কোন এক অজানা নক্ষত্রের ফসিল তুমি [অনুবাদ]

আমাদের  এই  গ্রহ, এই  সমাজ   আর  আমরা নিজেরা , নাক্ষত্রিক  উপাদানে তৈরী– কার্ল  সেগান, কসমস

কাল বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে যাবে। গতানুগতিক আড্ডা একঘেঁয়ে বিষয়গুলোর চেয়ে আলাদা চমৎকার কোন টপিকের জন্য  হন্যে হয়ে খুঁজছো? একটু মনযোগ দিয়ে শোন, “তোমার শরীরের অগণিত পরমাণু, হাঁড়ের ক্যালসিয়াম, জিনের কার্বন, তোমার মেকি দাঁতের স্বর্ণটুকু, এর সবটাই সৃষ্টি হয়েছিল কোটি বছর আগেকার কোন জ্বলন্ত তারকার উদরে।”
জী, একেবারে সবটাই । বাদ দিতে হবে কেবল  হাইড্রোজেন  এর   কাছাকাছি ভরের কয়েকটা মৌলিক  পদার্থের  কণা। কারণ, এই বেচারারা তৈরী হয়েছিল তারও আগেকার সেই  বিগ-ব্যাং এর  পরপর, একেবারে ১৩৭০ কোটি বছর আগে।

বিশ্বাস করা যতই কঠিন হোক না কেন, তোমার শরীরের প্রতিটা পরমাণুর জন্ম, জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতে, বিলিয়ন বছর আগের বিগ-ব্যাংয়ের ফলে গড়ে উঠা কোন এক নক্ষত্রের গর্ভে। এখানে উত্তরের তারকা, ধ্রুব তারা বা পোলারিসের একটা ক্লোজআপ ছবি দিলাম।Photo credit: NASA, ESA, G. Bacon (STScI)

 

আশ্চর্যজনক কিন্তু সত্য।  জ্যোর্তিবিজ্ঞানীদের জ্ঞানগর্ভ মতামত এটা ।  তুমি আর  তোমার  চারপাশের সবকিছু; চোখে দেখা প্রত্যেকটা প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিম বস্তু, প্রতিটা পাথর, গাছ, প্রজাপতি কিংবা দালান, গঠিত হয়েছে পরমাণু থেকে। আর এই প্রত্যেকটা পরমাণুর জন্মের গল্প  লেখা রয়েছে মহাবিশ্বের ইতিহাসের সেই সুদূর অতীতের কোন গভীরে। হয় সেই মহাবিস্ফোরণ বিগ-ব্যাং এর সময়ে, অথবা,  অতি হালকা দু’তিনটা মৌলিক পদার্থে বাদ দিলে,  লক্ষ লক্ষ জ্বলন্ত তারকার হঠাৎ ফেটে পড়ার  মধ্য দিয়ে। আর বাস্তবতা হলো, আজকের এই  তুমি জীবন  পেয়েছো, কারণ, সেই দুর্ভাগা নক্ষত্রগুলো আজ  মৃত।

আজব, তাই না? কি করে হলো এত কিছু? কোন তারকার ধুলীময় মৃতদেহ হতে জন্ম নেয়া এক ফসিল  গ্যালাক্সি হয়ে তুমি হেঁটে বেড়াচ্ছ। কি করে সম্ভব?

হ্যাঁ, এ বহু পুরনো গল্প। বারবার শোনার  মতো এক অভাবনীয় জীবনালেখ্য । এ কাহিনী, বিংশ শতাব্দির জ্যোতির্বদ্যার সেরা রচনাগুলোর  একটা। হতবাক করে দেয়া  তার ঘটনাক্রম।

সবকিছুর শুরু যেখান থেকে…

কাহিনীর শুরুটা হলো এক মহাবিস্ফোরণ দিয়ে। অস্তিত্ব পেল মহাবিশ্বের সমুদয় হাইড্রোজেন। শুরুতে এ তো ছিল কেবল রাশি রাশি প্রোটন।  এরপর, ক্রমে সেই পিচ্চি বিশ্ব বহুগুণে সম্প্রসারিত হলো আর ঠান্ডা হলো। সেই তখন প্রোটনগুলোর সাথে এসে জুড়ি বাঁধলো ইলেকট্রন, আর  তৈরী করলো হাইড্রোজেন। আজ, তোমার শরীরের অর্ধেকটা গড়ে উঠেছে যেই H2O (পানি) দিয়ে, তার ভেতরকার হাইড্রোজেনের জন্ম সেই তখনই। তোমার পিতামাতার কাছ থেকে তুমি  পাও নি সেগুলো, পেয়েছ সেই আদি-বিশ্বের কাছ থেকে।  তোমার শরীরের মধ্যে ১৩০০ কোটি বছর পুরনো পরমাণু নিয়ে তুমি চলছো। ভাবতেই অবাক লাগে, তাই না?

তোমার শরীরে কোন পানির পরমাণুর (H2O )  হাইড্রোজেন কণাকে আলাদা করে নাও, আর নিজে, জাদুর বলে, সেই পরমাণুর সমান হয়ে যাও। আর তারপর সেই পরমাণুর কাঁধে চড়ে, সময়ের উল্টো দিকে চালাও তোমার অভিযান। সেই কণার পুরো জীবনকালের রহস্যময় সময়পথ ধরে এগোতে এগোতে; নিজেকে তুমি আবিষ্কার করবে, সেই বিগ-ব্যাং এর ঠিক পরমুহূর্তটিতে। তার মানে দাঁড়ালো,  তুমি এইমাত্র, যখন এ লেখাটি পড়ছো,  তোমার শরীরের ভেতরে কাঁপতে থাকা হাইড্রোজেন পরমাণুটি কিন্তু সেই পরম-বিস্ফোরণের  সময় থেকেই অপরিবর্তনশীল অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে।

তের বিলিয়ন বছরেরও বেশী সময় আগে ঘটেছিল মহা বিস্ফোরণ, সেই বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম এখনো মহাবিশ্বের বেশীরভাগ দৃশ্যমান বস্তুর স্থান দখল করে আছে। হাবলের আল্ট্রা-ডীপ-ফিল্ড এর এই চিত্রতে প্রায় ১০ হাজার গ্যালাক্সি দেখা যাচ্ছে। Photo credit: NASA, ESA, and N. Pirzkal (STScI/ESA)

 

 

 

এটুকুই শেষ নয়।  বিগ-ব্যাং ফলশ্রুতিতে জমে উঠল প্রচুর হিলিয়াম, দ্বিতীয় হালকা-তম পদার্থ। অবশ্য তোমার ভেতরে কোন হিলিয়াম থাকার কথা না। কারণ, নিশ্চিতভাবেই তুমি তোমার জন্মদিনের বেলুনের বাতাসটা খেয়ে নাও নি , তাই না?  তারপরও, সৃষ্টিগতভাবে,  হিলিয়াম হচ্ছে হাইড্রোজেনের পর বিশ্বের সবচেয়ে সুপ্রাপ্য পদার্থ। এই দুই ভাই মিলে বিশ্বের ৯৮ ভাগ বস্তু গঠন করেছে (দৃশ্যমান বস্তুর কথা বলছি; ডার্ক ম্যাটারের কাহিনী অন্য।) সামান্য পরিমাণ লিথিয়ামও তৈরী হয়েছিল সেই বিগ-ব্যাংয়ের সময়ে।  তবে তা নগণ্য বলেই, ধর্তব্য নয়।

 

মহাবিস্ফোরণের গল্পের ইতি টানি।  বিগ-ব্যাংয়ের দৌড় এটুকুই। বাকি  আর সবকিছু, সব ধরনের রাসায়নিক বস্তু, কার্বন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন থেকে শুরু করে  জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সব পদার্থ, উপ্ত হয়েছে পরবর্তী সময়ে কোন তারকাদের মধ্য হতে। কেমন করে? সে গল্প খুবই সহজ সরল। উহু, না, সে গল্প ভয়ঙ্করভাবে জটিল। এ সরলতা গরলতা নির্ভর করে, তুমি কি স্রেফ বিজ্ঞান লেখক, নাকি পুরোদস্তুর বিজ্ঞানী, তার উপর। আপাতত এখানে আমরা সরল কাহিনীর দিকেই যাই।

টেবিল একটা, বসলো গিয়ে দুই কম ছয় কুড়ি

এ পর্যায়ে একটু জেনে নিই, মৌলিক পদার্থের কথা। মৌলিক পদার্থ হলো এমন বস্তু, যাকে এমনকি রাসায়নিক প্রক্রিয়ায়ও ভেঙ্গে বা পরিবর্তিত করে অন্য কোন নতুন বস্তুতে পরিণত করা সম্ভব  নয়। অবশ্য, এই্ মৌলিক বস্তুকেই আবার বদলে দেয়া যায়, নিউক্লিয়ার পদ্ধতিতে। তারকাদের গরম কেন্দ্রে প্রতিনিয়ত চলে এমন নিউক্লিয় বিক্রিয়া। এই যেমন,  প্রতি সেকেন্ডে আমাদের সূর্যদেব ৫০কোটি টন হাইড্রোজেনকে হিলিয়ামে পরিণত করে ফেলছে।

হাই স্কুলের স্মৃতিকে টেনে আনলে তোমার মনে পড়বে,  রসায়নের সেই বিখ্যাত পর্যায় সারণীর কথা । একটু নজর বুলালেই আমরা দেখবো, সবচেয়ে হালকা পদার্থটি হলো হাইড্রোজেন, যার পরমাণুর নিউক্লিয়াসে (কেন্দ্রে) আছে কেবল একটা প্রোটন। একারণে  পারমাণবিক সংখ্যা হলো ১।
হিলিয়ামের আছে দুটি প্রোটন, যার ফলে পারমাণবিক সংখ্যা ২।(( অর্থাৎ, পারমাণবিক সংখ্যা তার প্রোটন সংখ্যারই আরেক নাম, কারণ, এই প্রোটন সংখ্যাই তাকে অন্য পরমাণু থেকে আলাদা করে দেয়। )) এভাবে বাড়তে বাড়তে একেবারে ইউরেনিয়াম পর্যন্ত গেলে দেখবো, এর আছে ৯২টা প্রোটন। ইউরেনিয়াম হলো প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত সবচেয়ে ভারী মৌলিক পদার্থ। বলাই বাহুল্য, এই ধরার বুকের সব জীবন, আর তার চারপাশের সব বস্তু, এই ৯২টি মৌলিক বস্তুর নানান বিন্যাসেরই গঠন।

জেনে রাখা ভালো যে, এর চেয়ে ভারী পদার্থও আছে। নেপচুনিয়াম (৯৩) থেকে শুরু করে বেসরকারীভাবে নাম দেওয়া ‘আনওনোকটিয়াম’ (১১৮) পর্যন্ত এ পদার্থগুলো প্রাকৃতিকভাবে পৃথিবীতে পাওয়া যায় না। (অতি ব্যতিক্রমীভাবে সামান্য পরিমাণ নেপচুনিয়াম ও প্লুটোনিয়াম অবশ্য পাওয়া যেতে পারে)

একজন শিল্পীর তুলিতে আদি পৃথিবীর চিত্র, কেমন করে এক বিলিয়ন বর্ষেরও কম বয়েসী মহাবিশ্বের হাইড্রোজেন এক চরম মুহূর্তে আদি তারকাগুলোর জন্ম দিচ্ছে। Photo credit: Science: NASA and K. Lanzetta (SUNY). Art: Adolf Schaller for STScI.

তারকার জন্ম হয়

এখন প্রশ্ন, পর্যায় সারণীর এই যে  এতগুলো রাসায়নিক পদার্থ,  কিভাবে এরা শুরুতে অস্তিত্ব লাভ করেছিল অথব  এখনো একই পদ্ধতিতে  প্রতিনিয়ন জন্ম নিচ্ছে? সংক্ষেপে বলি।

সেই ১৩০০ কোটি বছর আগেকার মহাবিস্ফোরন ঘটার পর, বেশ কয়দশ কোটি বছর কেটে গ্যাছে। সেই তৈরী হওয়া হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম,  শিশু মহাবিশ্বের সুসমভাবে ছড়িয়ে থাকা  অস্তিত্ব পার হয়ে ছোট ছোট গ্যাসীয় মেঘের আকারে পুঞ্জিভূত হতে শুরু করলো। এভাবে পুঞ্জিভূত কোন এক মেঘের সংকোচন থেকেই তৈরী হলো বিশ্বের প্রথম নক্ষত্র। মহাকর্ষ, যে বলটাকে আর অস্মীকার করা যাবে না, সেই নবজাতক নক্ষত্রকে আরো সংকুচিত আর গরম করে এর গর্ভের  তাপমাত্রা এমন পরিমান বাড়িয়ে দিল যে, হাইড্রোজেন পুড়তে শুরু করলো, আর ফিউশন প্রক্রিয়ায়  তৈরী হতে লাগলো হিলিয়াম।
এই হলো তাপ-নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার শৃঙ্খলের প্রথম লিংক, যা নক্ষত্রের আকার এবং ভাগ্যের ভিত্তিতে অন্য সকল রাসায়নিক পদার্থের জন্ম-প্রক্রিয়া শুরু করে দিল। এ জন্ম প্রক্রিয়া চললো একেবারে ক্যালিফোর্নিয়াম পর্যন্ত, যার পারমাণবিক সংখ্যা ৯৮, যা শুধুমাত্র কণা-ত্বারকের মাঝে তৈরী করা সম্ভব বলে পদার্থবিদরা বিশ্বাস করেন।
ভেবে দেখ তো, তুমি রান্নাঘরে রান্না শুরু করলা কেবল একটা তরকারী দিয়ে এবং, তোমার চুলায় জ্বাল দেবার পর, সেটা সম্ভবপর সব ধরনের তারকারীর স্বাদ নিয়ে এল। এ ধরনেরই একটা রান্না করেছে আমাদের এ মহাবিশ্ব স্রেফ হাইড্রোজেন দিয়ে।

H পুড়িয়ে  He বানানোর কাজটা করতে হয় আমাদের সূর্যকে পর্যন্ত। বাঁচার তাগিদে। এর কেন্দ্রীয় শাঁসের চরম তাপমাত্রায় (২৭ মিলিয়ন ফারেনহাইট প্রায়) চার চারটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস ফিউশনড হয়ে একটা হিলিয়াম নিউক্লিয়াস গড়ার ঘটনা চলতেই থাকে, চলতেই থাকে, আর চলতেই থাকে। প্রতি সেকেন্ডে ৫০০ মিলিয়ন টন হাইড্রোজেন পুড়িয়া হিলিয়াম করে সে। এবং প্রত্যেকটা হিলিয়াম কণার গঠনে কম করে হলেও ট্রিলিয়ন ফোটন কণা বের হয় সূর্যের ত্বক থেকে। আর এ জন্যই তোমাকে আমাকে পড়তে হয় সানগ্লাস।

পদার্থিক রান্নাবান্না

আমাদের নিজেদের নক্ষত্রটা আমাদের বাঁচতে সক্ষম করে। অথচ, এত বয়স হয়ে যাবার পরও,সে আমাদেরকে হিলিয়ামের চেয়ে ভারী কোন বস্তু দিতে পারে না। আসলে, সে তেমন ভারী না। আমাদের তারাটার চেয়ে অন্তত আট গুণ ভারী তারকার ক্ষেত্রে, মহাকর্ষের চাপ আরো নতুন  নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার জন্য যথেষ্ট হয়। কার্বন (পদার্থ-৬)  আর অক্সিজেন (৮) দিয়ে শুরু সেই বিক্রিয়া। এরকম কোর, তাপমাত্রা যথেষ্ট বেশী , প্রায় ১৮০মিলিয়ন ফা., তিনটা হিলিয়াম নিউক্লিয়াসকে জোর করে কার্বন নিউক্লিয়াস বানিয়ে দিতে পারে। অথবা চারটেকে মিলিয়ে অক্সিজেন । এভাবে চলতেই থাকবে। এ ধরনের বিক্রিয়া একসময় সূর্যেও ঘটবে, যখন পাঁচ বিলিয়ন বছর পর লাল দৈত্যে পরিণত হবে।

জলন্ত উদর আমাদের তারকার, আমাদের সূর্যের। একটা জ্বালানী দিয়ে কেবল একটা পদার্থই তৈরী করে যাচ্ছে, তৈরী করে যাচ্ছে হিলিয়াম, যুগের পর যুগ। Photo credit: NASA

 

অনেক ভারী যেসব তারকা, সূর্যভরের আটগুণের চেয়েও অনেক বেশী যাদের ওজন, সেগুলোর মহাকর্ষীয় বল এর মধ্যভাগের তাপমাত্রা  চরমভাবে বাড়িয়ে দেয়। ফলে, শুরু হয় অসম্ভব রকম তাপ-নিউক্লিয় বিক্রিয়া, যাতে একেবারে লৌহ (পদার্থ-২৬) পর্যন্ত সব ধরনের মৌলিক বস্তু তৈরী হতে থাকে।  একেবারে ১০৮০ মিলিয়ন ফারেনহাইট  তাপমাত্রায়, কার্বন ফিউশন প্রক্রিয়ায় নিয়নে পরিণত হয়; ২৭০০ মিলিয়ন ফা. এ অক্সিজেন হয়ে যায় সিলিকনে এবং ৭২০০ মিলিয়ন ফারেনহাইটে সিলিকন মিলে মিলে হয় আয়রন বা লৌহ। কিন্তু, খুব খুব দুঃখের ব্যাপার হলো, লৌহের চেয়ে ভারী মৌলিক পদার্থ তৈরী হতে গিয়ে বিক্রিয়ায় এক বড় ধরনের বদল আসে।  শুরু থেকে লৌহ পর্যন্ত যত পদার্থ ফিউশন প্রক্রিয়ায় তৈরী হয়, সেই বিক্রিয়ায় কিছু না কিছু তাপও বের হয়। তাপোৎপাদী বিক্রিয়া। কিন্তু, লৌহের পরে অন্য কোন ফিউশনে কোন তাপ শক্তি তৈরী হতে পারে না।
তাপ শক্তি উৎপন্ন আর না হলেও, নক্ষত্র গর্ভে এর চেয়ে ভারী বস্তু গুলোও তৈরী হতে থাকে। যার মধ্যে আছে অতি আকাংখিত সিলভার , স্বর্ণ থেকে শুরু করে, উচ্চারণ করা যায় না এমন অদ্ভুত নামের প্রাসোডিমিয়াম, ইটারবিয়াম (( উচ্চারণটা সঠিক কি না জানি না ))

তোমা পর্যন্ত যেতে আছে দুটি পথ
নক্ষত্রগুলো লৌহের চেয়ে ভারী বস্তু তৈরীতে দুটি পথের যে কোন একটি পথ বেছে নেয়। এবং, কাকতালীয় নয় যে, এসব বস্তু তার উদরীয় ফার্নেসে জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে তৈরী করার পর  সেগুলোকে ছুড়ে দেয় মহা শূন্যের মাঝে যাতে নতুন কোন তারকা, গ্রহ অথবা “মানুষ” তৈরী হতে পারে সেগুলো থেকে।

এরকম কোন একটা নক্ষত্রের বহুদুর ব্যাপ্ত নক্ষত্রধুলীই হয়তো আজকের এই তোমার দেহকে আকার দিয়েছে।

প্রথম পদ্ধতিটা ঘটে লাল দৈত্যগুলোর মধ্যে। এসব তারকা হলো সেগুলো যেগুলোর কেন্দ্রীয় জ্বালানী  হাইড্রোজেন পুড়তে পুড়তে নিঃশেষ হয়ে গ্যাছে। এই নিঃস্ব তারকাগুলো তখন. জ্যোতির্বিদ ক্রেইগ হুইলারের মতকে অনুসরণ করে, একপ্রকার পাগলামী বা সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে যায়। তার ভেতরকার কোর  শক্তি হারাতে শুরু করে, সংকুচিত হতে থাকে আর গরম হতে থাকে। কিন্তু এনভেলপ তথা বাইরের বাকি অংশ, শক্তি পেয়ে পেয়ে প্রসারিত হতে থাকে আর ঠান্ডা হতে থাকে। ফলে  বাইরের অংশটা হয়ে পড়ে কটকটে লাল। এই প্রসারণ কিন্তু অনেক জায়গা দখল করে নেয়। যেমন, আমাদের সূর্য যেদিন লাল দৈত্যে পরিণত হবে, সেদিন এটা এত বেশী প্রসারিত হয়ে পড়বে যে, তা সূর্যজগতের কেন্দ্রের দিকের কাছাকাছি গ্রহগুলোকে আত্মিকরণ করে গলিয়ে ফেলবে। আমাদের সাধের পৃথিবীও এর মধ্যে পড়বে।

এভাবে প্রসারিত হয়ে ফুরিয়ে যাবার আগে, কিছু কিছু লাল দৈত্য যথেষ্ট পরিমাণ সময় পায়, যেগুলো লৌহের চেয়ে ভারী মৌলিক তৈরী করতে পারে। এই পদ্ধতিটাকে বলে এস-প্রসেস , মানে ধীর-পদ্ধতি। হাজার বছরের ব্যবধানে এই ধীর-পদ্ধতিতে উৎপন্ন মৌলিকের হিসাব  বিসমাথ (৮৩) পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এই বস্তুগুলো পরিচলন পক্রিয়ায় টান খেয়ে তারকার ত্বকের দিকে ছুটে যায় আর ধাক্কা খেয়ে তারকার মহাকাশীয় বায়ুতে ভর করে মহাশূন্যের বুকে পাড়ি জমায়। এই দূরদুরান্তে ছড়ানো তারকা-ধুলীর কোনটাই হয়তো এখন  ধরে রেখেছে তোমার সুঠাম দেহ।

এবার একটা আসল বিস্ফোরণ

বিসমাথের চেয়ে ভারী বস্তু গড়ে উঠতে লাগবে আর-প্রসেস, মানে, দ্রুত-প্রসেস। কতটা দ্রুত?
একেবারে সেকেন্ডের মধ্যেই। যখন একটা তারকা বিস্ফোরিত হয়ে হবে সুপারনোভা। এটা মনে করা স্বাভাবিক যে, তারকাগুলো ঠিক যেন চিরকাল বেঁচে থাকে। কিন্তু, আসলে, সবচেয়ে ভারী তারকাগুলো বাঁচে কেবল কয়েক মিলিয়ন বছর।মহাজগতের তুলনায় এ সময়টা স্রেফ এক মুহূর্তের সাথে তুলনীয়। এরপর তা হারিয়ে যায়, নিমিষে, এক অদ্ভুত দ্রুততায়।  কি ঘটে তাদের মাঝে??

যখন একটা লাল দানো তার সব হালকা বস্তুকে ফিউশন প্রক্রিয়ায় পুড়িয়ে শেষ করে ফেলে, তার মধ্যভাগে পড়ে থাকে কেবল একটা লৌহ-কোর। তারকাটি তখন আর তার  সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে পারে না।  তাপশক্তি ভেতর থেকে ধাক্কা দেয়, আর মহাকর্ষ টেনে নেয় ভেতর পানে। মহাকর্ষ হঠাৎ করে প্রকট হয়ে দাঁড়ায়, পুরো কেন্দ্রটিকে মুহূর্তের মাঝেই দুমড়ে মুচড়ে পৃথিবীর ঘনত্বের বিলিয়ন গুণ ঘন করে ফেলে। সেই চরম মুহূর্তে তারকাটি নিজেকে ফাটিয়ে দেয়। যেন ঘটে যায় মহাপ্রলয়।  খুব অল্প সময়ের জন্য তা এত বেশী উজ্জ্বল হয়ে উঠে যে, পুরো গ্যালাক্সীও এর উজ্জ্বলতার কাছে হার মানে। এবং এত শক্তি নির্গত করে যে, আমাদের সূর্যের ১০ বিলিয়ন বছরের নির্গত শক্তিকেও তা ছাড়িয়ে যায়।

প্রথম কয়েক সেকেন্ডেই, তারকার ভেতরে সারাজীবন জুড়ে তৈরী হওয়া পরমাণুগুলোর কেন্দ্রের প্রোটনগুলো অতি-শক্তিধর নিউট্রনের সাথে সংঘর্ষ বাধে।  ফিশন হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সকল প্রাকৃতিক মৌলিক পদার্থের পরমাণু তৈরী করে বসে। একেবারে বিসমাথ থেকে শুরু করে ইউরেনিয়াম, ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে কিছু সল্পজিবী মহাভারী প্লুটোনিয়াম আর ক্যালিফোর্নিয়াম পর্যন্ত। এত সব বস্তু, ফেটে গিয়ে ঘন্টায় মিলিয়ন মিলিয়ন মাইল গতিতে ছড়িয়ে পড়ে মহাশূন্যে। আন্তনক্ষত্রীয় মাধ্যম হয়ে কোন কোন পরমাণুগুচ্ছ রূপ নেয় নতুন তারকার বীজে। কোনটা নতুন গ্রহমালায়।

তুমি যখন জন্ম নিলে

সময় পেরিয়ে যায়।গভীর শূন্যের মাঝে ছড়িয়ে পড়া বস্তুগুলো গড়ে তোলে আণবিক মেঘের গ্যাস আর ধুলী, সেগুলো আবার নিজেদের মহাকর্ষীয় টানে সংকুচিত হতে শুরু করে। এরকম মেঘের প্রায় পুরোটাই থাকে হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম। কিন্তু, এখানে সেখানে তার মাঝে পাওয়া যায় ভারী পদার্থগুলোকেও। সবচেয়ে বেশী আছে যে ক’টা সেগুলো মিলে সাধারণ সাধারণ অণু গঠন করতে শুরু করে যেমন, পানি (H2O) এবং চলতে চলতে গঠিত হয় আরো জটিল অণু, যেমন চিনি গ্লাইকোএলডিহাইড(C2H4O2) । বিজ্ঞানী বিশেষ ধরনের যন্ত্র, স্প্যাক্ট্রোমিটারের মাধ্যমে এসব যৌগিক আর মৌলিক অণুর অস্তিত্ব নির্ণয় করতে পারেন।
ঘটনাচক্রে, মাঝে মধ্যে একেবারে ঘন-কর্দমান্ত প্রোটো-তারকা  তৈরী হয়ে যায়। যার চারপাশে চাকতির মত ঘুরতে থাকা বস্তু গুলো পরবর্তীতে গঠন করে গ্রহ। এই পদ্ধতিই ঘটেছিল আমাদের সৌরজগতের ক্ষেত্রে সেই পাঁচ বিলিয়ন বছর পূর্বে। যা থেকে অস্তিত্ব লাভ করেছে সূর্য , গ্রহগুলো আর পাঁচ বিলিয়ন বছর পর, তুমি।

তোমার কি কোন ধারনা ছিল যে, তোমার মাঝে যে পরামাণুগুলো আছে সেগুলো ১৩ বিলিয়ন বছর বয়সী?

কাহিনী এটুকুই জানা। এরপর  কি করে এই অণূ পরমাণু গুলো নির্জীব জীবনহীন অস্তিত্ব থেকে জীবন্ত দেহে পরিণতি লাভ করলো তা বিজ্ঞানের বিখ্যাত অমিমাংসিত প্রশ্নগুলোর একটা। কিন্তু, এই নির্জীব বস্তু গুলো শুরুতেই এখানে কি করে এল, সেই অদেখা সফরনামা, হেসেখেলেই,  বের করতে পেরেছে আজকের, জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা। কত বিমুগ্ধকর এই গল্পটা, তাই না?

রচনা: পিটার টাইসন ,নোভা অনলাইনের এডিটর-ইন-চীফ.। (( মূল লেখার লিংক: http://www.pbs.org/wgbh/nova/space/star-in-you.html  ))

 

 

 

 

জ্ঞানচোর সম্পর্কে

সেই কবে জেগেছিলাম, বিলিয়ন বর্ষী নক্ষত্রের আলোয়, ডিরাকের সমুদ্রের পাড়ে। অবাক কৌতুহল নিয়ে গেলাম বহুদুর। তারপরও সহসা বুঝি, নিজে আমি,নিছক পড়ে থাকা ঝিনুকের খোলসে সোনালী অনুপাত খুঁজে বেড়াই। পড়ে থাকো তুমি, মহা সমুদ্র।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

5 Responses to কোন এক অজানা নক্ষত্রের ফসিল তুমি [অনুবাদ]

  1. অনাবিল বলেছেনঃ

    পড়তে দারূণ লাগলো……… জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা খুব প্রিয় একটা
    বিষয় আমার…… এই জিনিসটা খুব মজার লেগেছে আমরা পুরো নাক্ষত্রিক…… 😀
    তবে বড় পোস্ট বলে মনযোগ রাখতে একটু কষ্ট হলো…… :p

    • ফিনিক্স বলেছেনঃ

      অনাবিল আপুর সাথে সহমত।
      পোস্টটা দুই পর্বে এলে ভালো হত।

      তবে আসলে এই বিষয়ে যাদের আগ্রহ আছে তারা পড়বেই। পোস্ট বড়ই হোক আর ছোটই হোক। 🙂

      • জ্ঞানচোর বলেছেনঃ

        আসলে কেবল একটা লেখার অনুবাদ। অনুবাদ করতে গিয়ে দেখলাম, বাংলায় বেশ বড় হয়ে যায়। তারপরও লেখার প্রবাহ বজায় রাখতে এক ক্যাপসুলেই ভরে দিলাম। 🙁

        আসলে, অনুবাদের ব্যর্থ প্রয়াস ছিল মাত্র।আমি অনুবাদক নই 😛

        ধন্যবাদ ভাল লাগায়। 🙂

  2. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    মহাবিশ্ব নিয়ে আমার আগ্রহ কম নয়।
    তাই পড়তে বেশ লাগল।

    অফটপিক-
    বানানের দিকে আরেকটু নজর দিলে আরও ভালো হত ভাইয়া। 🙂

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।