হলিউডের গাদাখানেক অ্যাকশন মুভিতে নারী চরিত্র দেখে আমরা সবাই অভ্যস্ত। কিন্তু বাংলা মায়ের বুকে নারী সবসময় মমতাময়ী আর কোমল; লজ্জা আর স্নেহময়তার প্রতীক হিসেবেই সমাদৃত। নারীর কোমলতাই স্বভাবজাত, নন্দিত, অত্যন্ত স্বাভাবিক। আমি মোটেও একে খাটো করে দেখি না। তবে আমার খুব অন্যরকম একটা ভালো লাগার অনুভূতি জাগে যখন দেখি কোমলতা আর কঠোরতার এক অদ্ভূত সুন্দর সমন্বয় ঘটেছে। বিদ্রোহী কবিও বুঝি এমন করেই ভেবেছিলেন,
“জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা।
জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্ত–টীকা।
দিকে দিকে মেলি তব লেলিহান রসনা,
নেচে চলে উন্মাদিনী দিগবসনা,
জাগো হতভাগিনী ধর্ষিতা নাগিনী
বিশ্ব–দাহন তেজে জাগো দাহিকা।”
পুরো গানের কথাগুলিতে একটা কেমন উন্মাদনা আছে, জয় করার বাসনা আছে, অন্যায়ের শৃংখল ভেঙ্গে জেগে ওঠার আর্তি আছে। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের যখন নারীর পণ্যায়ন, নির্যাতন, শ্লীলতাহানি, মানহানির মত ঘটনাগুলো অহরহ দেখতে হচ্ছে, তখন প্রশ্ন জাগে আসলেও কতটা পরিবর্তন ঘটেছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির। পরিবর্তনের ধারাটা কোন কোন ক্ষেত্রে কি খুব বেশি অধঃগামী হয়ে যাচ্ছে কিনা সেটাও দেখার সময় এখনই।
যাই হোক আর ভূমিকা না করি। নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে বাঙালি দুইজন নারীকে আমরা সবাই চিরদিন মনে রেখেছি আর রাখব। এঁরা হলেন বেগম রোকেয়া আর কবি সুফিয়া কামাল। এঁদের কর্মক্ষেত্র মূলত শিক্ষা এবং সাহিত্যকেন্দ্রিক ছিল। তবে আমি এমন কিছু নারীচরিত্রের কথা বলতে চাই যাঁরা সরব করে গিয়েছেন ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশের স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস। এঁদের সবার কীর্তির কথা হয়তো আমরা সকলে অতটা জানিও না। জানানোর একটা ক্ষুদ্র প্রয়াস নিলাম। একটি লেখায় এতজনের কথা বলা সম্ভব নয় বলে সিরিজ আকারে দেয়ার চেষ্টা করছি।
লক্ষ্মী বাঈ (ঝাঁসীর রাণী)
এ ছবিটি যাঁর আমরা সকলেই স্কুলে সমাজ বইয়ের ইতিহাস অংশে তাঁর কথা জেনেছি যদিও তা ছিল খুব স্বল্পপরিসরে। তিনি হলেন ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈ । ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতবর্ষের ইতিহাসে তিনিই ছিলেন মোটামুটি প্রথম সফল নারী যোদ্ধা।
লক্ষ্মী বাঈ (১৮৩৫-১৮৫৮) মহারাষ্ট্রের মারাঠী করাডে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। চার বছর বয়সেই তিনি মাতৃহারা হন। পারিবারিক পরিবেশে বাড়িতে শিক্ষালাভ করেন। আত্মরক্ষামূলক শিক্ষালাভের পাশাপাশি ঘোড়া চালনা, আর্চারী শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন তিনি। এছাড়াও তিনি তাঁর বান্ধবীদেরকে নিয়ে নিজস্ব একটি বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। ১৮৪২ সালে ঝাঁসীর মহারাজা গঙ্গাধর রাও নিওয়াকরের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন লক্ষ্মী বাঈ। এভাবেই তিনি ঝাঁসীর রাণী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।মজার ব্যাপার হল, সিনেমার কাহিনীর মতই টানটান উত্তেজনায় ভরপুর এই মহিয়সীর বীরত্বগাঁথা।
সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে লক্ষ্মী বাঈয়ের বীরত্বপূর্ণ অবদানের কারণে নিরাপদে তাঁর সৈন্যরা ঝাঁসী ত্যাগ করতে পেরেছিল। সেই ভয়াবহ যুদ্ধের সময়েও তাঁর সুদূরপ্রসারী নেতৃত্বে ঝাঁসীর পরিবেশ শান্তিপূর্ণ ছিল। সেই সময় ব্রিটিশ সৈন্যরা লর্ড স্ট্রাথনায়র্নের নেতৃত্বে ঝাঁসীর কাছেই ঘাঁটি গেড়ে বসে। অবশেষে ১৮৫৮ সালের ২৩শে মার্চে ঝাঁসী অবরোধ করে ফেলে ব্রিটিশরা। লক্ষ্মী বাঈ কাপুরুষের মত চুপ করে এইভাবে অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকার মত মানুষ ছিলেন না। তিনি তাঁর সৈন্যদল নিয়ে ইংরেজদের সামনে এসে দাঁড়ান। তাঁকে সহায়তা করতে বিশ হাজার সৈন্য নিয়ে তাতিয়া তোপে নামক আরেক বিদ্রোহী এগিয়ে আসেন। খুব অবাক করা বিষয় হল ইংরেজ সৈন্যসংখ্যা ছিল এই তুলনায় খুব কম, মাত্র পনেরশ। কিন্তু সৈন্য কম হলে হবে কী, ওরা ছিল অনেক বেশি দক্ষ আর উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সেই তুলনায় অনেক বেশি অনভিজ্ঞ সৈনিকদল নিয়ে তাতিয়া তোপে সুবিধা করতে পারে নি। কম সৈন্য নিয়েও তাই ৩১শে মার্চ অবস্থা পুরোপুরি ইংরেজদের আয়ত্ত্বে চলে যায় এবং তারা ভয়াবহ আক্রমণ শুরু করে। এই আক্রমণের তিন দিন পর ঝাঁসীর দুর্গের দেয়ালে ফাটল ধরে এবং ব্রিটিশরা অনায়াসেই পুরো শহরের দখল নিয়ে নেয়। লক্ষ্মী বাঈ এর আগেই বিপদের আঁচ করেছিলেন। সন্তানকে বুকে নিয়ে তিনি রাতের আঁধারে দুর্গের দেয়াল থেকে লাফ দিয়ে পালান। এ সময় তাঁর নিরাপত্তার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মেয়েদের একটি দল তাঁকে পরম মমতায় ঘিরে রেখেছিল। বোঝাই যাচ্ছে উনি সকলের কত শ্রদ্ধার পাত্রী ছিলেন। মমতা আর বীরত্বগাঁথার এ এক অপূর্ব মেলবন্ধন!
এরপর রাণী তাঁর বাহিনী নিয়ে কাল্পীতে যান। ব্যবসা-বাণিজ্যে এই শহরটি বেশ সুনাম কুড়িয়েছিল। সেখানে তিনি তাতিয়া তোপেসহ অন্যান্য বিদ্রোহী বাহিনীর সাথে যোগ দেন। রাণী এবং তাতিয়া তোপে গোয়ালিয়রের দিকে যাত্রা শুরু করেন। সেখানে তাদের যৌথবাহিনী গোয়ালিয়রের মহারাজার বাহিনীকে পরাজিত করে। পরাজিত এই সৈন্যরা পরে রাণী ও তাতিয়ার যৌথবাহিনীতে যোগ দেয়। এই বাহিনীতে অন্যতম নেতৃত্বপ্রদানকারী হিসেবে লক্ষ্মী বাঈ গোয়ালিয়রের কেল্লা দখল করে নেন। ১৮৫৮ সালের ১৭ই জুন ফুলবাগ এলাকার কাছাকাছি কোটাহ-কি সেরাইয়ে নামক জায়গায় রাজবাহিনীর সাথে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে শহীদ হন এই মহান নারী। আরও তিনদিন পর ব্রিটিশেরা গোয়ালিয়র দখল করে। যুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়,
“রাণী তাঁর সহজাত সৌন্দর্য, চতুরতা এবং অসামান্য অধ্যবসায়ের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। এছাড়াও, তিনি বিদ্রোহী সকল নেতা-নেত্রীর তুলনায় সবচেয়ে বিপজ্জনক ছিলেন।”
১৮৭৮ সালে কর্ণেল ম্যালসন তাঁর “দ্যা হিস্ট্রি অব দ্যা ইন্ডিয়ান মিউটিনি” গ্রন্থে লক্ষ্মী বাঈ সম্পর্কে বলেন,
“… তাঁর জনগণ সর্বদাই তাঁকে স্মরণ করবে। তিনি নিষ্ঠুরতাকে বিদ্রোহের পর্যায়ে উন্নীত করার মাধ্যমে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি জীবিত আছেন এবং স্বীয় মাতৃভূমির জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।”
সম্প্রতি ২০১১ সালের ১১ই জুলাই টাইম ম্যাগাজিনে লক্ষ্মী বাঈকে বিশ্বের শীর্ষ ১০ জন বীর রমণীদের একজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই তালিকায় তাঁর স্থান অষ্টম।
কেউ যদি ভারতের ঝাঁসী কিংবা গোয়ালিয়র যান কখনও এইরকম ভাস্কর্য চোখ এড়ানোর কথা না। ব্রোঞ্জের তৈরি ভাস্কর্যটি জানান দিয়ে যাচ্ছে এই বীরাঙ্গনার মহান কীর্তিগাঁথা।
(চলবে)
ছবি ও তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া
সাবলীল লেখা।সুন্দর হয়েছে।
চলুক….
ধন্যবাদ রইল… 🙂
ভালো লেগেছে আপুনি 😀
চমৎকার উদ্যোগ
কারণ আসলে আমরা তেমন জানিই না নারীদের স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা
আর কোমলতা আর কঠোরতার সমন্বয় খুব সুন্দর সমন্বয়
আমারও খুব ভালো লাগে
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম
অনেকগাছি ধনেপাতা আপুটা ! চেষ্টা করব তাড়াতাড়ি দেয়ার ইনশাআল্লাহ… 🙂
লক্ষ্মী বাই, লক্ষ্মী বাই, এই সময়েও তোমারে চাই।
লক্ষ্মী বাইয়ের কথা জেনে ভালো লাগছে। আমাদের প্রীতিলতা, হেনা দাশ এদের গল্প শোনার অপেক্ষায় থাকলাম। প্রয়োজনীয় পোস্ট। লেখককে ধন্যবাদ।
হেনা দাশ আর প্রীতিলতা আসছে ইনশাআল্লাহ…
আপনাকেও ধন্যবাদ পড়ার ও মন্তব্য করার জন্য 🙂
ভালো লেগেছে।
মেয়েদের আসলে জানানো দরকার, মডেল কন্যা আর নায়িকারা ছাড়া আরো রোল মডেল আছে তাদের। “Intelligence is sexy!” – সাহসিকতাও তাই, স্বাধীনতাও। ২০১৩ সালেও যখন মেয়েদের কাছে বিদ্রোহ মানে রাস্তায় টপলেস নেমে আসা, এর চাইতে বড় পরিসরে চিন্তা করতে শিখি নি যখন আমরা অনেকেই, বহ্নিশিখাদের কথা প্রচার করার প্রয়োজন তাই এখনো ফুরোয় নি – বোঝাই যাচ্ছে। 🙂
মডেল কন্যা বা নায়িকাদের রোল মডেল বানানোর চিন্তাটাই অসুস্থ লাগে আমার !! টপলেস বিদ্রোহ বা উল্লাস আরেক ধরনের অসুস্থ শ্রেণির লোকেরা করে 🙁
আমাদের অনেক অনেক বহ্নিশিখা দরকার আসলে। বাই দ্যা ওয়ে এইরকম একটা কথা আরেকজনের কাছে শুনেছিলাম “Intelligent is sexy”…!! যার পর নাই মনে ধরেছিল 😀
টাইপো…*Intelligence
আপু সিরাম ।খুব ভালো একটি উদ্যোগ নিয়েছেন এভাবে সিরিজ আকারে প্রকাশ করে ।
:love: