একেকবার কিছু লিখে শেষ করার পর মনে হয়, আমার আর কোনদিনও কিছু লেখার ক্ষমতা হবে না। কিছুদিন পর নিজের লেখা পড়তে গিয়ে মনে হয়, এগুলো আমি লিখেছি! এরকম তো আর কখনোই পারবো না…
অথচ একবার লিখতে শুরু করার পর কেমন সরসর করে এগিয়ে যায়। কিন্তু সেই শুরুর আগের সময়টা এত কষ্টের! টুকটাক লেখালেখির দরজায় একবার পা দেওয়ার পর পেছনে ফিরে তাকানোর মত, আর লিখতে না পারার মত ভয়ানক কিছু নেই বোধ হয়।
কোন এক লেখকের সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম বেশ আগে, তিনি কেন লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছেন। তার মনে হয়েছিল তার লেখাগুলো সব অনর্থক, এমন করে সময় আর শক্তি নষ্ট করার মানে নেই। পড়তে পড়তে ভাবছিলাম অস্কার ওয়াইল্ডের কথাটা, “শিল্পমাত্রই অনর্থক, অপ্রয়োজনীয়”।
আমাদের একসাথে অনেক দূর বেড়াতে যাওয়া হয় না। পাহাড় আর ঝর্ণা আর অন্যরকম সবুজের মাঝে যাওয়া হয় না। ধারেকাছের একটু কম সুন্দর জায়গাগুলো দিয়ে ঘোরাঘুরি করি। নৌকায় করে বিশাল নদীর বুকে ঢেউয়ের সাথে দোল খেয়ে ফিরে আসি। নদীর পাড়ে পা ভেজাই। তারপর খটখটে রোদ পড়ে গেলে ফিরে আসি সবুজ থেকে ধূসরে, ভেজা থেকে শুকনোয়।
আমাদের দিনগুলো কেমন নীরস আর গোমড়া আর অনিচ্ছুক, তাই না? আমাদের কিছু করার নেই আর আমরা এখন ঘুম ঘুম চোখে একঘেয়ে কথাগুলো শুনি কেমন মনোযোগ দিয়ে। কারণ আমাদের সবার কাছে ওসব একঘেয়ে লাগে না আর যাদের কাছে লাগে, তারাও অবাক হয়ে ভাবতে থাকি যে এমন জিনিস কী করে ভাল লাগতে পারে কারো। ভাবতে ভাবতে তাদেরও একঘেয়েমিতে পায়।
কে যেন বলছিল, বড় হতে হতে ভেতরের ‘স্পার্ক’টা মিইয়ে আসে, হঠাৎ হঠাৎ যেমন জ্বলে উঠতে পারতাম একসময়, সেটা আর পারি না। আমরাও কেমন একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছি আর কেমন বিরক্ত থাকি সবসময়। আমাদের কেন যেন এরকম থাকতেই ভাল লাগে।
আমাদের হাসিঠাট্টা আর আনন্দগুলো কৃত্রিম হয়ে যাচ্ছে নিজেদেরই অজান্তে। জীবন যাপন করতে করতে কেমন ক্লান্ত আমরা, অন্তত দেখলে তাই তো মনে হয়। নতুন কিছু করতে গেলে আমাদের শুরুতেই মনে হয় ‘কী হবে করে?’ আর তারপর আমরা পিছিয়ে আসি, যারা থাকি তারাও কেমন বিষণ্ন আর উদ্ভ্রান্তের মত এগিয়ে যাই।
তারপর কোন এক রাতের বেলায়, হয়তো আমাদের ইচ্ছে করে চাঁদের আলোর নিচে একটু শুয়ে থাকতে। এই ছোট্ট অভয়ারণ্য আমাদের সেই শখ পূরণ করে। কিন্তু ঘাসে পা রাখতেই আমাদের মন একটু খারাপ হয়ে যায় যখন দেখি সোডিয়াম আলো দিয়ে ওরা চাঁদের আলোর গলা চেপে ধরেছে। বাধ্য হয়ে আলো থেকে একটু দূরে ঘাসের ওপর বসে আমরা ভাবার চেষ্টা করি যে চারপাশে আসলে জ্যোৎস্না ছাড়া আর কিছু নেই। হঠাৎ কোন নরম বাতাস এসে বেলী না কী যেন এক ফুলের গন্ধ এনে নাকে ধাক্কা দিয়ে আবার পালিয়ে যায় সাথে সাথেই। তখন আমাদের মনে পড়ে, আগে যেমন রাস্তা থেকে ফুল কিনলে গন্ধ পাওয়া যেত, এখনকার ফুলগুলোতে তেমন কোন গন্ধই নেই।
রাত বাড়লে শিশির পড়ে ঘাসগুলো ভিজে ওঠে, আর আমরা মনে মনে কুঁকড়ে উঠি কাপড়টাও ভিজে যাচ্ছে কিনা তাই ভেবে। কিন্তু সেদিন কী যেন হয় আমাদের, তাই কেউ সেটা মুখে বলি না। হঠাৎ কখনো মূহুর্তের লোডশেডিং-এ চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায় আর যেই না আমরা এই ভেবে খুশি হয়ে উঠতে যাই, যে এইবার কেবল আমরা আর চাঁদ, ওমনি আবার সব আলো জ্বলে ওঠে। আর আমাদের উজ্জ্বল হয়ে ওঠা মুখগুলোতে অন্ধকার নেমে আসে।
আমরা কিছু অনর্থক তর্ক করি আর জিততে থাকলে মনে মনে নিজের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে উঠি। আমরা এমন সব ভবিষ্যতের তর্ক করি যা নিয়ে আমাদের তেমন কোন ধারণাই নেই। সে জীবন যে আমরা এখনো যাপন করি নি!
যাদের তর্ক ভাল লাগে না তারা তখন উঠে চলে যাই কিংবা শিউলির মত দেখতে যেই ফুলগুলো, শিউলির মতই যারা গাছের নিচে স্তুপ হয়ে পড়ে থাকে, কিন্তু কমলা বোঁটা নেই কেবল শিউলির মত – সেই ফুলের গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। তারপর কাঠগোলাপ আর সূর্যমুখীর গায়ে হাত বুলিয়ে দেখতে আসি তর্ক ফুরিয়েছে কিনা।
আমরা ভাবতে থাকি যে আমাদের একসাথে থাকার সময় ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু তাতে আমাদের তেমন দুঃখবোধ হয় না, কারণ এখন আমাদের খুব বেশি একসাথে থাকতে ইচ্ছাও করে না। কিংবা করলেও সেটা মেরুকৃত ইচ্ছা, বেছে বেছে দু’একজনের জন্য আলাদা করে লালন করা ইচ্ছা।
তারপর যখন একদলা মেঘ এসে প্রিয় চাঁদটাকে ঘিরে ফেলে, তখন আমাদের গলার কাছেও মেঘের মতই কী যেন ঘনিয়ে ওঠে। যখন লাল রঙ্গন আর ঐ হলুদ রঙের বড় ফুলটা, আর সেই যে সাদা রঙের শিউলির মতন কিন্তু শিউলি না যেই ফুল সেটা – ওরা সবাই যখন একসাথে ফুটে থাকে আর সাথে অনেক অনেক কলিও থাকে, তখন খুব নরম একটা বাতাস এসে এই আটপৌরে শহরের অচন্দ্রস্পশ্যাদের গা ছুঁয়ে যায়, আর তারা ঘাসের ওপর শুয়ে থাকতে পারে, আর ঐ মেঘ আর তারা আর লুকোনো চাঁদের সাথে কথা বলতে পারে, আর গুনগুন করে গাইতে পারে (জানোই তো গলা ছেড়ে গান গাওয়া ওদের কখনোই আসে না), আর ভুলের কথা ভাবতে পারে। স্বপ্নও দেখে একটু-আধটু।
তারপর? তারপর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমে আসে আর গাছের নিচে যেই শিউলির মত ফুলগুলো মন খারাপ করে ঝরে পড়ে ছিল, ওরা ভিজে চুপচুপ করতে থাকে। সেই সাথে ঘাসে শুয়ে থাকা মানুষগুলোর মনও।
সেই ভেজা মন নিয়ে একসময় তারা ঘুমিয়ে পড়ে, পরের দিন আবারও সেই একই একঘেয়ে আর উদ্ভ্রান্ত, নীরস আর বিষণ্ন, পুরনো মানুষ হয়ে জেগে উঠবে বলে। চক্রে বাঁধা এমন সব রাত আর দিন, চলতেই থাকে, চলতেই থাকে…আর কখনো শেষ হবে না বলে। নাকি হবে?
বিষণ্ণ হবার মত লেখা…জীবনটা আসলেই যান্ত্রিক হয়ে গেছে… 🙁
🙁
অচন্দ্রস্পশ্যা শব্দটা বাংলায় নতুন সংযোজন।
সোডিয়াম আলো দিয়ে ওরা চাঁদের আলোর গলা চেপে ধরেছে – দারুণ লাগে এই সব লাইন আমার!
থ্যাঙ্কু মেঙ্কু! 🙂
কেমন উদাস উদাস লাগছে লেখা পড়ে।
বরাবরের মতোই চমৎকার!
🙂 লিখতে বসছিলাম পুরাই অন্য জিনিস, লেখার পর দেখি এই অবস্থা!
😛
বিষন্ন কথামালা………:(
সবকিছুর মাঝে বিষন্নতার একটা ছোঁয়া… কেমন যেন… কেমন যেন…… 🙁
এত বিষণ্ন লাগলো! 😳
ভাল লাগল
ধন্যবাদ। 🙂
ভালো লেগেছে 🙂
কিন্তু মনটা কেমন জানি খারাপ হয়ে গেলো।
কী যে লিখলাম নিজেই বুঝলাম না। 🙂
নিশাচরের পোস্টে নিশাচর না হয়ে কি আর মন্তব্য করা যায়? তাই এই আঁধারঘন রাতেই বসলাম মন্তব্যের খাতা খুলে।
এটা সত্যি যে মাঝে মাঝে বিষণ্ন হই, হতাশ লাগে। তবু এখনো শিউলির গন্ধ পাই। কাজের ফাঁকেই অন্যকিছু খুঁজে নেয়া যে আমার স্বভাব! সেই স্বভাব থেকে এখনো বেরোতে পারি নি!
হয়ত এই ই বেশ, এখনো জীবনের আস্বাদ টের পাই, বৃষ্টির স্পর্শে কেঁপে উঠি।
আমি যে বড্ড শেকল ছেঁড়ার দলে!
লেখাটা কি আসলেই দুঃখ দুঃখ হইছে? অবাক হলাম, কারণ লেখার সময় সেরকম কিছু মাথায় ছিল না। তবে সমস্যা নেই, একটা লেখা প্রত্যেকে যার যার মত বুঝে নেবে – এখানেই তো মজা। 🙂
না তো! আমি তো বলি নাই যে লেখা দুঃখ দুঃখ হইছে! বলবই বা কেন? দুঃখ দুঃখ হয় তো নাই!
লেখাটা উদাস উদাস হইছে।
দুঃখ আর উদাস বিভোর কথকতা দুটো অনুভূতি এক নাকি? একদম না!
তোর নিজস্ব লেখার এই একটা গুণ।
এজন্যই তোর লেখা পড়তে আমার দারুণ লাগে সবসময়। :beshikhushi:
সবাই বিষণ্ন বলতেছে, এই জন্য বললাম। 🙂
সবাই বলছে কিন্তু আমি তো বলি নি! 😐
আহ… কি সহজ করে এতো কষ্টকর কিন্তু সত্য কথাগুলো বলে দিলেন।
কষ্টের পাশাপাশি ভালো লাগলো। :clappinghands:
ধন্যবাদ পড়েছেন তাই।
লেখা শুরুর আগে যা লিখবো ভেবেছিলাম, লেখার সময় যা লিখছি ভাবছিলাম আর এখন যা দাঁড়িয়েছে – কোনটার সাথে কোনটার মিল খুঁজে পাচ্ছি না কেন যেন।
মানুষের মন, বড়ই বিচিত্র 😀
এই মেয়েটার লেখাগুলা মাশাআল্লাহ সবসময়ই ভালো লাগে 🙂
প্রথমে অনুবাদ মনে হচ্ছিলো… “আমাদের দিনগুলো কেমন নীরস আর গোমড়া আর অনিচ্ছুক, তাই না?”… “অনিচ্ছুক” কথাটা দিয়ে অনুভূতিটা এমনভাবে অনুভব করা গেলো… ঠিক নিজের মনের ভেতর যেমন লাগে 🙂
আগে মনে হতো কিছু কথা কখনো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, এখন দেখা যাচ্ছে বেশ ভালোভাবে যায়!! 😀
😀 ধন্য হলাম আপু!
‘অচন্দ্রস্পশ্যা’ শব্দটা বেশ তো!
এই বিষাদের গন্ধ মাখা লেখাগুলো আমার খুব ভালো লাগে আর আপন মনে হয়। মন খারাপ হয় না মোটেই।
লেখার ধারায় কিছুটা অনুবাদের এসেন্স পাচ্ছিলাম মনে হচ্ছিল। 😉
হাহা। অনুবাদ করতে করতে চিন্তাভাবনাও অনুবাদ অনুবাদ হয়ে গেছে মনে হয়!
‘তিথিডোর’ বইতে এমন একটা কথা ছিল। মন খারাপ লাগাকেও তো ভালো লাগে অনেক সময়। মন খারাপ মানেই সবসময়ে খারাপ কিছু নয়। 🙂