[অপ্রিয় সত্যটাকে অস্বীকার না করেও কীভাবে ভাল দিকগুলো তুলে আনা যায় – সেটা বোঝাতেই এই সত্য/অর্ধসত্য/কাল্পনিক ঘটনাগুলোর অবতারণা ]
একটি জানালা। সামনে অনেক.. দূর পর্যন্ত সবুজ মাঠ। উপরে নীল আকাশ। সাদা মেঘ। আকাশ এত নীল হয়, এখানে না এলে রাসেলের কোন দিন জানাও হতনা। আত্মীয় স্বজন থেকে বহুদূরে প্রবাসে এই জানালাটাই তার দিন রাত্রির বন্ধু হয়ে আছে। এক কাপ চা বানিয়ে তাই জানালার ধারে বসে আপন মনে ভাবতে থাকে সেই অতি পুরনো ভাবনাগুলোই –
“কেন এলাম এখানে? জন পরিচয়, বন্ধুহীন এই অদ্ভুত পরিবেশে? ডলারে থোক করা ছাত্রবৃত্তির মোহ কী করে স্ত্রী, সন্তান – সবকিছুর চেয়ে বড় হয়ে গেল?” বাড়ি ছেড়ে যেদিন এসেছে, সেদিন ছেলেটা নতুন শেখা হামাগুড়ি প্র্যাক্টিস করতে করতে বাবার কাছে আসে প্রথমবার। এ দৃশ্যটা মনে করে কত বার যে চোখের পানি ফেলেছে..! ওর স্ত্রী বার বার বলত, “কী হবে একটা মাস্টার্স করে? এখানেই যে চাকরি আছে, করো না!”
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার ওসব মনে করে রাসেলের কেবল বিদ্বেষ বাড়তে থাকে। নিজের ওপরে, এই চাকচিক্যের ওপরে.. বিদেশ ফেরত তকমাটার লোভের ওপরে… প্রায় প্রতি রাতেই হতাশা আঁকড়ে ধরে, আর হিসেব মেলায়, কী ফেলে আসল, কী পেল! সবাই বলে, ধৈর্য ধর, আর ত ক’টা দিন! এক বছর পরেই ত ফিরে যাচ্ছ! কিন্তু রাসেল কেবল অনুশোচনায় দগ্ধ হয়, কেন এলাম, কেন?
রাসেলের খুব ইচ্ছে ছিল দেশে নিজের মত করে ছোট্ট করে ব্যবসা বা জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান করবে। নিজেকে সবসময় ওভাবেই তৈরি করেছে। হুট করে কথা নেই বার্তা নেই বাইরে পড়তে আসার এই সিদ্ধান্ত যে কেন নিল.. আসার পর থেকে এই প্রশ্নটাই শতশতবার ওলট পালট করেছে মনের মধ্যে। যত ভেবেছে, ততই জায়গাটার প্রতি মন বিষিয়ে উঠেছে। দিন যেন কাটতেই চায়না, চারপাশে নতুন যাই দেখে – মনে হয়, এর চেয়ে আমাদের দেশে কত ভাল! কেন পড়ে থাকে মানুষ এখানে? কী সুখ?
:
:
:
:
রাসেলের সাথে কাজ করে ভাবুক এক ছেলে। ঋষি ঋষি চেহারা। কথাগুলোও অমন। তার সাথে প্রায়ই আলোচনা হয় দর্শন নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে, বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে। একদিন তার সাথে প্রবাসে আসা নিয়ে আফসোস করায় সে বলে –
“তুমি পাওলো কোয়েলহোর ‘দি আলকেমিস্ট’ বইটা পড়েছ? ওখানে একটা রাখাল ছেলে আন্দালুসিয়ার এক ভাঙা চার্চের ছায়ায় একরাতে স্বপ্ন দেখে, মিশরের পিরামিডের কাছে গেলে সে গুপ্তধন পাবে। অনেক কষ্ট করে, কয়েক বছর ব্যয় করে ছেলেটা সেখানে পৌঁছায়। কিন্তু পৌঁছানোর পর জানতে পারে, গুপ্তধন পোঁতা আছে সেই আন্দালুসিয়ার চার্চের নিচেই! বাতাসকে সে জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি আমাকে প্রথমবারই হদিস দিলে না কেন?’ বাতাস বলে, ‘তাহলে ত তুমি আর পিরামিড দেখতে যেতেনা। তারা কী সুন্দর! তাই না?’ তুমি ত তারিক রামাদানকে চেন। সে এ গল্পটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছে – যে মানুষটা আন্দালুসিয়া ছেড়ে গেছে, আর যে ফিরে এসেছে, সে এক মানুষ না। তাদের মধ্যে আছে মিশর সমান ব্যবধান। এই গুপ্তধনের মর্ম বুঝতে তাকে মিশর যেতে হতই।”
রাসেল কেবল ভাবে আর ভাবে। হাতের চা ঠান্ডা হয়ে আসে। মাঠের দিকে আনমনে তাকিয়ে থেকে সে বুঝতে পারে, ছেলেটা তাকে কী বলেছিল। এই ছেলেটার থেকে সে অনেক শিখেছে, জীবনের সাথে দর্শনকে কীভাবে মেলানো যায়, অন্যদের চেয়ে অন্যরকম করে কীভাবে ভাবা যায়.. তাছাড়া নচ্ছার এই প্রবাসজীবনও কি কম দিয়েছে তাকে? একা থাকা মানেই স্বাবলম্বী হওয়া। কাজে কর্মে স্বচ্ছতার নতুন মাত্রা শিখেছে। অনেকগুলো দায়িত্ব অষ্টপ্রহর আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখেনি, তাই চিন্তার দুয়ার খুলে দিতে পেরেছে। সব চেয়ে বড় কথা, গত এক বছরে লক্ষবার নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে, সম্পর্কগুলোকে, দায়িত্বগুলোকে সবটুকু যত্ন দিয়ে পালন করবে এখন থেকে। আপন মানুষগুলোর কাছে আছে, এই আনন্দেই প্রতিটা মুহূর্ত ভাল চিন্তা, ভাল কাজ দিয়ে ভরিয়ে রাখার চেষ্টা করবে। আর নিজের প্রতিষ্ঠান? হ্যা, ওটাকেও দাঁড় করাতে হবে। কষ্ট হবে? হোক! নিজেকেই নিজে বলে, “কত কাজই ত দেশে করার কথা কল্পনাও করতে পারিনি, এখন করছি না? পারব!”
রাসেলের বুক থেকে হঠাৎ করে বিরাট এক পাথর নেমে যায়। “এ দেশ আমার জন্য না”, মনে মনে ভাবে, “আমার রত্নভান্ডার দেশেই। কিন্তু তার মূল্যায়ন করতে এই নির্বাসনটার আমার দরকার ছিল।”
আর্ট অব এপ্রিসিয়েশন ১: http://nusrat807.blogspot.com/2012/04/blog-post_15.html
ছোট কিন্তু অনেক সুন্দর একটা লেখা।
ভালো লাগলো বেশ।
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লেগেছে। 🙂
ধন্যবাদ।
অসাধারণ লাগলো আপু।
আফসোস লাগছে, এত দিন পড়ে পড়ছি বলে।
দ্যা আলকেমিস্ট পড়ার পরও এই সুন্দর মিলটা আমি নিজ থেকে খুঁজে পাই নি।
রত্নরাজির খোঁজে সব মানুষই তো ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক থেকে ওদিকে। বাসা বাড়ি ছেড়ে সাত বছর ধরে জ্ঞানার্জনের নামে আতিপাতি ঘুরে বেড়ানো এই জীবনে, সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা হয়তো এটাই, “কি চাইলাম? কেন চাইলাম?”
সেই পুরনো ফেলে আসা জগতটা এখন আর মনে পড়ে না। আমি এখানেই কেন জানি কষ্ট পাচ্ছি। আল-কেমিস্ট তো আন্দালুসিয়ায় ফিরে যাবার তাড়না পেয়েছে, আমার জীবনে সেটা কই? আদৌ কি আসবে সেই সময়?
তারপরও আপনার লেখাটা কিছুটা হলেও সমাধান দিতে পেরেছে আমার প্রশ্নের। ধন্যবাদ, একটা দিক নির্দেশনা মূলক পোস্ট পড়ে খুব ভাল লাগল।
আমারো ত তাই! পড়তে এসেছিলাম বিশাল বিশাল সব স্বপ্ন নিয়ে। বিজ্ঞানী হব, দেশে রিসার্চ সেন্টার করব ইত্যাদি ইত্যাদি। সময়ের সাথে সাথে নিজের সীমাবদ্ধতা টের পেয়ে দিন দিন ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে গেছি। ক্ষুদ্র হয়েছি না বলে বলা উচিৎ বাস্তবতা বুঝেছি। তখন পুরোপুরি অথর্ব না ভেবে আবারো ভাবতে বসলাম, বিজ্ঞানে না হোক, আর কোথায় দেশের জন্য অবদান রাখা যায়! খুব ছোট কাজ, তবু প্রথম এই কাজটা http://nusrat807.blogspot.com/2011/08/blog-post.html
করতে পেরে একটু ভাল লেগেছিল। কিন্তু বাইরে থেকে টাকা পাঠিয়ে দেশে কাজ করানো – আর আমার এত টাকাপয়সাও নেই যে এ কাজ কন্টিনিউ করব… তারপর দেখলাম এ দেশ থেকে শেখার মত অনেক কিছু আছে, আর আমার লেখালেখি করতে ভাল লাগে। তাই ইউনিভার্সিটির এই সেটিংটা ব্যবহার করতে শুরু করলাম, আমার দর্শন ও জীবন বোঝার জন্য। দেশে কাউন্সেলিং এর অনেক প্রয়োজন, ছাত্রছাত্রীরা হতাশায় ভুগে, তাদের শক্তি দেয়া দরকার… এরকম করার মত অনেক কিছু আছে। তাই এখন আর রিসার্চ সেন্টার করা হবে না দেখে দুঃখ পাইনা।
বরাবরের মতই দারুণ আপু।
এখানে অ্যালকেমিস্টের উদাহরণটা ভাল লাগলো খুব। বইটা এত আগে পড়েছি, ভুলেই গেছিলাম প্রায়।
অনেক সুন্দর। 🙂