(প্রথম অংশের পর)
“এসো জেরি,” আমি বললাম, “যদি এতো দেরিতে আসার অনুমতি থাকে তোমার।”
“আমি একটা গল্প বলতে চাচ্ছি।” সে বলল। “তাদেরকে বলেছি মনে হয় আপনি আমার সাথে দেখা করতে চান।”
“এটা সত্যি।” আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম,সেও কিছুটা নির্ভার হল। “আমি শুনতে চাচ্ছিলাম তুমি কিভাবে কুকুরটাকে চালালে।”
সে আমার পাশে আগুনের সামনে বসলো,আর কোন আলো ছিল না আর গত দুদিনের তাদের একসাথে থাকার কাহিনী বলতে লাগলো। কুকুরটা তার পাশেই আরামে নিশ্চিন্তে শুয়ে ছিল যা সে আমার কাছে পাচ্ছিলো না। আর মনে হতে লাগলো কুকুরটার প্রতি এই আদর যত্ন ছেলেটা আর আমাকে এতো কাছাকাছি এনে দিল যাতে সে ভাবতে লাগলো পোষা প্রাণীটার মতো সেও আমার অধীনস্থ।
সে আমাকে বলল, “সে সবসময় আমার সাথেই ছিল শুধুমাত্র লরেলের মধ্য দিয়ে দৌড়ানোর সময় ছাড়া। তারও লরেল পছন্দ হয়েছে। আমি তাকে পাহাড়ের উপরে নিয়ে গিয়েছিলাম তারপর একসাথে দৌড়লাম। সেখানে বড় বড় ঘাসের মধ্যে আমি শুয়ে পড়লাম আর হারিয়ে গেলাম। আমি শুনতে পারছিলাম প্যাট আমাকে খুঁজছে। সে আমাকে খুঁজে না পেয়ে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো। যখন সে আমাকে খুঁজে পেল ,সে পাগলের মতো করতে লাগলো আর আমার চারপাশে গোল করে ঘুরতে থাকলো।”
আমরা আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
সে বলল,”এটা একটা আপেলের গুড়ি। এই কাঠটা সবচেয়ে দারুণভাবে পুড়ে।”
আমরা খুব কাছাকাছি বসে ছিলাম।
হঠাৎ করেই সে কিছু একটা বলার জন্য চুপ হয়ে গেলো যে আমিও সাহস করলাম না তাকে জিজ্ঞেস করবার।
“আপনি দেখতে কিছুটা আমার মায়ের মতো।” সে বলল। “বিশেষ করে আলোর পেছনে ওই অন্ধকারে।”
“কিন্তু জেরি,মাত্র চার বছর বয়সে তুমি আশ্রমে এসেছিলে। সেই সময় তোমার মা দেখতে কেমন ছিল তা তুমি কিভাবে মনে করতে পারো?”
“আমার মা ম্যানভিলে থাকে।” সে বলল।
‘তার মা আছে!’ এই কথাটা কিছুক্ষণের জন্য আমাকে এতটাই স্তব্ধ করে দিয়েছিল যা আমার জীবনে আগে কখনো হয়নি আর আমি জানি না কেন এটা আমাকে অস্থির করে তুলেছিল। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম কেন আমার এই অস্থিরতা। এক ধরনের বিতৃষ্ণা জেগে উঠলো যে কোন মহিলা কিভাবে তার ছেলেকে এভাবে ফেলে যেতে পারে। কিছুটা রাগও হচ্ছিল। তাও এরকম একটা ছেলেকে – ঠিক আছে আশ্রমটা খুবই দারুণ একটা জায়গায়,
কর্মচারীরাও খুব ভালো মানুষ আর যত্নবান, প্রচুর পরিমাণে খাবার দাবার আছে, ছেলেপেলেদের স্বাস্থ্যও ভালো, একটা ছেঁড়া শার্ট প্রমাণ করে না যে খুব পরিশ্রম তাদের উপর হয়। মেনে নেয়া যায়,হয়ত ছেলেটা কোন কিছুর অভাব বোধ করছে না, কিন্তু এমন কোন নারী যে তার নাড়ি ছেঁড়া সন্তানকে না দেখে দূরে আছে? চার বছর বয়সে সে এমনই ছিল দেখতে। এরকম হয়ত কিছুই ছিল না,কিন্তু ওই চোখ দুটো,কোন কিছুই তা বদলে দিতে পারত না। হয়ত কিছুটা বোকা আর নির্বোধ ছিল। আমি তাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, যদিও ভয় পাচ্ছিলাম সেটা না তাকে কষ্ট দেয়।
“ জেরি শেষ কবে তোমার মাকে দেখেছ?”
“প্রতি গ্রীষ্মেই তার সাথে দেখা হয়। আমার জন্যই সে এখানে আসে।”
আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হল। “তুমি কেন তার সাথে থাক না? সে তোমাকে কেন এখানে ফেলে যায়?”
“সে যখনই পারে ম্যানভিল থেকে এখানে আসে। তার এখন কোন চাকরি নেই।”
মুখ তুলে আগুনের দিকে চাইলো।
“সে আমাকে চুমু দিতে চায় কিন্তু কোন ছেলেকেই তারা চুমু দিতে দেয় না। মনে আছে গত রোববার আমি একটা স্যুট পড়ে এসেছিলাম?” সে কিছুটা গর্ব করে বলল। “গত ক্রিস্টমাসে সে আমাকে এটা পাঠিয়েছে।তার আগের ক্রিস্টমাসে-” স্মৃতি আউড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ একটা জোড়া স্কেট পাঠিয়ে ছিল।”
“ রোলার স্কেট?”
আমার মন তখন আঁকছে তার মায়ের মনের অবস্থা। সে তখনো তাকে ছেড়ে যায়নি কিংবা ভুলে যায়নি। কিন্তু কেন এমন হল- আমি ভাবলাম, “তার সম্পর্কে না জেনে তাকে দোষ দেয়া ঠিক হবে না।”
“ রোলার স্কেট। আমি অন্য ছেলেদেরও ওটা দেই। তারা সবসময় সেটা আমার কাছ থেকে ধার করে নেয়, কিন্তু খুব যত্ন করে ব্যবহার করে।”
দারিদ্র্যতার চেয়ে এই অবস্থা আর কোথায় হতে পারে-
“ প্যাট কে রাখবার জন্য আমাকে যেই এক ডলার আপনি দিয়েছেন,” সে বলল “সেটা দিয়ে তাকে আমি এক জোড়া হাতমোজা কিনে দিব।”
“সেটা খুবই ভালো। তুমি কি তার মাপ জানো?” আমি শুধু এটুকুই বললাম।
“আমার মনে হয় সাড়ে আট হবে।” সে আমার হাতের দিকে তাকাল।
“আপনি কি সাড়ে আট পরেন?” সে জিজ্ঞেস করলো।
“না, আমি আরও ছোট পড়ি,ছয়।”
“ওহ!আমার মনে হয় তার হাত আপনার চেয়ে বড়।”
তার মায়ের উপর আমার ঘৃণা হচ্ছিলো। দরিদ্রতা কিংবা যাই হোক,রুটি ছাড়াও অন্য অনেক খাবার আছে যার সাথে শরীর আত্মা দুটোই মানিয়ে যেত। আর সেই বোকা মায়ের জন্য সে হাতমোজা কিনছে যে কিনা তার থেকে দূরে ম্যানভিলে থাকে আর তাকে এক জোড়া স্কেট পাঠিয়েই নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে রাখে।
“সে সাদা মোজা পছন্দ করে।” সে বলল।“আপনার কি মনে হয় এক ডলার দিয়ে আমি এটা পাবো?”
“আমার মনে হয় পাবে।” আমি বললাম।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এখান থেকে যাবার আগে আমি নিজে তার মার সাথে দেখা করে যাবো আর জানতে চাইবো উনি কেন এমনটা করলেন।
মানুষের মনের ইচ্ছেগুলো বাতাসে উড়ে চলা ছোট রেণুর মত,একটুখানি হাওয়ায় একটুখানি নড়াচড়ায় সে দিক হারিয়ে ফেলে। আমার কাজ প্রায় শেষের পথে ছিল। এটা আমাকে কোন আশাই দিচ্ছিল না আর আমার চিন্তাও অন্য দিকে সরে গিয়েছিল। লেখার জন্য আমার কিছু ম্যাক্সিকান তথ্যের দরকার ছিল।
ফ্লোরিডায় সব কিছু গুছিয়ে নিতে শুরু করেছিলাম। যদি সব কিছু ঠিকঠাক থাকে তাহলে খুব তাড়াতাড়ি ম্যাক্সিকোতে লিখতে বসে যাচ্ছি। তারপর আলাস্কায় আমার ভাইয়ের সাথে। এরপর স্বর্গ কোথায় কে জানে।
এরপর ম্যানভিলে জেরির মার সাথে দেখা করতে,এমনকি অফিসের লোকদের সাথে সে বিষয়ে কথা বলতেও সময় পাচ্ছিলাম না। আমার কাজ আর চিন্তার জন্য ছেলেটার কথা আমি প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। সে দিনের পর সে বিষয়ে আমাদের আর কথাও হয়নি এবং আমিও কিছুটা হাঁফ ছাড়লাম। এই অদ্ভুত সম্পর্ক নিয়ে সেও কোন প্রশ্ন করে নাই। সে কখনো একা বোধ করত না। এটাও আমার চোখ এড়ালো না।
সে প্রতিদিনই আসে, কাঠ কাটে আর তার পছন্দের কিছু করে আর কথা বলবার জন্য অপেক্ষায় থাকে। দিনে দিনে ঠাণ্ডা আরও বাড়তে লাগলো আর আমিও তাকে কেবিনে থেকে যেতে বলতাম। আগুনের সামনে মেঝেতে কুকুরের পাশে এক হাত রেখে সে শুয়ে পড়ত; তারা দুজনেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে আমার জন্য অপেক্ষায় থাকত। অন্য দিনগুলোতে লরেলের মধ্য দিয়ে তারা আগের মতই আনন্দ উল্লাস করত আর এস্টার যখন ফুরিয়ে আসছিল তখন সে ম্যাপেলের পাতা আর হলদে রঙের চেস্টনাট আমার জন্য বয়ে আনত। আমি যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলাম।
আমি তাকে বললাম, “তুমি আমার খুব ভালো একজন বন্ধু হলে, জেরি। তোমার কথা আমার খুব মনে হবে আর অনেক মিস করব। প্যাট ও তোমাকে অনেক মিস করবে। আমি কালই চলে যাচ্ছি।”
সে কোন উত্তর দিল না। যখন সে চলে গেল,আমার মনে আছে একটা নতুন চাঁদ আকাশে ঝুলে ছিল আর আমি দেখলাম সে নীরবে পাহাড়ের উপরে উঠে গেলো। পরদিন আমি ভেবেছিলাম সে আসবে কিন্তু সে আসেনি। সারা দিন লাগিয়ে আমার ব্যক্তিগত জিনিস গুছানো, গাড়িতে তোলা, বিছানাপত্র গুটানো,কোথায় কুকুরটা থাকবে সব কিছুই একা হাতে সামলাতে হল। আমি কেবিনটা বন্ধ করে গাড়ি স্টার্ট করলাম,দেখলাম সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ছে আর রাত নেমে আসার আগেই পাহাড়টা পার হতে চাইলাম। আমি আশ্রমের সামনে থামলাম আর মিস ক্লার্ককে কেবিনের চাবি আর বিদ্যুৎ বিলটা দিতে গেলাম।
“আর আমি কি শেষ বারের মতো জেরি কে বিদায় দিতে পারি?”
“আমি জানি না সে কোথায় আছে।” সে বলল। “আমার ভয় হচ্ছে ও মনে হয় ভালো নেই। আজ দুপুরেও সে কিছু খায়নি। ছেলেদের মধ্যে কেউ একজন ওকে লরেলের মধ্যে দিয়ে যেতে দেখেছে।
বিকেল বেলা সে মনে হয় বয়লারে আগুন দিতে গিয়েছিল। সে এমনটা না ; সে অন্যরকম বিশ্বস্ত।”
এটা আমার জন্য কিছুটা স্বস্তিকর ছিল যে তার সাথে দেখা হল না আর শেষবারের মতো বিদায় নিতে হল না।
আমি বললাম,“ আমি তার মায়ের সম্পর্কে আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাইছিলাম- কেন সে এখানে- কিন্তু আমার একটু তাড়াহুড়ো আছে বিধায় আমি সময় দিতে পারছি না। এমনকি তার সাথে দেখাও করতে পারব না। কিন্তু আমি আপনার কাছে কিছু টাকা দিয়ে যাচ্ছি এই ক্রিস্টমাস আর ওর জন্মদিনে কিছু কিনে দেবার জন্য। আমি কিছু পাঠাবার চেয়ে এটা অনেক সুবিধা হবে। আমি হুবহু একই স্কেট কিনে ফেলতে পারি।“
সে চোখ পিট পিট করে আমার দিকে তাকাল।
“এখানে কারো স্কেট নেই!” সে বলল।
তার বোকামি আমাকে ভাবিয়ে তুলল। “আসলে আমি বলতে চাচ্ছি যে ,” আমি বললাম ,“ তার মা তার জন্য যে স্কেট পাঠিয়েছে আমি যেন তেমনটা না কিনে ফেলি। আমি যদি এমন একটা পছন্দ করে ফেলি যেটা তার মা তাকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে।”
সে আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো । “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।” সে বলল । “তার মা নেই। তার কোন স্কেটও নেই।”
প্রথম অংশঃ
ম্যানভিলের এক মা- মারজোরি রাওলিং(অনুবাদ)
মূল গল্পের লিংকঃ
sh.msdpt.k12.in.us/staff/jtroyer/Stories/A_Mother_In_Mannville.pdf </a
অনেক ছোট বেলায় পড়েছিলাম মূল গল্পটা। শৈশব থেকে কৈশোর পার হওয়া সময়ে অবাক হয়েছিলাম। আজ আবার সেই পুরনো স্বাদ পেলাম। অনুবাদের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। :huzur:
অনুবাদে নানান বাংলা শব্দের ব্যবহার চমৎকার হয়েছে। তবে, কি না, পাঠক মনে একটু খটকা লাগে যখন, পড়তে গিয়ে মনে হয় অনুবাদই পড়ছি। হয়তো অনুবাদেরই বেসিক সমস্যা এটা। 🙂
অনেক ধন্যবাদ পড়বার জন্য। আর অনুবাদ……একেবারেই প্রথম। তবে ভালো লাগার মতো গল্প কিনা তাই এটা দিয়েই শুরু করলাম। দোয়া করবেন যেন আরো ভালো করতে পারি।
অসাধারণ। আবারও ভালো লাগল পড়ে।
অনুবাদ চালিয়ে যান আপু।
এর পরেরটা কিন্তু রূপান্তর করতে হবে! :beshikhushi:
ভালো লাগলো শুনে আমারও ভালো লাগলো 🙂
মজা পেয়েছি অনুবাদ করতে গিয়ে। চেষ্টা করব রূপান্তর করবার….. 😀
‘ভালো লাগলো’ শুনে আমারও ভালো লাগলো 🙂
মজা পেয়েছি অনুবাদ করতে গিয়ে। চেষ্টা করব রূপান্তর করবার….. 😀
ভালো লেগেছে আপু। 😀
থাঙ্কু ভাইয়া এতো কষ্ট করে পড়ার জন্য…… 🙂
ভাল লেগেছে। 😀 আরো চাই এরকম।
যখন মনে হবে অনুবাদ শেষ হয়েছে, তখন এমনভাবে পড়ে দেখতে পারো যেন এমনি কোন গল্প পড়ছো, অনুবাদ না। তাহলে অসঙ্গতিগুলি চোখে পড়ে। আবার কিছু জিনিস আছে যেগুলো অনুবাদ শেষ করার পর স্বাভাবিক লাগলেও কয়েকদিন পর পড়লে খটকা লাগে, তখন ঠিক করে ফেলি আমি। 😀
ওহ আপু,আপনার মন্তব্যর অপেক্ষায় ছিলাম। ধন্যবাদ।
আপনার অনুবাদগুলো দেখেই আসলে ইচ্ছা জাগল, চেষ্টায় থাকব ইনশাল্লাহ। দোয়া করবেন। 🙂
ভালো লেগেছে। 😀
আশা করি সামনে আরও ভালো হবে ।
ধন্যবাদ পিচ্চি 😀
……ইনশাল্লাহ আরো ভালো,এটা একেবারেই হাতেখড়ি।