কনফিউজড, কী করি?

যে বিষয়টা নিয়ে লিখতে শুরু করেছি তা নিয়ে লেখা আমাকে একেবারেই সাজে না। খুব ছোট বিষয়েও আমি এত বেশি চিন্তাভাবনা করা শুরু করে দেই যে মূল উদ্দেশ্য থেকে বেশ দূরে সরে আসি। এই যেমন, কয়েকদিন আগে আমার একটা বেশ কঠিন প্রেজেন্টেশন ছিল। প্রায় দেড় মাস ধরে এর জন্য দিন গুনছিলাম। একাডেমিক এসব টকগুলোতে মোটামুটি ফরমাল কাপড় পরে টক দিতে হয়। আমি সাধারণত এই ব্যাপারগুলো একেবারেই মাথায় রাখি না। কিন্তু এটা বড় পরীক্ষা হওয়ায় যেই না একটু মাথায় আনলাম, ওমা! একেবারে সিন্দাবাদের ভূত এর মত রাজ্যের চিন্তা ঘাড়ে চেপে বসল। ফরমাল কী? ফরমালিটির এ মাপকাঠি কে ঠিক করেছে? আমার প্রেজেন্টেশনে ওরা যাচাই করবে আমি কতটুকু জানি, কী পরলাম তাই নিয়ে গাত্রদাহের প্রয়োজন টা কী? আমি একটু কিছু পরে আমাকে খারাপ না দেখালেই ত হল। ওদের চোখে ফরমাল না ইনফরমাল তা দিয়ে কী এসে যায়? ইত্যাদি ইত্যাদি…

ত যা হয়, এত রকমের চিন্তায় খেই হারিয়ে ছোট বিষয়ও অনেক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তবে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে একটা বিষয় আমার ভালভাবে শেখা হয়ে গেছে – কীভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। খুবই সহজ একটা উপলব্ধি, পাঠকদের প্রত্যেকে আশা করি সিদ্ধান্ত নিতে সিদ্ধহস্ত, তবু লিখছি। শার্লক হোমস তার রহস্যের সমাধান নিজে নিজে করলেও ওয়াটসন কে তার এত প্রয়োজন ছিল কেন জানেন? ওয়াটসনকে বুঝিয়ে বলার জন্য হোমস কে ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করতে হত। যে কোন জটিল বিষয়ই ছোট ছোট ভাগ করে নিলে সমাধান করাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। সিদ্ধান্ত নেয়ার এই প্রক্রিয়াটা তাই লিখছি, যাতে আমরা প্রত্যেকেই নিজের সাথে ঝালাই করে নিতে পারি।

ফিরে যাই আবারো সেই কাপড়ের বিষয়ে। যেহেতু ফরমাল বলতে কী বুঝায় সেটা নিয়েই একটু সন্দেহ ছিল, নেট এ একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে বুঝলাম এর কোন ধরে দেয়া মানদণ্ড নেই। যে ক’টা উদাহরণ পেলাম, তার কোনটাই আমার জন্য খাটে না। তবে ধরণ দেখে মোটামুটি একটা আন্দাজ পেয়ে আমার নিজের যে কাপড়গুলো ছিল সেগুলো দিয়ে ট্রায়াল দিলাম। দেখে শুনে দুই তিনটা বাছাই করে রাখলাম। তারপর আমার বেচারা বান্ধবীদের মতামত জানতে চাইলাম, কারো পছন্দ কারো সাথে মিলল না। বুঝলাম, এর যে কোনটাই মোটামুটি উতরে যাওয়ার যোগ্যতা রাখে।

এই ঘটনাটায় সিদ্ধান্ত নেয়ার দু’টো গুরূত্বপূর্ণ ধাপ মেনে চলা হয়েছে। যে কোন সমস্যায় প্রথম কাজ হচ্ছে সেটা নিয়ে নিজে ব্রেইনস্টর্ম করা। সরাসরি সিদ্ধান্তে চলে না গিয়ে মোটামুটি সমস্যাটা কী, কেন হচ্ছে, আমার জানায় কোন গ্যাপ আছে কি না, এ ধরণের সমস্যায় অন্যরা কী করে – এ সব গুলো বিষয়ে একটা মোটামুটি হোমওয়ার্ক করে রাখলে সুবিধা হয়। তারপর যা যা জানলাম, তার উপর ভিত্তি করে কিছু সম্ভাব্য অগ্রগতি চিন্তা করে রাখা যায়, এই ধাপে ‘কী’ ফলাফল ঠিক করলাম সেটা গুরূত্বপূর্ণ না, গুরূত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘কেন’ আমি এই ফলাফল টা পছন্দ করলাম। এই যেমন জামাগুলোর ক্ষেত্রে কোনটাই আমি শেষ পর্যন্ত পরি নি, কিন্তু রং, ফিটিং, প্যাটার্ণ – সবকিছু নিয়েই কিছুটা সময় বাছ বিচার করেছি।

নিজে নিজে হোমওয়ার্ক শেষে বিষয়টা নিয়ে অন্যদের সাথে আলাপ করেছি। এই ধাপটা খুবই, খুবই গুরূত্বপূর্ণ, কেন একটু পরে বলছি। আলাপ করাতে কী হল, একেকজন একেকটার পক্ষে রায় দিল। এতে করে আমার বিচারটা যে মোটামুটি ঠিক আছে সে আত্মবিশ্বাসটা পেলাম। কাপড় না হয়ে বিষয়টা যদি আরো গুরুতর হত (এই যেমন সুপারভাইজরের সাথে সমস্যা), তখন আমার আগে থেকে করা হোমওয়ার্কের ভিত্তিতে তা নিয়ে আরো বিশদ আলোচনা করা যেত। এতে করে শুধু যে আরো শক্তপোক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া যেত তাই না, সে মানুষটার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কেও আরো ভাল জানা যেত। মেডিটেশন কোর্সে একটা কথা বারবার বলত, ‘পয়েন্ট অব রেফারেন্স’ বাড়াতে হবে। একটা নতুন মানুষের সমস্যাকে সমাধান করার ধরণ একটা নতুন পয়েন্ট অব রেফারেন্স। কে জানে, ভবিষ্যৎ জীবনে কোন একটা পর্যায়ে গিয়ে হয়ত আমি তার মত করে সমস্যাগুলো কে দেখতে চাইব!

এছাড়া এর কিছু সেকেন্ডারি সুবিধা আছে। মতামত চাওয়া মানেই একজনের বিচার বুদ্ধির প্রতি সম্মান প্রদর্শন। আমি ব্যাপারটা মনে না রাখলেও অপরজন এটা মনে রাখবে বহুদিন। সম্মান, নির্ভরতা – ব্যাপারগুলো এমনই, হৃদ্যতা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। তাছাড়া পুরো বিষয়টিতে আন্তরিকভাবে একজনকে অংশীদার করে নিলে তার দোয়ারও অংশীদার হয়ে যেতে পারি।

আলোচনায় প্রত্যেকে একটা করে মতামত দেবে। কেউ কেউ তার মতের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জোরালো হবে। এদের মধ্যে কারও কারও প্রভাব আমার উপর অত্যন্ত প্রবল (যেমন আমার পরিবারের মানুষগুলো), হয়ত আমি একজন সফল মানুষ হিসেবে তার মত হতে চাই, বা তাকে এত ভালবাসি যে তার কোন কথা সমালোচনা করতে আমি প্রস্তুত নই। তখন আমি কী করব? আর কিছু কানে না নিয়ে সে যা বলল, অন্ধভাবে পালন করব। না! কোনভাবেই না। যে যাই বলুক, নিজে বিবেচনা না করে কোন কাজ করা যাবে না। সূরা ত্বীন এ আল্লাহ বলেছেন,

নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সর্বোৎকৃষ্ট রূপে তৈরি করেছি

সর্বোৎকৃষ্ট কেন জানেন? সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীন ক্ষমতা আর কারো নেই (জ্বীন ছাড়া); এই আয়াতে ‘ইনসান’ শব্দ টা একবচন, তার মানে এটা আমার পরিবারের মানুষগুলোর জন্য যতটা সত্যি, আমার জন্যেও ততটা সত্যি। অন্ধভাবে কোন পথ বেছে নেয়ার পথ আমাদের জন্য আল্লাহ বন্ধ করে দিয়েছেন।

And We have certainly honored the children of Adam.. (17:70)

এই honor বা dignity কোথা থেকে আসছে? আল্লাহরই দেয়া বিবেক বোধ ও স্বাধীন বিবেচনা বোধ থেকে। আমি কাউকে যতই ভালবাসি, তাকে অনুসরণ করার আগে আমি যেন আমার বিচার বিবেচনায় নিশ্চিত হয়ে নেই যে আমি ঠিক।

যাই হোক। অন্যদের মতামত চাওয়ার পর আমার অনেকগুলো পয়েন্ট অব রেফারেন্স থাকবে। তারা কেন এ মতামত দিল তাও জানা হবে। তখন তৃতীয় ধাপ হচ্ছে আবারও চিন্তা করা, নিজে নিজে। আমার আগের চিন্তার সাথে এখনের চিন্তার পার্থক্য কী? আগে একটা বিস্তৃত ভাসাভাসা ধারণা ছিল, এখন সমমনা/অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে পক্ষে বিপক্ষে আরো খুঁটিনাটি জানা গেছে। এখন ইনশাআল্লাহ, আমি যা সিদ্ধান্ত নেব তা খারাপ হবে না। এই যে একটা ছোট্ট ইনশাআল্লাহ, এরও খুব প্রয়োজন আছে। সব কিছুর পরেও, আমরা মানুষ হিসেবে আমাদের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পারিনা। আমি আমার সীমিত ক্ষমতায় যা কিছু করা সম্ভব, সব করেছি, সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কিন্তু আগামী একশ বছরের পরিপ্রেক্ষিতে এই কাজের কী প্রভাব পড়বে আমি জানি না। একশ কেন, কিছুক্ষণ পরেও কী হবে আমি জানি না। সুতরাং, আমাদের সীমাবদ্ধতাকে মনে রেখেই আল্লাহর উপর নির্ভর করে আমি আমার সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। আশা করি আল্লাহ আমার সহায় হবেন।

সিদ্ধান্তের চতুর্থ বা সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে ইস্তিখারা। আমি দুই রাকআত নফল নামায পড়ব, নামাযে দু’আ করব, যদি আমার দ্বীন ও দুনিয়ার জন্য এটি ভাল হয়, তাহলে এটি আমার জন্য সহজ করে দাও, নয়ত আমাকে এর থেকে দূরে সরিয়ে দাও। ইস্তিখারা এমন না যে সমস্যায় পড়লেই নামায পড়ে স্বপ্নের তালাশ করব। নামাযের আগে/পাশাপাশি এই ধাপগুলো পার হতে হবে।

ইস্তিখারার দু’টো প্রচলিত ভুল ধারণা আছে –

ইস্তিখারার উত্তর স্বপ্নেই দেখা যাবে: সব সময় না। ইস্তিখারার দুয়ায় আল্লাহর কাছে আমরা চাই যেন সর্বাঙ্গীন মঙ্গলময় একটা পথ আমরা বেছে নিতে পারি। আমার এক বান্ধবী তার প্রিয় মানুষটিকে বিয়ে করার জন্য ইস্তিখারা করে স্বপ্ন দেখে যে তাদের বিয়ে হবে না। হয়ও নি। আরেক বান্ধবী ইস্তিখারা করল অনেকবার। কিছুই দেখল না স্বপ্নে। কিন্তু ধীরে ধীরে তার পছন্দের মানুষটি এমনিতেই অনেক দূরে চলে গেল। আমার বেলায় ইস্তিখারায় আমি খুব সুন্দর একটা স্বপ্নের মাধ্যমে আল্লাহর সম্মতি পাই। সে গল্প নাহয় আরেকদিন করব।

ইস্তিখারা থেকে কোন উত্তর না পেলে, বা নিজের সিদ্ধান্তে খুব নিশ্চিন্ত না বোধ করলে ইস্তিখারা আবারো করতে পারেন। ইস্তিখারার কোন সর্বোচ্চ সীমা নেই। আর স্পষ্ট হ্যা বা না নিশ্চিত না হলে কাজ থামিয়ে রাখতে হবে, এমনও কোন কথা নেই। ইস্তিখারা এক অর্থে আল্লাহর অনুমতি চাওয়া।

আমাদের দেশে পীর, আলেম, ইমামদের দিয়ে ইস্তিখারা করানোর প্রচলন আছে। ভাবনাটা এমন, আমি ত অত প্র্যাকটিস করি না, আমার ইস্তিখারা বোধহয় হবে না। তার চেয়ে যে ভাল নামায রোজা করে, তাকে দিয়ে করালে ঠিকঠাক মত হবে। এটা খুব ভুল ধারণা। আল্লাহর সাথে কথাবার্তায় কোন মাধ্যম নিলে তাতে বড়সর ভুল হয়ে যাবে। আল্লাহ ত এমনিতেই জানেন আমরা কে কেমন। যদি এমন মনে হয় যে আল্লাহ ভাববে, ‘এতদিন খোঁজ নেই, এখন দরকারে আমাকে ডাকছে’ – ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও তা না। ফাঁকিবাজ স্টুডেন্ট পরীক্ষার আগে সিরিয়াস হয়ে গেলে টীচাররা আরো খুশি হন, সাহায্য করতে আরো আগ্রহী হন। আমরাই ভয়ে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে চাই না, শয়তান মনের মধ্যে হীনমন্ন্যতা ঢুকিয়ে দেয়, ‘ছিঃ তোমার লজ্জাও নেই, কোন মুখে দাঁড়াও তুমি আল্লাহর সামনে?’ তখন যতবার নামায মিস দিয়েছি, সব মনে পড়বে, মুভি দেখা, গালি দেয়া – সব মনে আসতে শুরু করবে। আসুক! তবু দাঁড়াই। মনে মনে বলি, আল্লাহ, তুমি ত জানই আমি কেমন, তোমার ইবাদতটাও ঠিক মত করি না। কিন্তু তারপরেও তুমি ছাড়া আমার কোন উপায় নেই। তুমি পথ না দেখালে, সাহায্য না করলে আমি আরো ভুলের মধ্যে তলিয়ে যাব। দেখ, শয়তান আমাকে কীভাবে ডাকছে! আমার উপর রাগ হয়ে থেক না আল্লাহ প্লীজ!

ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ আমাদের সিদ্ধান্তে তাঁর রাহমাহ ও জ্ঞানের পরশ বুলিয়ে দেবেন।

http://www.youtube.com/watch?v=EEcovFTsQ4E

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

8 Responses to কনফিউজড, কী করি?

  1. সামিরা বলেছেনঃ

    আমি নিজেও খুবই কনফিউজড মানুষ, ছোটখাটো যে কোন ব্যাপারেই।
    সুন্দর আর উপকারি লেখা আপু। এটাও আগেই পড়ে ফেলেছি! 😀

  2. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সর্বোৎকৃষ্ট রূপে তৈরি করেছি
    – এইটার সাথে যে ফ্রি উইল এর সম্পর্ক সেটা কেন বলছেন?
    অনেকে তো মনে হয় শারীরিক গঠন এর দিক এর কথা উল্লেখ করে।

    [যদিও আমার মনে হচ্ছে আপনি ঠিক এখানে।]

    • নূসরাত রহমান বলেছেনঃ

      ei ayat ta kano jani ami shob kichhutei proyog korar cheshta kori. adam (a) er creation er kotha mone korun, jekhane Allah kina bolechhen ami manush k amar kholifa hishebe protishta korbo. manush ki Allahr kholifa by the shape? nishchoy na! infact, onno prani der shathe melale shobar age amar etai mone hoy, physically, physiologically ato mil thakar poreo amra manushera koto strikingly different!

      ei difference ta eshechhe amader gyan, chinta korar khomota, o decision neyar shadhinota theke. plus amader manushder creativity o arekta bapar, jar kono tulona hoyna.

      ei ayat ta mone korle amar kebol mone hoy, ‘amar na jani koto shombhabona achhe, which are yet to explore!’

  3. অনাবিল বলেছেনঃ

    এই লিখাটা আপু আমারো আগেই পড়া আর আপনার লিখাগুলোর মাঝে এটা আমার অন্যতম প্রিয়, লিখাটা আমি মাঝে মাঝেই পড়ি… রিচার্জিং মনে হয়…।

    আমারো মনে হয়– আমার অনেক সম্ভাবনা আছে হুইচ আর ইয়েট টু এক্সপ্লোর……। অনেক ইন্সপারার্ড হই……:happy: :love:

  4. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    অনেক দরকারি পোস্ট ! আপু জাযাকাল্লাহু খাইরান 🙂

  5. গাঙচিল বলেছেনঃ

    খুব চমতকার গুছিয়ে আলোচনা করেছে আপু। জাযাকাল্লাহ খাইরান। :love:

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।