“ভাত দে, মা!”
ছোট্ট দুরন্ত ছেলে সুমনের হাড্ডিসার দেহের দিকে বিতৃষ্ণার দৃষ্টিতে তাকালেন হাবিবা। ছেলের বারবার চিৎকারে অতিষ্ঠ মা হাবিবা ছুটে গিয়ে লাথি মারলেন ছেলের পেটে।
এত ছোট পেটের চাহিদা এত বেশি কেন তা হাবিবার মাথায় ঢোকে না।
কিশোরী একটি মেয়ে ক্রন্দনরত সুমনের হাত ধরে তাকে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসে। সুমনের বড় বোন।
ফেলানী নামের এ মেয়েটি জন্মের পর থেকেই কথা বলতে অক্ষম ।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তসংলগ্ন বাংলাদেশের শেষ প্রান্তে অবস্থিত গ্রামটিতে হাসান মিয়া সম্ভবত সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তার বাড়ি থেকে একটু দূরে গাছের ছায়ায় সুমনকে বসিয়ে ইশারায় চুপ করে বসতে বলে সন্তর্পণে বাড়িটির দিকে এগিয়ে যায় ফেলানী।
খাবার চুরি করতে গিয়ে ধরা খেল ফেলানী। উঠানে কান ধরে উঠবস করার পাশাপাশি চড়-থাপ্পড় চলল সমানে। কিন্তু একটা গোঙানিও পর্যন্ত বের হল না মেয়েটির মুখ থেকে।
পরদিন মেয়েটি আবার গেল খাবার চুরি করতে এবং ধরাও খেল! বেত্রাঘাতের মাত্রা বাড়লেও ফেলানী পুরো নিশ্চুপ।
তার পরেরদিন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল পুরোপুরি। শাস্তিটা অবশ্য পরিবর্তিত হল। লোহার শিক পুড়িয়ে দুপুরের তপ্ত সূর্যের নিচে যখন মেয়েটির চামড়ায় ছ্যাঁকা দেওয়া হচ্ছিল, মেয়েটি টুঁ শব্দটি করেনি।
এ ঘটনার পর ফেলানীর মা ভাবলেন, অনেক হয়েছে এ বোবা মেয়েকে নিয়ে। টানাটানির সংসারে এমন উটকো বোঝা বহন করা সম্ভব নয়। তিনদিন পর তাদের ঘরে ভাত রান্না হল। হাবিবা ভাত বেড়ে শুধু ফেলানীকে দিলেন। কিন্তু ক্ষুধার্ত দুরন্ত সুমন যে আড়ালে লুকিয়ে ছিল, তা কে জানত! বোবা বোনের ভাতের থালা ছিনিয়ে নিয়ে সে কী দৌড়!
হাবিবার চিৎকারে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত। সামলে নিয়ে সুমনকে খুঁজে বের করার জন্য দৌড় শুরু করতে করতে আর তাকে আশেপাশে খুঁজে পাওয়া গেল না। পুকুর পাড়ে একটা বড় গাছের কোটরের আড়ালে অনেকক্ষণ পর যখন তাকে খুঁজে পাওয়া গেল, সে বিষক্রিয়ায় নীল হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে।
প্রিয়পুত্রের মৃতদেহের উপর মূর্ছা গেলেন হাবিবা। ছোট ছেলে হিসেবে বড় বেশি ভালোবাসতেন তিনি সুমনকে। ফেলানী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল…চুপচাপ। তার কষ্টের সুপ্ত আগ্নেয়গিরির অভ্যন্তরে লাভা জমতে জমতে মাত্রা ছাড়িয়ে গেলেও সেটি সেদিনও নিশ্চুপ।
তিন বছর পর।
ফেলানীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। যৌতুক হিসেবে দরিদ্র পরিবারটির সহায় সম্পদের প্রায় অর্ধেকই যাবে। ফেলানীর বাবার শখ, মেয়েকে ভারতের শাড়ি পরিয়ে ওখান থেকেই সাজিয়ে আনবে। শাড়িটা খুব পছন্দ হল মেয়েটির…কথা তো বলতে পারেনা,কিন্তু লাল শাড়ি পরে ফেলানী যখন তার বাবার হাত ধরে ফিরে আসছিলো এদেশের দিকে, তার মুখে বিধাতা এক টুকরো হাসি ভিক্ষা দিয়েছিলেন- তিন বছর পর।
সূর্য ডুবে গিয়েছে।
লুকিয়ে সীমান্ত পারাপারের জন্য এ পথটা সবচেয়ে নিরাপদ- ফেলানীর বাবার বিশ বছরের অভিজ্ঞতা। তিনি পার হলেন, ফেলানী আসার পথে যেভাবে পার হয়েছিল ওভাবেই কাঁটাতার পার হতে গেল, কিন্তু তার শাড়ির কিছু অংশ আটকে গেল। ফেলানী এবং তার বাবার চেষ্টায় ছুটলো তো না-ই বরং আরো আটকে গেল।
হঠাৎ গুলির শব্দ!
ফেলানীর বাবার নিথর দেহ পড়ে রইল স্বাধীন বাংলাদেশের রক্ত দিয়ে কেনা মাটির প্রথম ৬ ফুটের মধ্যে।
বি এস এফ এর নিশানা খারাপ না!
আতঙ্কিত ফেলানী শাড়িটিকে ছুটাতে পারে না, আরো পেঁচিয়ে যায়। আবারো গুলি! ইচ্ছাকৃতভাবে হোক আর অনিচ্ছাকৃতভাবেই হোক, খানিকটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হল এবার।
ফেলানীর পায়ে বুলেট বিদ্ধ হয়।
মেয়েটি তাও চুপ!
আর গুলি হয় না। ফেলানী ঝুলে থাকে কাঁটাতারে।
রাত গভীর হয়।
মেয়েটির খুব পিপাসা পায়…একটু পানির জন্য পাগল হয়ে ওঠে মেয়েটি। বাক্ প্রতিবন্ধী মেয়েটির গলা থেকে এবার অমানুষিক আওয়াজ বেরিয়ে আসে।
এ যেন কোন ছোট্ট বাচ্চা প্রাণীর আতঙ্কিত চিৎকারের আওয়াজ- যার মা কে শিকারী এইমাত্র তার সামনে গুলি করে মেরেছে।
সেই অসহায়, নিঃসঙ্গ, ভূতুড়ে, করুণা জন্মদানকারী স্বরের তীব্রতা বাড়তে থাকে…দূরে দাঁড়ানো বি এস এফ সদস্যরা বুঝতে পারে তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে…অমানুষিক কষ্ট দেওয়া গেছে বাংলাদেশিটাকে! সীমান্তে বি এস এফ সদস্যদের অট্টহাসি এবং বাক্ প্রতিবন্ধী ফেলানীর পানির জন্য কাতর গোঙানির ভূতুড়ে শব্দের মিশ্রণের তীব্রতাকে ছাপিয়ে গর্জে ওঠে বন্দুক-শেষবারের মত।
ফেলানী লেখাপড়া জানতো না, কথাও বলতে পারত না। স্বাভাবিক নিয়ামানুসারে ফেলানীর ভূতও একই রকম হওয়ায় ফেলানীর হত্যাকাণ্ডে কোন হত্যা মামলা দায়ের এবং তার ফলস্বরূপ কোন অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড হয়নি। ফেলানীর শুভাকাঙ্ক্ষী যে ছিল না, তা নয়- পুরো একটা দেশভর্তি মানুষ ছিল, কিন্তু তারা সবাই প্রতিবন্ধী ছিল।
অন্তর প্রতিবন্ধী।
সাহস কিংবা আত্মমর্যাদা বলতে কোন জিনিস তাদের ভিতর ছিল না।
এ আপনি কি লিখলেন ? বুকের ভেতরটা তিরতির করে কাঁপছে, ঘৃণায় না যন্ত্রণায় জানিনা।
“ফেলানীর শুভাকাঙ্ক্ষী যে ছিল না, তা নয়- পুরো একটা দেশভর্তি মানুষ ছিল, কিন্তু তারা সবাই প্রতিবন্ধী ছিল।
অন্তর প্রতিবন্ধী।” এর চেয়ে সত্য বোধ হয় আর কিছু নেই।
আমিও সেই প্রতিবন্ধীদের একজন!
বলাই বাহুল্য আমিও … 🙁
🙁
“ফেলানী লেখাপড়া জানতো না, কথাও বলতে পারত না। স্বাভাবিক নিয়ামানুসারে ফেলানীর ভূতও একই রকম হওয়ায় ফেলানীর হত্যাকাণ্ডে কোন হত্যা মামলা দায়ের এবং তার ফলস্বরূপ কোন অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড হয়নি। ফেলানীর শুভাকাঙ্ক্ষী যে ছিল না, তা নয়- পুরো একটা দেশভর্তি মানুষ ছিল, কিন্তু তারা সবাই প্রতিবন্ধী ছিল।”
আমি নিজেও বোধহয় ঐ প্রতিবন্ধীদের দলে। মানুষ কত তাড়াতাড়ি ভুলে যায় সব!
কী আর করা! যখন একটা দেশভর্তি মানুষ সবাই প্রতিবন্ধী হয়, তখন দোষ দেবেন কাকে? কে ই বা দোষটা দেবে? ফেলানীর ভূতটাও বোধহয় বোবা, নাইলে হয়ত টিটকারি দিতে পারত!
অনেক দিন পর পেলাম লেখা! পরীক্ষা ছিল নাকি?
দারুণ গল্প।
প্রতিবন্ধী শব্দটা ব্যবহার করা উচিৎ না। আমরা ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষ বলি। এর চেয়ে অন্য কোন শব্দ ব্যবহার করা যায়। কাপুরুষ ছিল টাইপ।
প্যারার স্পেসিং এর ব্যাপারে নজর দেয়া দরকার। html মোডে গেলে ইজিলি এইটা ঠিক করা সম্ভব
পরীক্ষা দীর্ঘ সময় ধরে চলল!! :bigyawn:
ভিন্নভাবে সক্ষম শব্দদুটো বেশি মানানসই…এরপর থেকে ব্যবহার করব। 🙂
নিজেদের কাপুরুষ ভাবার চেয়ে ওটা ভাবা একটু স্বস্তিদায়ক… এজন্যই ব্যবহার করা..
স্পেসিং এর ব্যাপারটা আরেকটু বুঝিয়ে বললে ভাল হত,ভাইয়া!
অন্তর প্রতিবন্ধী।
এটাই সবচে’ সত্য কথা।
😐
A heart breaking story! Written with courage. Ian reminded again of the senseless cruelty of life as it is.
Keep writing.
ধন্যবাদ…ব্যাপারটা চিন্তা করার সময় যতটা বীভৎস লেগেছিল তার কতটুকু ফুটিয়ে তুলতে পেরেছি জানিনা…
অসাধারণ পিচ্চি! :beshikhushi:
তোর লেখার হাত আগের থেকে ভালো হচ্ছে দিন দিন।
‘প্রতিবন্ধী’ শব্দটা পরেরবার থেকে আর ব্যবহার করিস না। শব্দটা আমার পছন্দ না। এরচেয়ে ‘ভিন্নভাবে সক্ষম’ বা ‘বিকল্পভাবে সক্ষম’ ব্যবহার করতে পারিস। সম্ভব হলে এটাতেই এডিট করে ঠিক করে দিস।
লেখা চালু রাখিস।
তোর কাছ থেকে আমি কিন্তু আরও ভালো কিছু আশা করি।
চিন্তার বিষয়! এটাই বা কতটুকু ভালো হল বা আমার কাছ থেকে আরও ভালো কিছু প্রত্যাশার ব্যাপারটায় আমি দ্বিধান্বিত এবং চিন্তিত,পু! :thinking:
পরেরবার থেকে ভিন্নভাবে সক্ষম’ বা ‘বিকল্পভাবে সক্ষম’ ব্যবহার করব, আমার কাছেও বেশি মানানসই লেগেছে এ দুটো। এটাতে একটা কাঠামোতে লিখে ফেলেছি তো, ঠিক করতে গেলে ভজকট হয়ে যেতে পারে কিছু কাঠামো। তাই আর হাত দিলাম না এটাতে,পরেরবার থেকে অবশ্যই। 🙂
পড়ার জন্য ধন্যবাদ! :happy:
আমাকে ধন্যবাদ দিলে মাইর খাবি।
এটা দুর্দান্ত হয়েছে।
তোর কাছ থেকে এরকম দুর্দান্ত লেখা নিয়মিত চাই। এটাই বোঝাতে চেয়েছি।
চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
আমি জানি তুই পারবি। :beshikhushi:
ওয়াও! আপনি কত কিছু জানেন!! 8)
আমি খুশি! :happy: :love:
বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না…
:thinking:
দীর্ঘশ্বাস