেলা ভালো লাগছিল না।”
“হুম, আজ তোমাকে দেখলাম রব কাকার দোকানে। মনে হয় কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিলে? তাই না?”
“হ্যাঁ ভাইয়া, মাঝ পথে বৃষ্টি নেমে পড়ল তাই দাঁড়িয়েছিলাম।”
“তুমি বৃষ্টি ভালবাস না?”
“না ভাইয়া, ভালো লাগে না।”
“ও!”
“ভাইয়া যাই আম্মু ডাকছে।”
“আচ্ছা যাও, তবে বৃষ্টির কিন্তু অন্যরকম একটা আহ্বান আছে যেটা সবাই বুঝতে পারেনা, পারলে ভিজ একদিন। অন্যরকম লাগবে।”
“আচ্ছা ভাইয়া” বললেও মনে মনে পাগল, ছাগল বলে বাসায় চলে আসে সকাল।

এরপর অনেকদিন হয়েছে রুদ্র প্রায়ই সকালকে বলে বৃষ্টিতে ভিজতে কিন্তু “হ্যাঁ ভাইয়া ভিজব একদিন” “জ্বী ভাইয়া অবশ্যই ভিজব” বলে বারবার এই পাগলটাকে এড়িয়ে যায় সকাল।

সেদিন ছিল আষাঢ়ের প্রথম সন্ধ্যা, ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। সকাল বারান্দার জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। “আরেহ ঐটা রুদ্র ভাইয়া না”, প্রায় কাকভেজা রুদ্রকে দেখে বলে ওঠে সকাল। হুম রুদ্রই, বৃষ্টিতে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। “আচ্ছা এই পাগল মানুষটার কি আর কোন কাজ নেই?”,ভাবতে ভাবতে চলে যায় সকাল।

“সকাল, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল,বলব?”,রুদ্র বলে ওঠে সকালকে। দুজনেই ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। আজ সকালকে অনেক সুন্দর লাগছে যেন বর্ষার স্নিগ্ধতা ওকেও ছুঁয়ে গিয়েছে।
“জ্বী ভাইয়া, বলেন।”, সকাল একদম সাধারণ ভাবেই বলে। তার মাঝে কোন কৌতুহল নেই।
“না মানে, সকাল আমার খুব ইচ্ছে আমি কোন এক বৃষ্টিভেজা রাতে তোমার হাত ধরে হাটব,নিয়ন বাতির নিচে। একটা আলো আধারির খেলার মাঝে আমি আর তুমি অনেক দূর হেঁটে যাব। যখন বৃষ্টি থামবে তখন দেখব দুজনে কাকভেজা হয়ে কোন বিশাল মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। ততক্ষণে ভোর হয়ে গেছে, দুজনে ভোরে সূর্য ওঠা দেখব। যাবে আমার সাথে?”
“রুদ্র ভাইয়া, আমি পাগল দেখেছি তবে আপনার মত না। আর একটা কথা আমার সাথে এই ধরনের ফালতু কথা বলবেন না, আসি।”,বলে গটগট করে হেঁটে চলে গেল সকাল।

“সকাল আপা, সকাল আপা”, খুব ভোরে হাঁপাতে হাঁপাতে আসে কাশেম। রুদ্র যেখানে থাকে তার পাশেই এক চায়ের দোকানে কাজ করে সে। সকালও ওকে চেনে ভালো ভাবেই, মাঝে মাঝেই বাবার জন্য ওদের দোকান থেকে চা আনাতে হয় ওর।
“কি রে কাশেম, কি হয়েছে?”,চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে সকাল জিজ্ঞাস করে।
“আপা, রুদ্র ভাইতো মইরা গেছে!”
সকালের হাতের চিরুনীটা আস্তে করে মাটিতে পড়ে যায়, কিছু বলতে পারে না ও।
কাশেম বলতে থাকে “কাইল বিয়ানে কাপুইন্না জ্বর আইল, কত কিছু করলাম কিন্তু ভাইয়ের মনে হয় সময় হইয়া আইছিল। মরার আগে আপনারে এইডা দিতে কইল”
সকালের হাতে একটা ছোট্ট চিঠি ধরিয়ে দিয়ে চলে যায় কাশেম।

প্রিয় সকাল,
তোমাকে সেদিন হুট করে ওভাবে কথাটা বলে ফেলা ঠিক হয়নি। আসলে বুঝতে পারিনি তুমি এত কষ্ট পাবে। আমি আসলে তোমাকে ভালবাসি বলতে চেয়েছিলাম, পারিনি। আসলে পারা হতোও না। খুব ছোটবেলায় নাকি এমনই এক বৃষ্টির রাতে আমার জন্ম, মা জন্মের সময়ই মারা যায়। বাবা আমার জন্য কোনদিন বিয়েও করেন নি। কিন্তু একদিন বাবাও চলে গেল। রয়ে গেলাম শুধু আমি। সেদিন থেকে ঝুম বৃষ্টির মাঝে মা-বাবাকে খুঁজে বেড়াই। মনে হয় এই বৃষ্টির মাঝে কোন এক রাস্তায় তারা আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আর জানোতো ছেলে মানুষের কাঁদতে নেই। কিন্তু মায়ের জন্য যে কান্না পায় খুব। তখন বৃষ্টিতে ভিজি আর চোখের জল ঐ বৃষ্টিতেই ধুয়ে যায়। জানো সকাল, আমি তোমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন বুনেছি কিন্তু একটা স্বপ্নও সত্যি হবে না আমি জানি। আচ্ছা সকাল তুমি বৃষ্টি কেন ভালবাস না? বৃষ্টির শব্দ শুনেছ কখনও? খুব মন দিয়ে? মনে হয় শোননি, তাইনা? আচ্ছা একটা শেষ কথা, যদি কখনও পারো তবে খুব রাতে ঝুম বৃষ্টিতে ল্যাম্পপোস্টের নিচে নিয়ন বাতির আলোয় হেঁটে দেখ। অনুভূতিটা না হয় তুমিই জানিও।
ইতি
পাগল রুদ্র।

চিঠি পড়তে পড়তে কখন যে সকালের গাল বেয়ে কান্নার জল বেয়ে পড়া শুরু করেছে তা ও খেয়ালও করেনি। আস্তে করে চিঠিটা ওর ডায়েরীতে রেখে দেয় সকাল।

রাত একটা বাজে, বাইরে ঝুম বৃষ্টি। এত রাতে একলা একটি মেয়ে খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। দূরে নিয়ন বাতির আলোয় তার আবছা একটা ছায়া পড়ছে রাস্তায়। আচ্ছা মেয়েটা কি কাঁদছে? রুদ্রর জন্য? নাকি রুদ্রের সাথে ওর হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে, একসময় ভোর হবে আর ওরা দুজনে ভোর হওয়া দেখবে।

 

অক্ষর সম্পর্কে

স্বপ্নবাজ মানুষ একজন। আশাবাদ আর নিরাশার দোলাচালে আশাকেই শেষ পর্যন্ত সঙ্গী করতে চাই। আর স্বপ্ন দেখি একদিন দেশের জন্য কিছু করার, স্বপ্ন দেখি ছোট্ট করে হলেও কিছু একটা করার যা একটা প্রজন্মের গতিপথ পরিবর্তন করবে এবং অবশ্যই সেটা যেন হয় ইতিবাচক কোন পরিবর্তন। এখন পড়াশোনা করছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে। গণনা যন্ত্রের উপর পড়াশোনা করছি ঠিকই কিন্তু যন্ত্র শব্দটাই আমার কাছে বিরক্তিকর। ফেসবুক লিঙ্ক- www.facebook.com/akkhar21
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

24 Responses to এক পশলা বৃষ্টি আর আমাদের গল্প ….

  1. শামসীর বলেছেনঃ

    আহা বৃষ্টি , এই বিলাসিতা কেবল বাঙ্গালীকেই মানাই 🙂

  2. বৃষ্টি মানে কথা, বৃষ্টি কোন ব্যাথা…
    বৃষ্টি কল্পনা…
    বেশ চমতকার লেগেছে লিখাটা…
    তবে মনটাও খারাপ করে দিলেন…

  3. অনাবিল বলেছেনঃ

    বৃষ্টি ব্যাপারটাই কী সুন্দর! বৃষ্টিকে ভালো না বেসে পারা যায়!

    গল্পটা শুরু হতে না হতে-ই ফুরিয়ে গেলো… আরেকটু গভীর হলে ভালো হতো, মনে হচ্ছে তাড়াহুড়োতে লিখা……
    লেখা চলুক……… 🙂

    • অক্ষর বলেছেনঃ

      তাড়াহুড়োতে লেখা মনে হয়েছে ? হতে পারে। আমি খুব বেশি ভেবে লিখিনা। এরপর আস্তে আস্তে লেখার চেষ্টা করব।
      :happy:

  4. নিলয় বলেছেনঃ

    অক্ষর, দারুণ হয়েছে- যদিও মনটা খারাপ করে দিলা! 😳

    আমার স্বভাবও গল্পের রুদ্র-র মতন পাগলাটে, বৃষ্টি হলেই ভিজতে হবে- কোন কথা নেই; তাই আরো ভালো লেগেছে 🙂

  5. সামিরা বলেছেনঃ

    প্রথম অর্ধেক ভাবলাম সকাল কি কোন ছেলে কিনা। 😛

  6. শারমিন বলেছেনঃ

    ভালো লেগেছে 😀

  7. একুয়া রেজিয়া বলেছেনঃ

    একসময় ভোর হবে আর ওরা দুজনে ভোর হওয়া দেখবে।

    ভাল লাগলো 🙂

  8. জ্ঞানচোর বলেছেনঃ

    শামসীর ভাইয়ের মন্তব্যের জের ধরে বলতে চাই,
    এই এক বৃষ্টি এত রকম আবেগ দেওয়া একমাত্র বাঙ্গালীর পক্ষেই সম্ভব। পশলা বৃষ্টির মাঝেই আমাদের সবরকম স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। কাউকে পাওয়ার স্মৃতি,কাউকে হারানোর স্মৃতি, অপেক্ষার স্মৃতি।
    অন্ধকার করা একটা বৃষ্টি আশা করেছিলাম রুদ্র মারা যাওয়ায়। অক্ষর সেই বৃষ্টি এনে দিলেন রাত একটার পর। বজ্রধ্বনি শুনতে পেয়েছি যেন তার সাথে।

    তারপরও ভোর হওয়ার আশা দিয়ে শেষ করেছেন। তাই অযথা কষ্ট পেলাম না। (হয়তো পেলাম, কিন্তু, কি বা আসে যায়? বৃষ্টিতেই ধুয়ে যাবে সব এই বর্ষা)

  9. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    গল্প চলুক, বর্ষা ধুয়ে দিক মনের অলিগলি।

    তবে তোকে মাইর।
    বানান নিয়ে আর কত বলব? :haturi:

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।