আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অধীনে থাকা বাঙ্গালী সেনা তথা ইস্ট-বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবদান ছিল অবিস্মরণীয় । পূর্ব-পাকিস্তান বাঙালীদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রেক্ষিতে দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে গঠন করা হয় “ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট(EBR)”। উল্লেখ্য, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যান্য অনেক ভাগে বাঙ্গালী সেনারা থাকলেও বিপুল আকারে এবং সম্পূর্ণ বাঙ্গালিদের নিয়ে গঠিত পূর্ণ-শক্তির বাহিনী ছিল ইস্ট-বেঙ্গল রেজিমেন্ট। যদিও সত্তরের দিকে এই ইস্ট-বেঙ্গালের সেনাদের মধ্যে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের উপস্থিতি দেখে, তা রোধ করতে ফ্রন্টিয়ার-ফোর্সের কিছু সেনাকে আস্তে আস্তে ইস্ট-বেঙ্গলের সেনাদের সাথে মিশিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র শুরু হয়, যা কখনোই আলো দেখেনি পুরোপুরি। ((A witness to surrender))
পাঞ্জাব, বালুচ, বিহার জনগোষ্ঠীর সেনাসংখ্যা যতটা ছিল, তার তুলনায় বাঙ্গালী রেজিমেন্টের সংখ্যা ছিল একেবারেই অপ্রতুল। প্রথম দিকে শুধু একটি ব্যাটেলিয়ন থাকলেও পরবর্তীতে ব্যাটেলিয়ন সংখ্যা উন্নীত করা হয় আটে। ১ম ইস্ট বেঙ্গলকে বলা হত সিনিয়র টাইগার। বাছাই করা চৌকশ বাঙ্গালী সেনা এবং ওসমাণীর ছায়াতে থাকা এই রেজিমেন্ট অচিরেই পরিণত হয় পাকিস্তানের অন্যতম সেরা ব্যাটেলিয়নে। এই ব্যাটেলিয়নে যোগ দেওয়া যেকোনো বাঙ্গালীর জন্য ছিল গর্বের। অল্প দিন পরেই গঠিত হয় ২য় ইস্ট বেঙ্গল, দীর্ঘ ২২ বছর তাদের জুনিয়র টাইগার নাম নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এভাবে একে একে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙ্গালিদের নিয়ে আটটি রেজিমেন্ট গঠন করা হয়, যা পাকিস্তানের তখনকার ৪৪ টি রেজিমেন্টের মধ্য সংখ্যায় ছিল অতি নগণ্য, যদিও বাঙ্গালীরা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার বৃহদাংশ। পাকিস্তান আর্মিতে বাঙ্গালী সেনাদের উপহাসের দৃষ্টিতে দেখা হলেও এই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের 5th EBR – এর সাহসী সৈনিক এবং অফিসারেরা ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধে অনন্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করে এবং ভারতীয় বাহিনীর কাছ থেকে লাহোরকে রক্ষা করে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানী শাসন যন্ত্র যখন এদেশের নিরীহ বাঙ্গালীদের হত্যাযজ্ঞের নীল নকশার শুরু থেকেই বাংলাদেশ অবস্থানকারী এই রেজিমেন্টগুলোর বহু অফিসার পরিকল্পনা করছিলেন বিদ্রোহের। এখানে উল্লেখ্য,সামরিক আইনে বিদ্রোহের চেষ্টা, পরিকল্পনা মাত্র মৃত্যুদণ্ড যোগ্য অপরাধ। কিন্তু মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করেই অনেকে এগিয়ে গিয়েছিলেন তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে। পাকিস্তানের তৎকালীন মেজর সিদ্দিক সালিকের “Witness to surrender” বই থেকে জানা যায়, “বাঙ্গালী সেনারা ঊর্ধ্বতন অফিসারের সামরিক আনুগত্য অমান্য করবে, কিন্তু তবু নিজ জাত ভাইয়ের উপর গুলি চালাবে না।”
পাকিস্তানীরা আঁচ করতে পারে, বাঙালিদের উপর খড়গ নামালে সুশিক্ষিত এবং সুপ্রশিক্ষিত ইস্ট-বেঙ্গল রেজিমেন্টের দিক থেকে আসবে প্রথম প্রতিরোধ। একারণেই তারা মূলত কম্পু-সায়িন্সের কুইক-সর্টিং এর “ডিভাইড এণ্ড কনকোয়ার” পদ্ধতি ব্যবহার করে পুরো রেজিমেন্টকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদ্ধতিতে ভাগ করে পাঠিয়ে দেয় বিভিন্ন দিকে। কারণ পূর্ণ শক্তির একটি রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো অত্যন্ত দুঃসাধ্য।
অবশেষে ২৫শে মার্চের গণহত্যার পর ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ২৯ মার্চের মধ্যে বাংলাদেশে অবস্থান করা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ এবং অষ্টম রেজিমেন্টের একাংশ যথাক্রমে যশোর, জয়দেবপুর, রংপুর, কুমিল্লা এবং চট্টগ্রাম থেকে বিদ্রোহ শুরু করে। বাকী ব্যাটেলিয়নগুলো ছিল পাকিস্তানে।
অন্যান্য সব ব্যাটেলিয়ান সম্পূর্ণ সমরসজ্জায় থাকলেও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলকে ইতিমধ্য পাকিস্তানের খাড়িয়া সেনানিবাসে স্থানান্তরের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছিল, তাই এই ব্যাটেলিয়ানের সব ভারী অস্ত্র এবং অগ্রবর্তী একটি কোম্পানী বিদ্রোহের সময় অনুপস্থিত ছিল। সব মিলিয়ে পুরো ব্যাটেলিয়নের এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ, প্রায় তিনশ সৈন্য এবং প্রশিক্ষণের জন্য মাত্র ৩০০ টি থ্রি-নট-থ্রি গান ছিল। তা দিয়েই তারা বিদ্রোহ করে তাদের পাঞ্জাবী অধিনায়ক লে. কর্নেল জানজুয়াকে হত্যার মাধ্যমে। এই রেজিমেন্ট বিদ্রোহের পাশাপাশি কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র রক্ষা করেন এবং এই রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ২৭শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের মাধ্যমে জনগণকে এবং অন্যান্য বাঙালি সেনাদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে আরও উদ্বুদ্ধ করে। চট্টগ্রামে অবস্থিত ইবিআরসি তথা ইস্ট-বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রশিক্ষণ শিবিরে ছিল আরো ২,৫০০ বাঙ্গালী সৈণ্য। দূর্ভাগ্যক্রমে ৮ম ইস্ট বেঙ্গাল তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে ব্যর্থ হয় এবং সেই প্রশিক্ষণার্থী সৈন্যরা মুহুর্তেই ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায় পরিকল্পিত পাকিস্তানী আক্রমণে। ((লক্ষ্য প্রাণের বিনিময়ে – মেজর রফিক, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম – লে. কর্নেল আবু ওসমান, একাত্তর স্মরণে – ডাক্তার বেলায়েত, মেডিক্যাল অফিসার – জেড ফোর্স))
অন্যদিকে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের বাঙ্গালী অধিনায়ক রেজাউল জলিলের অসহযোগীতায় পাকিস্তানীদের অতর্কিত আক্রমণে অত্যন্ত মার খায় এই ব্যাটেলিয়ম, শহীদ হয় লেফট্যানেন্ট আনোয়ার, প্রাণ নিয়ে কোন রকমে বেঁচে আসেন ক্যাপ্টেন হাফিজ (পরবর্তীতে মেজর,রাজনীতিবিদ)। প্রথম ইস্ট-বেঙ্গল, যাদের উপর বাঙ্গালীদের আশা ছিল সবচেয়ে বেশী, দূর্ভাগ্যজনকভাবে সমোয়চিত সিদ্ধান্ত নিতে তারাই সবচেয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। ((রক্তভেজা একাত্তর – মেজর হাফিজ, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম))
২য় ইস্ট বেঙ্গালের বাঙ্গালী কর্নেল রাকীবের বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও মেজর শফিউল্লাহ এবং মেজর মইনের দূরদর্শীতায় এই ব্যাটেলিয়ন পূর্ণ সমরশক্তিতে বেরিয়ে আসতে পারে ক্যান্টনমেন্ট থেকে। ((এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য – মেজর জেনারেল মঈন)) এখানে আরো উল্লেখ করা যেতে পারে পাকিস্তান আর্মিতে তখন চলছিল বৃটিশ অস্ত্র থেকে চাইনিজ অস্ত্রে মাইগ্রেশান। অর্থাৎ, সব ব্যাটেলিয়ানের বৃটিশ অস্ত্র প্রতিস্থাপন করে দেওয়া হচ্ছিল আধুনিক চাইনিজ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। এমন প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে নিয়ম হলো, আগে নতুন অস্ত্র আসবে, তা দিয়ে প্রশিক্ষণ হবে, তারপর পুরোনো অস্ত্র ফেরত যাবে। কারণ যদি উল্টোটি করা হয় তবে একটি রেজিমেন্ট পুরোই নিরস্থ এবং অপ্রস্তুত অবস্থায় থেকে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তাই এই মাইগ্রেশানের সময় একটি ব্যাটেলিয়ানের কাছে যা প্রয়োজন তার থেকে দ্বিগুণ অস্ত্রের সম্ভার থাকে। আমাদের ২য় ইস্ট বেঙ্গালেও ফেব্রুয়ারীর শেষের দিকে সম্পন্ন হয় এই মাইগ্রেশান, কিন্তু মেজর মইনসহ অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের সুচতুরতার কারণে তারা পুরনো বৃটিশ অস্ত্র ফিরিয়ে দিতে গড়িমসি করতে থাকে এবং বিদ্রোহের সময় এই ব্যাটেলিয়ানের সৈন্যরা বিপুল পরিমাণে অস্ত্র নিয়ে বেড়িয়ে আসে। শুধু তাই নয়, বিদ্রোহের সময় তারা জয়দেবপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরী (সমরাস্ত্র কারখানা) আক্রমণ করে সেখান থেকে ছিনিয়ে আনে বহু অমুনিশান এবং অতিরিক্ত যেসব অস্ত্র তাদের বহনযোগ্য ছিল না সেগুলো তারা নষ্ট করে আসে। ((স্মৃতিচারণঃ মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া))
৩য় ইস্ট বেঙ্গলের অবস্থান ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে এবং এর কোম্পানিগুলোকে ছড়িয়ে দেয়া হয় সৈয়দপুর সেনানিবাসের বাইরে গোড়াঘাট ও পার্বতীপুর এলাকার আশেপাশে। ক্র্যাক-ডাউন শুরু হলে আলাদা আলাদা ভাবেই এই রেজিমেন্টের সেনারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিদ্রোহ করে অবস্থান নেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। ((উইকি))
৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল বা বেবী টাইগারকেও অনরূপ দুইভাগ করে ব্রিগেড মেজর খালেদ মোশারাফের নেতৃত্বে দুটো কোম্পানীকে নকশাল দমনের নাম করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মৌলভীবাজারের শমসেরনগরে এবং বাকী কোম্পানীগুলো ছিল ব্রাক্ষণবাড়ীয়াতে পাঞ্জাবী অধিনায়ক লে. কর্নেল খিজির হায়াতের অধীনে। কিন্তু সেখানে ছিলেন আরেক বাঙ্গালী মেজর শাফায়াত জামিল, খালেদের সুযোগ্য সহচর। কৌশলে তারা দু’জনেই বুঝে নিয়েছিলেন পাকিস্তানীদের কুমতলব এবং খালেদের নির্দেশে সাফায়াত জামিল বিদ্রোহ করে বন্দী করি পাকিস্তানী কর্নেল খিজির হায়াতকে এবং এভাবেই এই রেজিমেন্ট পূর্ণ শক্তিতে জড়িয়ে পড়ে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে। ((বার বার ফিরে যাই -মেজর আখতার, মুক্তির জন্য যুদ্ধ – শাফায়াত জামিল))
এই হলো মূলত আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহের ইতিহাস। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ৯ম, ১০ম এবং ১১তম ইস্ট বেঙ্গল গঠন করা হয়।
বিদ্রোহের পর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নিশ্চিত জীবন ছেড়ে দিয়ে পরিবার-পরিজনদের পাকিস্তানী বাহিনীর কব্জায় ফেলে এবং মাথার উপর মৃত্যু দণ্ডের খড়গ নিয়ে সেই সব বীর সেনা এবং অফিসাররা শুরু করেন অনিশ্চিত বাংলাদেশের স্বপ্নের উদ্দেশ্যে যাত্রা। এভাবেই শুরু। দেশের টানে, সব কিছু ফেলে শুরু হয় নয় মাসের সংগ্রাম। যেসব সৈনিক এবং অফিসার বিদ্রোহ করেছিলেন তারা শুধু নিজেদের প্রয়োজনীয় সামরিক সরঞ্জাম নিয়েই সেসময় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়েছিলেন। বাকী সব জিনিসপত্র তারা ফেলে আসেন এবং যা পরবর্তীতে পাকবাহিনীর সদস্যরা লুণ্ঠন করে। ফলে যারা সেদিন বিদ্রোহ করেছিলেন, যুদ্ধের পর আক্ষরিক অর্থে তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু পর্যন্ত ছিলনা।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে মাত্র নয়জন মেজর বিদ্রোহ করেন। পরবর্তীতে আরও তিনজন মেজর পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে যোগ দেন। একজন মেজর ছুটিতে থাকা অবস্থায় যুদ্ধে যোগদান করেন এবং এই তের জন মেজরের উপর ভিত্তি করেই একাত্তরের পুরো মুক্তির সংগ্রাম পরিচালিত হয় । প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে যে,অনেক উচ্চপদস্থ অফিসার বিদ্রোহে যোগদানের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেননি। আবার অনেকে সুযোগ সন্ধানী অফিসার মুক্তিযুদ্ধের একদম বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর ডিসেম্বর এর প্রথম দিকে পক্ষবদল করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। অন্যদিকে বিকল্প ধারার মেজর মান্নান, প্রাণ গ্রুপের প্রধান মেজর জেনারেল আমজাদের মত অনেকেই আবার প্রত্যক্ষভাবে বাঙ্গালিদের বিপক্ষে অস্ত্র ধরেন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হয়ে। ((মেজর মান্নানের তৎকালীন কর্মস্থল ৩ কমান্ডোর সিও পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার জেড এ খানের লেখা বই ‘দ্য ওয়ে ইট ওয়াজ’ – থেকে বিস্তারিত পাওয়া যায় মেজর মান্নান নিজ থেকে ভলান্টিয়ার হয়ে চট্টগ্রাম আক্রমণে, যেহেতু এলাকাটি তার চেনা। অর্থাৎ চট্টগ্রাম এলাকায় অবস্থিত ইপিআরের মেজর রফিক এবং অষ্টম ইস্ট-বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়ার বিরুদ্ধে তিনি অস্ত্র ধরেছিলেন। নিয়তির পরিহাসে এই মান্নানই পরবর্তীতে জিয়ার ক্যাবিনেটে মন্ত্রী হন। আর মেজর জেনারেল আমজাদ একাত্তরে ছিলেন রংপুর সেনানিবাসের ব্রিগেড মেজর, যিনি প্রত্যক্ষভাবে রংপুর অঞ্চলে ক্র্যাকডাউনের পরিকল্পনা করেন। সেনাবাহিনীতে সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে তার কুকীর্তি নিয়ে মুখে মুখে আলোচনা হলেও লিখিত কোন বিবরণ পাওয়া দুষ্কর। রংপুর ক্যান্টনমেন্টে আটক মেজর নাসির তার যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা গ্রন্থে “একজন মেজর” বলে এড়িয়ে গেছেন আমাজাদ খানের নাম। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার মেজর এ কে এম নুরুল আলম(অবঃ) বার্তাবাহককে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বিস্তারিত উল্লেখ করেন মেজর আমজাদের পাকিস্তানীদের পক্ষে কাজ করার কথা। ))
অনেক জুনিয়র অফিসার ক্যাপ্টেন, লেফটেনেন্ট , সেঃ লেফটেনেন্ট এবং সেই সাথে এনসিওরা নিজ উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দান করেন। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো অফিসারদের থেকে সাধারণ সৈনিকদেরই দেশের টানে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দানের জন্য বিদ্রোহ করার প্রবণতা সবচেয়ে বেশী দেখা যায়।
যুদ্ধের মাঝামাঝি এয়ারফোর্স থেকে মুক্তিযুদ্ধের সহ অধিনায়ক এ,কে,খন্দকার সহ আরো অনেক অফিসার মুক্তিযুদ্ধের সাথে যুক্ত হন। যাদের অনেককেই স্থলবাহিনীর অধিনায়কত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী প্রথম নয় জন মেজর সিনিয়োরেটির ভিত্তিতে হলেনঃ
#মেজর জিয়াঃ ৮ম বেঙ্গল।
#মেজর শফিউল্লাহঃ ২য় বেঙ্গল।
#মেজর মীর শওকত আলীঃ ৮ম বেঙ্গল।
#মেজর খালেদ মোশাররফঃ ৪র্থ বেঙ্গল।
#মেজর ওসমান চৌধুরীঃ ইপিআর।
#মেজর নাজমুল হকঃ আর্টিলারি ইপিআর(বর্তমানে বিডিআর থেকে বিজিবি)
#মেজর নুরুল ইসলামঃ ২য় বেঙ্গল।
#মেজর শাফায়াত জামিলঃ ৪র্থ বেঙ্গল।
#মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরীঃ ২য় বেঙ্গল।
এছাড়া আগস্ট মাসে আরো তিনজন মেজর পালিয়ে আসেন।তারা হলেনঃ
#মেজর মঞ্জুরঃ প্যারা কমান্ড ইউনিট।
#মেজর তাহেরঃ স্পেশাল কমান্ডো ইউনিট।
#মেজর জিয়াউদ্দীনঃ সামরিক গোয়েন্দা অধিদপ্তর।
এছাড়া ছুটিতে থাকা অবস্থায় যুদ্ধে যোগ দেন সিআরদত্ত তথা মেজর চিত্তরঞ্জন দাস। ((এক জেনারেলের নীরব স্বাক্ষ্য))
এই অফিসারগণই পরবর্তীতে সেক্টর কমাণ্ডার হিসেবে থেকে মুক্তিবাহিনীকে পুনর্গঠন,ট্রেনিং এবং তাদের পরিকল্পনা দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে হানাদারবদের কিলিং মেশিনে পরিণত করেন। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং সেই রেজিমেন্টের এসব বীর অফিসার এবং সৈনিকদের অবদান ভোলবার নয় মোটেও। বর্তমানে আমাদের সেনাবাহিনীতে রয়েছে প্রায় ৫০ টিরও অধিক বেঙ্গল রেজিমেন্ট রয়েছে যারা দেশ-বিদেশী পেশাগত দক্ষতার কারণে অর্জন করেছে আন্তর্জাতিক প্রশংসা।
নীচের দূর্লভ এই ছবিতে বাংলাদেশের সকল সেক্টর কমাণ্ডারদের সেনাপতি ওসমানীর সাথে সকল সেক্টর কমান্ডারদের দেখতে পাচ্ছেন। শুধুমাত্র মেজর তাহের এবং মেজর জলিল এই ছবিতে অনুপস্থিত।
***বাম থেকে ডানে বসাঃ
মেজর খালেদ মোশাররাফ,মেজর শওকত আলী,মেজর শফিউল্লাহ,মেজর সিআর দত্ত,প্রুপ ক্যাপ্টেন একে খোন্দকার,জেনারাল ওসমানী,উয়িং কমান্ডার খাদেমুল বাশার,মজুমদার(ভারতীয় বাহিনী),মেজর জিয়াউর রহমান,মেজর নুরুজ্জামান,মেজর মঞ্জুর
***বাম থেকে ডানে দাঁড়ানোঃ
ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দার,মেজর হাবিবুল্লাহ বাহার,ক্যাপ্টেন সালেক,মেজর ওসমান চৌধুরী,ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট হামিদুল্লাহ,মেজর রফিকুল ইসলাম, মেজর নুরুজ্জামান,লেঃকঃ শামসুল হক(মেডিক্যাল কোর)
নীচের ছবিতে দেখুন ইস্ট- বেঙ্গল রেজিমেন্টের মনোগ্রাম।
অসাধারণ, প্রিয়তে নিলাম,
:huzur:
ধইন্যা।
অসাধারণ একটা কাজ করেছেন। আপনার লেখাগুলোতে যেন আগুণ ঝরে। :dhisya: :dhisya: :dhisya: :dhisya:
আজকের এত কঠিন একটা বিষয়ে অত্যন্ত গোছানো ও ঝরঝরে আলোচনা। ধন্যবাদ দেবার ভাষা নেই।
লেখায় বিভিন্ন ধরনের তথ্যের সমাগম হয়েছে। বিশেষ করে, বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারন সম্পর্কিত যে বক্তব্য এসেছে, তার স্বপক্ষে সঠিক রেফারেন্স থাকা জরুরী। যেহেতু এগুলো ঐতিহাসিক দলিল, এগুলোর সাপোর্টে ভাল রেফারেন্স থাকলে উল্লেখ করলে ভাল হয়।
আপনার কাছে আরো লেখা চেয়ে বসে রইলাম অপেক্ষায় 🙂
সহমত। ভাইয়া আপনিও বানানটা একটু খেয়াল রাখবেন। “আগুন”, “বাঙ্গালি”, “অস্ত্রধারণ”, “সপক্ষে”, “জরুরি” । 😀
ধন্যবাদ। এবং ভয় পেলাম।
ভয় পেলে হবে কি করে… :nono: একটু খেয়াল করলেই পারবেন। 😀
যাক, অবশেষে আমার আর সামিরার কষ্ট কমাতে ব্লগে আরেকজনের অভিষেক ঘটল। এখন আর প্রুফ দেখার মত করে আমাদের পোস্ট পড়তে হবে না। :happy:
তবে মাধবীলতা, অন্যকে বানান শুধরে দিতে গিয়ে নিজেই বানান ভুল করে বসে থাকলে কি হবে? 😛
এই বিষয়ে আরেকটু জানা থাকলে ভালো। আপনি আপনার সুবিধামত সময়ে সরবের ‘বানান বিভ্রাট’ পেইজটি ঘুরে আসবেন প্লিজ।
যতই হোক, আপনি পারফেক্ট হলে আমাদেরই লাভ। অন্তত কাউকে কাউকে তো ঠিক করাতে পারলাম, সরবও অপেক্ষাকৃত ভালো একজনকে সাথে পেল।
এটাও তো কম নয়। 🙂
এই লাইনটি পড়ে যুক্ত করায় রেফারেন্স দিতে ভুলে গিয়েছি। এডিট করে দেওয়া হচ্ছে।
অসাধারণ। আমিও প্রিয়তে নিলাম।
বিকল্প ধারার মেজর মান্নান, প্রাণ গ্রুপের প্রধান মেজর জেনারেল আমজাদের মত অনেকেই আবার প্রত্যক্ষভাবে বাঙ্গালিদের বিপক্ষে অস্ত্র ধরেন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হয়ে।
জানতামও না!
বই নাম [ ] এর বদলে (( )) এই রকম ভাবে দিলে [১] [২] আকারে আসবে।
এইখানে আছে।
http://shorob.com/%E0%A6%9F%E0%A6%BF%E0%A6%89%E0%A6%9F%E0%A7%8B%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%BE%E0%A6%B2/
প্রিয়তে নেওয়াতে প্রীত হলাম। 😀
রেফারেন্সিং এর সিস্টেমটা দারুণ।
যুদ্ধ সম্পর্কে এরকম তথ্যবহুল লেখা ছড়িয়ে দিতে হবে। ইতিহাস জানার পাশাপাশি দেশের সঙ্গীন মুহূর্তে এই নির্ভীক মানুষগুলোর কীর্তি নিয়ে আসুক নবজাগরণ।
একটু অফটপিকঃ বানানে একটু খেয়াল রাখুন ভাইয়া। বাঙ্গালি আর বাঙ্গালী দুটোই ব্যবহার করেছেন। প্রথমটি সঠিক আমার জানামতে। আরও কিছু টুকটাক “মৃত্যুভয়”, “বেরিয়ে”,”দুর্ভাগ্যক্রমে”…
আরও লেখা চাই এমন। শুভকামনা রইল। 🙂
অসংখ্য ধন্যবাদ। দূর্ভাগ্যক্রমে আমার সরবে প্রতিটি লেখা দেওয়া হয় খুব দ্রুততার সাথে, স্পেল চেকার ব্যবহারেরও অবকাশ ক্ষেত্রবিশেষে হয়ে ওঠে না।
“বিকল্প ধারার মেজর মান্নান, প্রাণ গ্রুপের প্রধান মেজর জেনারেল আমজাদের মত অনেকেই আবার প্রত্যক্ষভাবে বাঙ্গালিদের বিপক্ষে অস্ত্র ধরেন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হয়ে।”
-এ সম্পর্কে জানতে চাই বিস্তারিত রেফারেন্স সহ
নিচে রেফারেন্স যুক্ত করা হয়েছে।
তথ্যবহুল একটা লেখা। সবার জন্যই অনেক কাজে দেবে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের জন্য এই লেখাগুলো খুবই দরকারি। :huzur:
ধন্যবাদ। 🙂
খুব দরকারী একটা লিখা!
কিছু জিনিস জানাই ছিলো না………
“বিকল্প ধারার মেজর মান্নান, প্রাণ গ্রুপের প্রধান মেজর জেনারেল আমজাদের মত অনেকেই আবার প্রত্যক্ষভাবে বাঙ্গালিদের বিপক্ষে অস্ত্র ধরেন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হয়ে।”
এটা নিয়ে আরো বিশদ জানতে চাই………
নিচে রেফারেন্স সেকশানে বিস্তারিত দেখুন। এরকম অনেক ব্যক্তিই আমাদের মাঝে লুকিয়ে আছেন যারা প্রত্যক্ষ সহায়তা করেছেন পাকিস্তানীদের, কিন্তু ভোল পাল্টিয়েছেন পরবর্তীতে। যুদ্ধের রাও ফরমান আলীকে নিয়মিত বাংলা শেখাতেন এক প্রফেসার সাহেব, অথচ দেশ স্বাধীন হবার পর তিনিও ভোল পালটে লিখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের উপর বই। ২০০৬ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়কালে একজন পুলিশ প্রধানকে নির্বাচন কমিশানের সদস্য নিয়োগ দেবার জন্য মনোনীত করেছিল তৎকালীন সরকারী দল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে লড়া এক ক্যাপ্টেন এবং ১৬ই ডিসেম্বার পাকিস্তানীদের সাথেই তিনি আত্মসমর্পণ করেন। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পরিবর্তিত রাজনৈতিক তিনি দেশে ফিরে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন এবং এক সময় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গুরত্বপূর্ণ পদ পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব পর্যন্ত পালন করেন। শাক আজিজুদ্দিন এবং আবদূর রহমান বিশ্বাসের মত দালালদের সাথে তো পরিচয় করিয়ে দেবার নেই নতুন করে। আসলে সব সম্ভবের দেশ এই বাংলাদেশ।
ধন্যবাদ…..শেষ লাইনটা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেলো…………
হুমম…এ ব্যাপারটা নিয়ে বিশদ জানা দরকার। বিশেষত, মেজর মান্নান আমার এলাকা থকে সংসদ সদস্যপ্রার্থী হয়ে থাকেন…
রেফারেন্স সেকশান দ্রষ্টব্য।
অসম্ভব গোছানো একটা লেখা।
প্রিয়তে নেয়ার মত, তাই দেরি না করে প্রিয়তে নিয়ে নিলাম চটপট।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যতটুকু জানি, তাতে ওসমানীর যুদ্ধ পদ্ধতির সাথে বেশ কয়েজন সেক্টর কমান্ডারের যুদ্ধ পদ্ধতির মিল ছিল না; যেমন, মেজর তাহের, মেজর জিয়া। কিন্তু মেজর জিয়া কখনোই ওসমানীর রেগুলার ব্রিগেডের মাধ্যমে যুদ্ধ পদ্ধতির সরাসরি বিরোধিতা করেন নি। এক্ষেত্রে মেজর তাহেরের সাথে ওসমানীর একটা মনোমালিন্য শুরু থেকেই ছিল। সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে যুদ্ধ পরিচালনা করায় মেজর তাহের পারদর্শিতা দেখালেও সেই পদ্ধতি অন্য সেক্টরগুলোতে তাৎক্ষণিকভাবে চালু হয় নি। ছবিটা স্বাধীনতার পরে তোলা হলে, মেজর তাহেরের চিকিৎসার প্রয়োজনে স্বাধীন বাংলাদেশে আসতে দেরি হওয়াটা ছবিতে তাঁর অনুপস্থিতির একটা কারণ হতে পারে।
আর সেটা না হলে, ওসমানীর সাথে তাঁর মতপার্থক্যই সম্ভবত এর অন্যতম কারণ।
অসাধারণ তথ্যবহুল ও গোছানো লেখা…অনেক না জানা তথ্য জানা হলো…
অসংখ্য ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়বার জন্য। 🙂