পল্লীকবি জসীম উদ্দিনের লেখা এই বইটি ভ্রমণ কাহিনী ভিত্তিক। দেশ কাল জাতির সীমানা ভুলে যারা মানুষকে চিনতে চায় ভালবাসতে চায় তাদের জন্য মূলত বইটি।তাই বইয়ের ভুমিকায় কবির মতামতঃ”মানুষকে যাঁহারা ভালোবাসেন,পরিচয়ের সীমার বাহিরে শত শত মানুষের সঙ্গে যাঁহারা মনের মিতালী গড়িতে চান আমার এই পুস্তক পড়িয়া তাহাঁরা কিছুটা মনের তৃপ্তি পাইবেন।“
পল্লীকবির চোখ দিয়ে দেখা হয়ে যায় পঞ্চাশের দশকের মার্কিন মুল্লক-পাতাল পুরীর দেশ, শেক্সপিয়ার,শেলি কিটসের দেশ লন্ডন,জাজিরাতুল আরব-রসূলের দেশ ও তৎকালীন পাকিস্তান।প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে ভরপুর ছোট দেশ বাহরাইনে আরব বাসীদের দুঃখ দুর্দশার চিত্রও ফুটে উঠে।
লন্ডনে টেনিসন পত্নীর সন্তান লালন পালন পদ্ধতি ও আমাদের দেশের নারীদের এ ক্ষেত্রে অসচেতনতা আমাদের সজাগ করে তোলেঃ
”শিশু লালন পালনের সব কিছু না জানিয়া আমরা শিশুর মা হই না।ম্যাগেট হাসিয়া উত্তর করিলেন।“
পথিমধ্যে মিসেস মিলফোর্ড,কুমারী আগাথা হেরিসন,চার্লি সিগার,এলেন লুমাক্স,সেই বৃদ্ধ দম্পতি,এজরা পাউন্ড,মিস এলিজাবেথ,হাজি সাহেব কিনবা সেই সাধারণ হকারকে আত্মীয়ার মত মনে হবে।
ট্রেনে একজন মা তার ছেলেকে বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত নিত্য নতুন সৃষ্টি সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি করাতে দেখে কবির অত্যুক্তিঃ“একটি জাগ্রত জাত কিভাবে তার ভবিষ্যৎ বংশধরকে জগতের বিভিন্ন সমস্যার সামনে দাঁড় করাইবার জন্য আগে হইতেই প্রস্তুত করাইয়া লইতেছে,তারই সামান্য কিছু আভাস পাইলাম এই মা ও ছেলের মধ্যে।“
সেই গায়ক দুখাই খন্দকারের মেয়ে- যার গান গান নয় যেন কিন্নরী কণ্ঠের করুণ কান্না,যার গান শুনে সাত সাগরের কান্না কবির দুচোখ বেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়েছে,আরব্য রজনীর হাজার এক রাত্রির একটি শ্রেষ্ঠ রাত্রির মত করে পাঠকের মনও পেতে চাইবে অমন একটি রাত।
“সোনা বন্ধু রে!তোর সাথে মোর ভাব রাখা দায়
তোর সাথে মোর প্রেম রাখা দায়।
সোনা বন্ধু রে! তোর সাথে মোর ভাব রাখা দায়
ও বন্ধু রে!…………”
কবি লোক সাহিত্য বিষয়ক আমাদের দেশের উদাসীনতা বরাবরের মত আঙ্গুল তুলে দেখান,অস্তিতের শেকড় সম্পর্কে ভাবিয়ে তুলেন,আমরা কতটা সচেতন আমাদের সাহিত্য শক্তি নিয়ে?“ফুলের বাগান করিতে গেলে উপযুক্ত মালির প্রয়োজন, গাছের গোঁড়া হইতে আগাছা নিড়াইয়া তাহাতে সার নিক্ষেপ করিয়া পানি ঢালিতে হয়।দেশের বনে জঙ্গলে ত কত ফুল ফুটিয়া আপনা হইতে সৌরভ বিস্তার করে কিন্তু সেই ফুলের সন্ধান জানে কয়জন?আমাদের দেশে কত লালন ফকির, কত পাগলা কানাই জন্মিয়াছে,কে তাহাদের সন্ধান রাখে?দেশের সত্যকার সাহিত্য গড়িয়া তুলিতে হইলে, সাহিত্যদিগকে তেমনি সুযোগ সুবিধা করিয়া দিবার প্রয়োজন। আমেরিকা জাগ্রত জাতি। তার সাহিত্য শক্তি তার জাতীয় সম্পদ। এই সম্পদকে নানা ধারায় ফুটাইয়া তুলিতে এই জাত তার সাহিত্যিক সমাজকে উপযুক্ত মর্যাদা দান করে।“
ফোকলোর সোসাইটি বা লোকসাহিত্য সভার মাধ্যমে ইউরোপ তার লোকসঙ্গীত,লোকনৃত্য,ইত্যাদি তার ভবিষ্যতের উত্তরসূরিদের জন্য অখণ্ড দলিল স্বরূপ রেখে যাচ্ছে।শুধু তাই নয়,বুদ্ধিহীন অপরিণত মস্তিষ্কের ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল যেখানে সুদক্ষ শিক্ষক দিয়ে তাদের শক্তির ব্যবহার করা হয় এবং যারা সেখানে চাকরী করেন তারা মাসিক বেতনের জন্য নয়,অন্তরের স্নেহ মমতা দিয়ে কাজ করেন।
এর মাঝে আমাদের গ্রাম বাংলার বিবাহ উৎসব কাহিনী ও চলে আসে। বর কিনবা কনে বাড়ির জন্য একজন পাকান পিঠা বানায় তো আরেকজন সেমাই কাটে,কেউ মিঠাই তৈরি করবে ডালিম কিংবা লিচুর মত করে,কেউ সুপারি কাটবে তো কেউ পান বানাবে। শুধু তাই নয় নকশী কাঁথা তৈরি করে বর কিংবা কনের বাড়ি পাঠান হয়। এইভাবে একটা বিবাহকে অবলম্বন করে এ গাঁয়ের মেয়েদের গুনপনার সঙ্গে ও গাঁয়ের মেয়েদের গুনপনার সুন্দর প্রতিযোগিতা হয়।
যদিও নগরায়নের যুগে এই ধরনের আনন্দ উৎসব এখন বিলুপ্তির পথে।কল্পনায় ও তা ছোঁয় না। 🙁
আমাদের সাহিত্যকৃষ্টির প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের উদাসীনতা ও এখানে কবি উল্লেখ করেন,” পশ্চিম পাকিস্তান হইতে পূর্ব পাকিস্তানে যাইয়া সেই আলাদা রীতিনীতি দেখিয়া আমাদের কোন কোন ভাই মনে করেন,এই পার্থক্য হিন্দু প্রভাবের ফল।তাহারা আশা করেন এইসব পার্থক্য ভাঙ্গিয়া আমরা আপনাদের সঙ্গে আসিয়া এক হই………পার্থক্যের জন্যই মানুষ মানুষের বন্ধু হয়।আমার ভিতরে যাহা নাই তাহা আমরা অপরের নিকটে পাইয়া তাহার সঙ্গে বন্ধুত্ব করি……।“
সবশেষে বলবো ১৪২ পৃষ্ঠার এই বইটি অবসরে কিংবা ভ্রমণে পড়বার মত দারুণ একটা বই।প্রতিটি লেখা আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে পল্লীকবির দেখানো সেই “সোনার পাতায় ছাওয়া ছোট কুটির খানি” তে,স্বপ্নিল হয়ে উঠবে আপনার যাত্রাটাও-“সরষে খেতের বনে মটর শিমের লতা তার শাড়ির আঁচল টানিয়া ধরিতে চায়,দু’ধার হইতে সরষে ফুলের গুচ্ছগুলি ঈষৎ হেলিয়া পড়িয়া তার সরষে ফুলের মত রঙ্গিন অঙ্গে সুগন্ধের রেণু মাখাইয়া দেয়,নদীর ঘাটে যাইয়া শূন্য কলশীতে জল ভরিতে সে অবাক হইয়া চাহিয়া দেখে;দেখে কোন উদাস রাখাল সামনে হিজল গাছটির উপর বসিয়া তার বাঁশের বাঁশিতে সুর পুরিয়া সমস্ত আকাশে বাতাসে ছড়াইতেছে আর হিজল গাছ হইতে রাশি রাশি রাঙা ফুল ঝড়িয়া নদীর পানিকে রাঙা করিয়া দিতেছে, এমনি একটি দৃশ্যের জন্য যদি তোমার মন কোনদিন লালায়িত হয় তবে একবার আমাদের পাকিস্তানে তুমি আসিও।“
এই লেখাটা আগেই তো পড়েছিলাম মনে হচ্ছে। :thinking: কোথায় পড়লাম?
🙁 দুইবার পোস্ট হয়ে গেলো??!!
একটা আবছা ভালো লাগায় মন ছুঁয়ে গেল।
১৪২ পৃষ্ঠার আস্বাদনের স্পর্শ এক লহমায় পেয়ে গেলাম।
এরকম বুক রিভিউ আরও চাই। 🙂
😀
ধন্যবাদ,চেষ্টায় আছি।
বুক রিভিউ ভালো লাগলো, বই টা পড়তে হবে…… 🙂
ধন্যবাদ
অবশ্যই, সংগ্রহে রাখবার মতো বই। 🙂