কর্তব্য – শরীরের প্রতি

কিছুদিন আগে মোখতার মাগরুবির এক লেকচারে শুনছিলাম, আখলাক্ব শব্দের উৎপত্তি ‘খ ল ক্ব’ থেকে দু’টো শব্দ আসে, খালক্ব এবং খুলক্ব। এর একটির মানে শরীর, অপরটির অর্থ আত্মা। আখলাক্ব বা সর্বোত্তম চরিত্র নিশ্চিত করতে খালক্ব ও খুলক্ব – দুটোরই নিয়মিত পরিচর্যা প্রয়োজন। তিনি আরো একটা কথা বলেছিলেন, আমরা নিয়মিত শরীর পরিচ্ছন্ন রাখতে গোসল করি, আমাদের মধ্যে কতজন নিয়মিত ‘স্পিরিচুয়াল শাওয়ার’ নেন? অনেক দিনের ময়লা জমে জমে তাদের আত্মা যে দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে যায়, সেটা আশপাশের সবাই টের পায় – কেবল তারাই টের পান না।

যা হোক, আত্মা, স্পিরিট – এসব নিয়ে আমার আগ্রহের কমতি নেই, তাই স্পিরিচুয়াল শাওয়ার জাতীয় ব্যাপার স্যাপার আমি ঘেঁটে দেখেছি মোটামুটি (Click this link…,Click this link…Click this link…); কিন্তু বারবারই যে অংশটা আমার মনোযোগের বাইরে ছিল – তা হল শরীর, শরীরের যত্ন – সুন্দর চরিত্র গঠনের জন্য শরীরের যত্নের প্রয়োজনিয়তা। আমার মা সারাজীবনই অভিযোগ করে এসেছেন আমার মত শরীরের হেলাফেলা করা মানুষ নাকি তিনি আর একটি দেখেন নি। সকালে না খেয়ে বের হয়ে যাওয়া, কাঠফাটা রোদ মাথায় নিয়ে শুধুশুধু ঘুরে বেড়ান, ফচফচে নাক নিয়ে ঝুপ করে বৃষ্টিতে ভেজা, সারারাত বাতি নিভিয়ে কম্পিউটারের মনিটরে তাকিয়ে থাকা – আর কত বলব? কেন জানিনা, নিজের যত্ন নেয়াটা আমার কাছে আদিখ্যেতা মনে হত। শরীরকে আদু আদু করাটা মনে হত বিলাসিতা।

মোখতার মাগরুবির এই টক শুনে নতুন করে শরীরটার কথা একটু মনে করলাম। মনে পড়ল, শেষ বিচারের দিনে আমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আমার বিরূদ্ধে নালিশ জানাবে, যে আমি তাদের প্রতি অন্যায় করেছি, তাদের দিয়ে আল্লাহর অপ্রিয় কাজ করিয়েছি। আমারই হাতের আঙুল কিনা বলবে আমি কী বোর্ডে অলস হাত বুলিয়েছি, যখন এতিম কারো মুখে ভাত তুলে দেয়ার কথা ছিল?

আমি জানিনা, নালিশ বলতে আমি দু’টো পক্ষ বুঝি, বাদী আর বিবাদী। এক পক্ষ অন্যায় করে, অপর পক্ষ সে অন্যায়ের বিরূদ্ধে নালিশ করে। আমার চোখ যখন বাদী হয়ে যাবে – তখন ত সে আর আমার না, সে ত ‘আমার’ চোখ না। সে একটা নিজস্ব এনটিটি, যার কিনা নিজের মত করে ন্যায় অন্যায় বোঝার ক্ষমতা আছে। এই চিন্তাটা হঠাৎ করেই আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। এভাবে এক এক করে আমি যদি চোখ, নাক, কান, মুখ, হাত, পা সবাইকে বাদ দিতে থাকি, তাহলে আমি আর ‘আমি’ রইলাম কই?

বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে? চোখটা বন্ধ করুন, করে নিজের শরীরের দিকে তাকান (মনে মনে); তারপর পা দুটো বাদ দিয়ে বাকি অংশটাকে নিজের মনে করুন, তারপর কোমরের নিচ থেকে সবটুকু বাদ দিয়ে বাকিটাকে নিজের মনে করুন… এভাবে সব বাদ দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত এসে দাঁড়াবে আমার মস্তিষ্কটুকু কেবল আমার, বাকি সব আল্লাহর থেকে বর্গা দেয়া কিছু কর্মচারি। ওহো! না না! মস্তিষ্কও ত বলে বসতে পারে, সে আমাকে মানুষের নামে খারাপ চিন্তা করতে বাধ্য করত… তাহলে আসলে কেবল মাত্র রয়ে যায় আমার স্বাধীন ইচ্ছা – যা কিনা আর সব… সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আমার স্বাধীন ইচ্ছার বিরূদ্ধে সাক্ষ্য দেবে আমার প্রত্যেকটা ইন্দ্রিয়, প্রত্যেকটা অঙ্গ – আমার আত্মা, আমার নফস … শেষ পর্যন্ত ভয় পেয়ে আবিষ্কার করলাম, যত বেশি দয়া, তত বেশি আমানত। আমি আমার পায়ের প্রতি ইহসান দেখাচ্ছি ত? কিডনীর প্রতি? মাথার চুলগুলোর প্রতি? আল্লাহ কি জানতে চাইবেন না, তোমাকে তাহলে দু’ দুটো ভাল কিডনী দেয়ার দরকার কী ছিল, যদি একুশ বছর বয়সেই সেগুলো ড্যামেজ করে বসে থাক?

এই প্রচন্ড ভয়ের অনুভূতিটা থেকে আমি ঠিক করলাম আল্লাহর এই আমানতগুলির যত্নআত্তি শুরু করব। কোন ফ্যাক্টরি যুগের পর যুগ এমনি এমনি চলে আসার পর হঠাৎ করে মেইনটেন্যান্সের প্রয়োজন পড়লে একটা প্রাথমিক সার্ভে করে নিতে হয়। তাই আমি ঠিক করলাম, ওদের সাথে কথা বলব। সত্যি সত্যি, একদিন ঘুমোতে যাওয়ার আগে চোখকে জিজ্ঞাসা করলাম, ও চোখ! তুমি কেমন আছ? চোখ ধমকের সুরে উত্তর দিল, ভাল থাকব কীভাবে? তুমি জীবনে আমাদের কোন যত্ন নাও? আমি মাথা চুলকে বললাম, কী মুশকিল! কেন কেন? চোখ ঠিক মধ্যবয়সী ঘেঁয়ো কুকুরের মত একঘেঁয়ে সুরে বলল, দুই বছর হয়ে যাচ্ছে একটা ভুল পাওয়ারের চশমা পরে কাটিয়ে দিচ্ছ, আমার লেন্স এডজাস্ট করতে কত কষ্ট হয় তা জান? তারপর কথা নাই বার্তা ল্যাব এ কাজ করার মধ্যে হাত না ধুয়ে চোখ রগড়ানো শুরু করলে, তোমার হাতে সেদিন কী রিএজেন্ট লেগে ছিল জান?

আমি ভয় পেয়ে স্যরি টরি বলে প্রতিজ্ঞা করলাম, এক সপ্তাহের মধ্যে চোখ দেখিয়ে নতুন চশমা নেব।

গেলাম দাঁতের কাছে। ভীষণ অভিমান করে দাঁত জানাল আমি নাকি ভুলেই যাই তাদের কোন রকমের চাহিদা থাকতে পারে। এমনি করে নাক, কান, ফুসফুস, হৃদপিন্ড, মস্তিষ্ক – সবার অভাব অভিযোগ শুনতে শুনতে আর নিজেকে গাল দিতে দিতে পৌঁছলাম পাকস্থলির কাছে। দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছিলুম, সে কী বিরাট অভিযোগের ডালি খুলে বসবে। তাই আর সেদিন সাহস করে পাকস্থলির সাথে কথা বলতে পারিনি।

এমনি করে বাকহীন, বুদ্ধিহীন যন্ত্রগুলোকে একটা বড় ফ্যাক্টরির কর্মচারি ভেবে কথা বলতে বলতে আমি যেন সত্যি চোখের সামনে এদের অর্গানাইজেশনটা দেখতে পাচ্ছিলাম। এরা প্রত্যেকে নিজেদের কাজ সম্পর্কে খুব ভাল ধারণা রাখে, এবং নিজেদের কাজ নিখুঁতভাবে করতে ওয়াদাবদ্ধ। একজনের কাজ ঠিকমত না হলে অন্যজনও একটু সমস্যায় পড়ে যায়, কিন্তু তাই বলে অন্যের কাজের উপর সর্দারি করেনা মোটেও। প্রত্যেকেই জানে, তারা সবাই মিলে একটা মহান লক্ষ্যের অংশীদার, তা হচ্ছে, ‘আমি’ নামক এই মাথামোটা মানুষটিকে কর্মক্ষম রাখা। তাই এদের একজন ছোটখাট বিগড়ে গেলেও অন্যান্য সব অঙ্গ তাদের দায়িত্ব আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে মহান লক্ষ্যটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।

ফ্যাক্টরির রুট লেভেলের প্রত্যেকটা কর্মচারিই তাদের দাবিদাওয়া গুলো বিভিন্ন ভাবে পেশ করে। কিন্তু মাথামোটা কর্মকর্তা অনেক সময় ওসব পাত্তা না দিয়েই তার পছন্দমত যা ইচ্ছে করে যায়। যেমন দশ বারো ঘন্টা শরীরে গ্লুকোজ না দিয়ে হঠাৎ করে একগাদা চকলেট খেয়ে ইনসুলিন কোম্পানিকে ঝামেলায় ফেলে দেয়। প্রচন্ড রোদ্দুরে মস্তিষ্কের তাপমাত্রা ঠিক রাখার জন্য যেটুকু পানি খাওয়া দরকার – সেটুকু না দিয়েই আশা করে মস্তিষ্ক বাবাজি ঠিকঠাক মত কাজ করবে। এ যেন স্বেচ্ছাচারি শাসকের যাচ্ছেতাই ফরমায়েশ! আমার অন্যায় অত্যাচার তাদের চোখে দেখতে গিয়ে আমারই উপর আমার রাগ ধরে যাচ্ছিল।

শুধু তাই নয়, এই অসম্ভব সিনসিয়ার, নিখুঁত, এত বড় একটা কর্মযজ্ঞ – কোন রকম বিশ্রাম না নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে – কী জন্য? কেবলমাত্র ‘আমি’, অর্থাৎ হাত পা চোখ কান সব বাদ দিয়ে যে একরত্তি আমি থাকি – সেই ‘আমি’র সব রকমের চাওয়া পূরণ করার জন্য। মনে হতেই মনে হয়, বাব্বাহ! আমি এত স্পেশাল? ঝানতাম নাহ! কিন্তু আত্মপ্রসাদের আনন্দটুকু থিতু হতে না হতেই নক নক করে মনের দরজায় টোকা মারে আরো একটি প্রশ্ন, কেন?

সত্যিই, কেন? আমার স্বাধীন ইচ্ছা, যে ইচ্ছা আমাকে আট ঘন্টা ঘুমাতে বাধা দেয়না, ঘন্টার পর ঘন্টা ওয়েবসাইটগুলোতে শপিং ডিল খুঁজে বেড়ানোর সময় বাধা দেয়না, ভাত খাওয়ার সময় একটা টিভি সিরিয়াল দেখতে হবেই, আমারো ত বিশ্রাম প্রয়োজন – এমন অজুহাতে কাজের অকাজের সব রকমের চাওয়া চাপিয়ে দেয় আমার আজ্ঞাবহ শরীরটার উপর – শেষ বিচারের দিনে তা ঠিকঠাক মত আমার চাওয়া পূরণ করবে ত? ভাবতে ভয় হয়।

মোকতার মাগরুবির সেই টক, আর উপরে লেখা হাদীসটা আমাকে খুব ভাল করে মনে করিয়ে দিয়েছে, এই পৃথিবীতে আমার সময় কেবলই কিছু কর্তব্যের সমষ্টি। আমি আমার কর্তব্যগুলো কত ভালভাবে পালন করতে পারি তা দিয়েই নির্ধারিত হবে আমার সাফল্য। এতদিন পর্যন্ত কর্তব্য বলতে ভাবতাম স্ত্রী হিসেবে কর্তব্য, কন্যা হিসেবে কর্তব্য. মুসলিম হিসেবে কর্তব্য। সেদিনের পর থেকে যোগ হয়েছে, রূহধারী দেহটার প্রতি কর্তব্যও।

উৎসর্গ: মেয়েদের শরীরচর্চার প্রয়োজন আছে কি নেই, বা থাকলেও এর ব্যপ্তি কতটুকু – তা নিয়ে চিন্তা করেন এমন সকল ব্লগার ভাই ও বোনেরা।

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে চিন্তাভাবনা, সচেতনতা-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

6 Responses to কর্তব্য – শরীরের প্রতি

  1. অনাবিল বলেছেনঃ

    একদম অন্যরকম ভাবনা, এমন করে ভাবতে শিখিনি আগে! খুব নাড়া খেলাম! আচ্ছা আপু, আমি মাঝে মাঝে ভাবি, এই জিনিসগুলো থেকে দূরে থাকি কিভাবে! কিভাবে এই জিনিসগুলো উপলব্দি করতে করতে এতো ব্যর্থ হই!
    খাওয়া-দাওয়া, নিজের যত্ন নেয়া, এই জিনিসগুলোতে আমিও খুব অনিয়ম করি, কিন্তু এতে যে কী ভুল করছি এখন বুঝতে পারলাম………।

    স্পিরিচুয়াল শাওয়ার…… নিজের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম………। অনেক অনেক ধন্যবাদ এতো চমৎকার একটা বিষয় তুলে ধরার জন্য।

  2. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    আপু আমার অবস্থাও Horrible! 🙁 এখন থেকে spiritual shower দিতে হবে প্রতিদিন ইনশাআল্লাহ :thinking:

  3. সামিরা বলেছেনঃ

    সবসময়ের মতই সুন্দর একটা লেখা আপু। অনেক দরকারি, কাজে লাগাতে পারবো আশা করি। 🙂

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।