বাবাদেরও স্যার থাকে!!!(২)

বাবাদেরও স্যার থাকে!!!(১)

ক্লাসেরই একটা ছেলের কাছে শুনেছিলাম স্যার নাকি কারাতে তে ব্ল্যাকবেল্টপ্রাপ্ত। কথাটা যাচাই করার সুযোগ হয় নি। তবে স্যারের অনুশীলিত ফিগার আর ক্লাসের দুষ্টুছেলেদের শান্ত করতে কপট রাগে পাকানো মুষ্ঠি দেখে কথাটা সত্যি বলেই মেনে নিয়েছিলাম। আমার মাঝে কারো পারসোনালিটি অনুকরণ করার আগ্রহটাও তাকে দেখেই প্রথম ও সম্ভবতঃ শেষবারের মত জেগেছিলো।

মফস্বলের একটা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম তাঁর। বাবা ছিলেন একজন ক্ষুদ্র-ব্যবসায়ী। ঢাকার মোকাম থেকে মালামাল কিনে নিয়ে ব্যবসা করতেন। আর মোকাম থেকে মালামাল ক্রয় এবং এলাকার উদ্দেশ্যে গাড়িতে তুলে দেওয়ার কাজটা বেশীরভাগ সময়ই স্যারকে করতে হত। অনেক সময় ক্লাস বাদ দিয়েও মোকামে যেতে হত। প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য ছিল না। ক্লাসই সম্বল। তাই ক্লাস শেষ হতেই স্যারদের পিছন পিছন ছুটে যেতেন ভালো করে বুঝার জন্য।

পারিবারিক অর্থকষ্টের সাথে সাথে লড়াই করতে করতেই একসময় শেষ হলো ইন্টারমিডিয়েট জীবন। অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়েও দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) স্থান করে নিলেন। সাবজেক্ট হিসেবে পেলেন গণিতকে। কিন্তু এ পর্যায়ে এসেও তাঁকে অর্থকষ্ট থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে হলো। ব্যস্ত হয়ে পড়লেন টিউশনি করে অর্থ উপার্জনে। এছাড়া আর কোনো উপায়ও যে ছিলো না। বাবার ব্যবসার অবস্থা তখন আগের চেয়েও সঙ্গীন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য আসা একটা ছেলেকে পড়াশুনার চেয়েও বেশীক্ষণ চিন্তা করতে হত বাড়িতে টাকা পাঠানো নিয়ে। ফলস্বরূপ, হতাশাজনক রেজাল্ট। আর এমনি করেই একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাও শেষ হলো; সাথে এমন একটা রেজাল্ট যেটা কোনোভাবেই তাঁর মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন করে না। তবু একাডেমিক রেজাল্টই তো সবসময় শেষ কথা নয়। যোগ দিলেন নটরডেম কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে। আর আমাদের সুযোগ ঘটলো অসাধারণ একজন শিক্ষকের সান্নিধ্যে থেকে আবাল্যের বৈরীভাবাপন্ন গণিতের প্রেমে পড়ার!

গ্রামের স্কুলের ছেলে হওয়ায় কো-কারিকুলাম এক্টিভিটিজের সুযোগ খুব কমই পেয়েছিলাম। কলেজে এসে শুরু থেকেই সেই ঘাটতিটাকে সুদে-আসলে পুষিয়ে নিতে চেয়েছি। বেসিক নলেজের ভাণ্ডারটাকে টইটুম্বুর করতে যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি; কতটুকু পেরেছি কে জানে। কলেজে ঢুকতেই উনিশটা ক্লাব যখন একযোগে হাতছানি দিতে লাগলো, আমি চারিদিক ‘বিছড়াইয়া’ এবং ‘বিচারিয়া’ তিনটি ক্লাবে এন্ট্রি করলাম- সায়েন্স ক্লাব, ডিবেটিং ক্লাব আর লেখককুঞ্জ। প্রথম সায়েন্স ফেয়ারের পর আর সায়েন্স ক্লাবমুখী হইনি; কেননা বুঝে গিয়ে ছিলাম ‘স্পন্সর করার মতো মামা’ ছাড়া ওখানে যাওয়াটা নিরর্থকই। বারোয়ারী বিতর্কের পর নিজের ডিবেটিং কোয়ালিটির ভয়াবহ অবস্থা দেখে ওদিকের পথটাও প্রায় নিরবেই ছেড়েছিলাম। লেখককুঞ্জের হয়ে আনিসুল হক স্যারের একটা সেমিনারের আয়োজনও করেছিলাম। এই ক্লাবটাতে বেশ এক্টিভও ছিলাম। কিন্তু ত্রৈমাসিক ‘Chit-Chat(ঢাক-ঢোল)’ এ স্বরচিত লেখা প্রকাশিত না হওয়ার অভিমানে তাও ছাড়লাম। মনপ্রাণ সঁপে দিলাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচীতে।

এমনি সময় হটাৎ পাঠ্যসূচি বহির্ভূত গণিতের প্রতি আকৃষ্ট হলাম। একদিকে আমার সদ্য ভিয়েতনাম(IMO) ফেরত বন্ধুর অবিরত গণিতালোচনা আর অন্যদিকে জাফর ইকবাল স্যার, মুনীর হাসান স্যার, কায়কোবাদ স্যারদের দেশব্যাপী গণিত আন্দোলন। ফলে ক্লাসের গণিতের পাশাপাশি ‘নিউরণে অনুরণন’, ‘নিউরণে আবারো অনুরণন’ সমাধান করতে লাগলাম সমান তালে। তারপর একদিন প্রিয়শিক্ষক রেজা স্যারের সাথে কথা বললাম একটা গণিত ক্লাব গঠনের ব্যাপারে। মূলতঃ এর মধ্য দিয়েই ক্লাসের বাইরেও আলাদা একটা মুখ হিসেবেই স্যারের সাথে পরিচিত হই। ফলে আমাদের ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার অনেকদিন পরেও স্যারের সাথে কলেজে বা কলেজের বাইরে যখনই দেখা হয়েছে স্যারের মুখে ছিলো সহাস্য জিজ্ঞাসা, “তুমি গ্রুপ ফোরের মারুফ না?” জানিনা, গণিত ক্লাবটা শেষপর্যন্ত গঠন করা হয়েছে কিনা।

কলেজের ডায়মণ্ড জুবিলী উপলক্ষ্যে অনেকদিন পর কলেজে গেলাম। পুরো কলেজ দাপিয়ে বেড়ালাম সারাদিন। শুধু আমরা নই; কি প্রবীণ, কি নবীন- সবাই যেন তাদের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিমাখা তারুণ্যে ফিরে গিয়েছিলো। পুরো কলেজ-প্রাঙ্গণ জুড়েই যেন আঠারো বছর বয়সের জোয়ার নেমেছিলো। এমন সময় এক অবসরে দেখা হলো স্যারের সাথে। স্যার আমাকে এতটুকু ভুলেননি! সেই পুরনো তবু প্রিয় প্রশ্নটাই করলেন,

“তুমি গ্রুপ ফোরের মারুফ না?”

আমি বিস্ময় আর খুশিতে আপ্লুত হয়ে বললাম, “স্যার আপনি এখনো ভুলেননি?”

স্যারের মুখে মৃদু হাসি। জিজ্ঞাসা করলেন কেমন আছি, কোথায় পড়ছি।

বললাম, “স্যার, আপনি যেখানে চেয়েছিলেন।”

খানিক থেমে আবার বললাম, “কিন্তু স্যার, আপনার একটা স্বপ্ন এখনো পূরন করতে পারিনি।”

স্যার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।

“সেই যে আপনি বলেছিলেন, তোমার সাথে থাকবে বিপরীত লিঙ্গের বিশেষ একজন আর ছোট্ট একটা বাবু! তখন তুমি আমার সাথে সেই বিপরীত লিঙ্গের বিশেষ একজনকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলবে, ইনি আমার স্যার।আর বাবুটা তখন অবাক হয়ে ভাববে, বাবাদেরও স্যার থাকে…” স্যারের সাথে সম্পর্কটা ছিলো অনেকটা বন্ধুর মতো। তাই হাসতে হাসতেই বলে ফেললাম।

স্যার মৃদু হেসে বললেন, “তুমিও তো কিছুই ভোলো নি দেখছি…”

Sir, you are my icon. How can i forget u???

বাংলামায়ের ছেলে সম্পর্কে

বাইশবছরের তরুণযুবা, যে স্বপ্ন দেখে আকাশছোঁয়ার, পথ চলে অফুরান আত্মবিশ্বাসে। ভীষণ ভালোবাসে এই দেশটাকে, চেষ্টা করে রাজনীতি সচেতন থাকার। ভালাবাসে লেখালেখি করতে। কখনো কখনো মুখভর্তি দাঁড়ি-গোঁফে হেঁটে ফিরে চাঁদনী রাতে কিংবা ভরদুপুরে, পিচঢালা রাস্তায় কিংবা গেঁয়ো মেঠোপথে। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। পাশাপাশি জড়িত আছে বেশকিছু দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমের সাথে। এইতো---
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে অনুপ্রেরণা, ইতিবাচক, স্মৃতিচারণ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

16 Responses to বাবাদেরও স্যার থাকে!!!(২)

  1. সামিরা বলেছেনঃ

    অসাধারণ। খুব ভাল লাগলো পড়তে।
    এত বেশি কিনা জানি না, তবে অনেক শ্রদ্ধার কিছু টীচার আমারও ছিল, স্কুলে বিশেষ করে। তাদের নিয়ে লিখবো ভাবি মাঝে মধ্যেই।

    • বাংলামায়ের ছেলে বলেছেনঃ

      ধন্যবাদ সামিরা…

      শ্রদ্ধেয় এবং প্রিয় শিক্ষকদের নিয়ে আপনার লেখা পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম…

  2. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    আগের পর্বে বেশ কিছু দুর্বলতা ছিলো। এইটা একটা সলিড পোস্ট হইছে।
    খুবই ভালো লাগছে।

    আসলেই নটরডেম এ একটা গণিত ক্লাব দরকার!

    • বাংলামায়ের ছেলে বলেছেনঃ

      আমারও তাই মনে হয়েছে। আগের পর্বটা সম্ভবত সূচনাতেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।

      আমি ভার্সিটিতে উঠে ব্লগিং শুরু করেছিলাম। এখন তো অনেক স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদেরকেও ব্লগিং এ দেখি। সরবে কি নটরডেমে পড়ছে, এমন কেউ আছে? থাকলে তাদেরকে এ ব্যাপারে তাদের শিক্ষকদের সাথে কথা বলতে বলবো। নটরডেমে একটা গণিত ক্লাব সত্যিই দরকার।

  3. শারমিন বলেছেনঃ

    ভালো লেগেছে 😀

  4. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    পুরনো অনুভূতিগুলো সত্যিই দারুণ!
    বেশ লাগল। 🙂

    • বাংলামায়ের ছেলে বলেছেনঃ

      ধন্যবাদ 🙂

      অতীতের সালতামামি আর ভবিষ্যতের গুনগুনানি- দুটোই আমার ভীষণ প্রিয়। আর সেজন্যই হয়তো মাঝেমাঝেই নিজেকে এই বর্তমানের দুনিয়াতে বড় বেশি অপাংতেয় মনে হয়…

      আপনার জন্য শুভকামনা…

  5. shupty বলেছেনঃ

    🙂 khub valo laglo. Smriti gulote hariye jete isse kore sob somoy.

  6. মুবিন বলেছেনঃ

    বেশ ঝরঝরে লেখা। পড়তে ভালো লাগে এমন লেখা।

    প্রথম দুইটা পর্ব একসাথে দিলেই পারতেন। খুব একটা বড় ছিল না লেখা দু’টি।

    • বাংলামায়ের ছেলে বলেছেনঃ

      হুমম, দেয়া যেতে পারতো। আর অনেকটা এজন্যই দু’টো পর্বের মধ্যে খুব একটা দেরিও করি নি।

  7. ইফাত বলেছেনঃ

    আমি নটরডেমের ছাত্র নই। তবে আমার সৌভাগ্য যে আমি রেজা স্যারের কাছে পরার সুযোগ পেয়েছি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।