আমি এক সস্তা লিফলেট; সস্তা আমার জীবনের গল্পটাও। তবু আজ আমার এই ধূলোপথের গল্পটাই আপনাদের শোনাতে এসেছি। জানি, যান্ত্রিক জীবনের দৌড়ে সবাই অনেক অনেক ব্যস্ত। তবু একটু কি সময় হবে আমার এই কষ্ট গাঁথার সঙ্গী হবার?
বর্তমান তথা এই আধুনিক সমাজব্যবস্থার একটা অন্যতম হাতিয়ার কাগজ। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তৈরি হয়েছে এর কতই না রকমারি রূপ। আর্টপেপার, গ্রাফপেপার, হোয়াইটপেপার আরও কতো নামই তো শুনি। কতগুলো আছে বনেদি কাগজ; তারা রূপে ও গুণে দুয়েই অনন্য। আবার কিছু আছে মাঝারি গোছের; সমাজে তাদের ব্যবহারই বোধহয় সবচেয়ে বেশি। নানারকম উত্তম-মধ্যম কাগজের ভীড়ে কিছু অচ্ছুৎ, নিচু গোত্রের কাগজেরও জন্ম হয়। তাদের না থাকে রূপ, না থাকে গুণ। অবশ্য রূপ-গুণ না থাকলেও আমার মতো সস্তা লিফলেটের জীবনে ‘হাড়-হাভাতের নুন দিয়ে ভাত খাওয়া’র মতোই এরা কাজে আসে। এদের দিয়ে কেউ বিয়ের কার্ড ছাপে না, জন্মদিনের গিফট মোড়ে না, দামি দলিল-দস্তাবেজও এদের জমিনে স্থান নেয় না ।এমনকি কোনো ছন্নছাড়া প্রেমিক তার প্রেমিকার উদ্দেশ্যে এর বুকে চিঠি লেখে না। এই সস্তারা জন্মে যেন আমার মত কিছু সস্তার জন্ম দিতেই।
একসময় প্রেসের আটপৌরে ঘরে এনে হাজির করা হয় এইসব সস্তা-কাগজের দলকে। প্রেসের লোকেরা এর বুকে ফুটিয়ে তোলে আমার মত একেকটি লিফলেটের জীবন। বুকের শূণ্য জমিন ভরিয়ে তোলেন নানান কথায়।
তারপর প্রেসঘর থেকে বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে আমার স্থান হয় কোনো এক প্রচারকর্মীর ব্যাগে। এই প্রচারকর্মী মানুষটা আবার বড্ডো অদ্ভূত! অদ্ভূত তার বেশভূষ, অদ্ভূত তার কাজের ধারা।আপাদমস্তক ঢেকে দেয়া বোরকা পরে সে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে একটি জ্যামের জন্য! চলন্ত বাসগুলো যখন মোড়ের দীর্ঘজ্যামে আটকা পড়ে কিংবা পেট থেকে যাত্রী নামানোর জন্য দাঁড়ায় সে তখন তার কাছে ছুটে যায়। তারপর বাসের খোলা জানালা দিয়ে ছুড়ে দিতে থাকে লিফলেটগুলো। আর এর মধ্য দিয়ে একটি লিফলেটের জীবনে সূচনা হয় নতুন এক অধ্যায়ের।
একসময় আমার পালা আসে। প্রচারকর্মী মেয়েটি আমাকেও একইভাবে বাসের জানালা দিয়ে ছুড়ে দেয়। যে লোকটির কাছে গিয়ে পড়ে সে একবার তুলে নিয়ে দেখে, কিন্তু পরক্ষণেই জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়।পড়েও দেখতে চায় না কি কথা আমার বুকে লেখা। কিন্তু প্রচারকর্মী মেয়েটিও নাছোড়বান্দা। সে কাছেই দাঁড়িয়েছিলো; আবার আমাকে তুলে নেয়।তার কিছুক্ষণ পর আরেকটি জ্যাম লাগে। মেয়েটি আমাকে আগেরমতো আবারো বাসের জানালা দিয়ে ছুড়ে দেয়।এবার আমি গিয়ে পড়ি একটা মাঝবয়সী লোকের কাছে। সে আমাকে হালকা ঝাটকা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
তারপর আমি ঐ বাসের মাঝেই লোকের পায়ের তলায় আর ধূলোর ভেলায় গড়াগড়ি খেতে থাকি। কিছুক্ষণ পর বাসটা কিছুটা হালকা হয়ে আসে। একটা কলেজের সামনে থেকে কিছু লোক বাসে উঠে। তাদের মধ্যে ছিলো একটা ছেলে আর তার বাবা। তারা এসে যেখানটায় বসে আমি তার কাছাকাছিই ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা তাদের পাশের যাত্রীর সাথে নানান কথায় জমে উঠে। জানতে পারলাম ছেলেটি পরীক্ষায় প্লাস পেয়েছে। এখন ভালো কলেজে ভর্তি হবার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এসেছে। কথাপ্রসঙ্গে লোকটি ছেলেটিকে তার কলেজভর্তির আবেদনফরমের নাম্বার লিখে দিতে বলে। আশেপাশে কাগজ না পেয়ে নাম্বার লেখার জন্য ছেলেটি আমাকেই তুলে নেয়। তখন লোকটি সাথে সাথে বলে উঠেন, “আররে! ফেলো, ফেলো। ওতে দুনিয়ার যত অমঙ্গলের কথা লেখা। ওগুলো কখনো ধরেও দেখো না।” ছেলেটি বিব্রত হয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলে দেয়। ঘৃণার দৃষ্টি যে কত ভয়ানক হতে পারে সেটা আমি সেদিনই প্রথম অনুভব করি।
আমার বুকজুড়ে যে কষ্টগুলো তা যেমন গোপন, এই লেখাগুলোর মাঝেও তেমনি অনেক গোপন গোপন ইঙ্গিত! নানান গোপন রোগের ইতি-বৃত্তান্ত আর তার গোপন সমাধান লেখা থাকে এতে। আর তাই ভদ্র-সমাজ একে ঘৃণার সাথে ছুড়ে ফেলে অবহেলার আস্তাকুঁড়ে। কিন্তু কেউ কি একবারও ভাবে না কারা আমার বুকের খালি জমিনে নষ্ট প্রলোভনের ছক এঁকে মানুষকে খারাপ দিকে পরিচালিত করছে? তাদের প্রতিকারে এই ভদ্র-সমাজের কি কোনোই দায়িত্ব নেই?
গাড়ির জানালা দিয়ে আমি এসে পড়ি খোলা রাস্তায়। বাতাসের সাথে নেচে ধূলোর সাথে পাল্লা দিয়ে আমি পথ চলতে থাকি। জানি না কি আমার গন্তব্য। তবু এ মুক্তজীবন আমার ভালোই লাগে। হয়তো এভাবে পথ চলতে চলতেই একসময় আমার ঠাঁই হবে কোনো টোকাইয়ের ঝোলায় কিংবা আবর্জনার স্তুপে। আর নয়ত রোদে পুড়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে বিলীন হওয়াই আমার অনিবার্য পরিণতি। তার আগপর্যন্ত আমার এই সস্তাজীবনে আমি অবলোকন করে যাব অদ্ভূত এই পৃথিবীর অদ্ভূতুড়ে রূপ…
লেখার আইডিয়াটা ইন্টারেস্টিং! ভাল লেগেছে।
ধন্যবাদ, সামিরা।
আপনার কাছ থেকে এমন কমপ্লিমেন্ট নিঃসন্দেহে আমার লেখালেখির ভুবনে একটা উৎসাহব্যঞ্জক ভূমিকাই রাখবে…
শুরুটা চরম। শেষটাও মোটামুটি।
ঘৃণিত তথ্যের ফেরী করার দায়ভার সমাজের কাঁধে তুলে দিয়ে একেবারে ধূলায় সমাধি করার দরকার কি ছিল? তারা এত লিফলেট যখন ছাপাচ্ছে, নিশ্চয়ই এর মধ্যে কিছু লিফলেট ভাগ্যবান তো হয়ই। এত লিফলেটের মধ্যে এটাও একটু ভাগ্যবান হলেই তো ভাল হতো। জ্যামর ভীড়ে লোকের চোখ এড়িয়ে কারো পকেটে চারভাঁজে বন্দি হলে জীবনের বাকি ইতিহাসকে চেপে যেতে পারতেন।
(তখন বাকি ইতিহাসটা আবার ভদ্র সমাজের চোখে লাগতো। তাই, পুরোটা না বলে, কাহিনী গড়িয়ে দিলেই হলো।)
ভাল লাগলো বিষয়টা। চলুক।
ধন্যবাদ।
চারভাঁজে বন্দী করাতে গিয়ে যদি আবার বেফাঁস কিছু বলে ফেলি, এই ভয়েই আর ওদিকে এগুলুম না। তয়, আপনি যখন বলছেন, দেখা যাক ভবিষ্যতে কি হয়…
বাহ্! লেখাটা দারুণ তোহ!
অনেক কিছুর আত্মকাহিনী পড়েছি, কিন্তু লিফ্লেটের?! ভিন্নরকম !!
লেখা চলুক………
ধন্যবাদ আপনাকে…
চলবেই তো…সবে যে শুরু… 🙂
🙂
লেখার প্লট বেশ লাগলো।
শুভকামনা। 🙂
ধন্যবাদ।
শুভ ব্লগিং…