মেঘের নীচে সাদা কাকাতুয়া

তুমি কি কখনো সাদা কাকাতুয়া দেখেছো?তারা ছাইরঙের মেঘের নীচে উড়ে গেলে বিষন্ন দেখায়। এই শহরটা কাকাতুয়ায় ভরে যাচ্ছে। আমি বই পড়ছিলাম বাসার সামনের পারগোলাতে বসে। আমার সামনেই বেড়া আর তার ওপারে সেই বালির মাঠ। বৃষ্টি হচ্ছিল, তাতে, ধুলার…ভাঁপের গন্ধ। এক বৃষ্টি বয়ে আনে হাজার বৃষ্টির স্মৃতি।

তোমার গলার স্বর আমার মাঝে মাঝে কফির কাপের ধোঁয়ার মতন মনে হয়। যা আস্তে আস্তে বাতাসে মিশতে মিশতে কেমন নাই হয়ে যায়। কিন্তু থাকে…
টিনের চালে অস্থির শান্তির মত নেমে আসে আর অঝোর হয় আমার সামনের বালির মাঠে – যাকে আমি দেখি না।

* * *

আমি মাঝে মাঝেই তোমাকে স্বপ্নে দেখি। খুব ঘরোয়া প্রাত্যাহিকতায়। সেখানে আমার খুব চেনা তুমি। আমি জানি হঠাৎ রেগে গেলে তোমার চোখ কিভাবে জ্বলে উঠে, কপালের পাশের রগের দপদপ করতে থাকা দেখতে পাই। চিনি তোমার হাতের রেখা, শরীরে আঘাতের চিহ্ন, বা চামড়ার নীচে সবুজ হয়ে থাকা শিরা। তোমার চুপ করে থাকা, মগ্ন থাকা, কথা বলা, হাঁটাচলা…স—-ব জানি আমি!

আমরা থাকি সেই বাড়িটাতে যেখানে দরজা খুললেই বাতাস বয়ে আনে বুনো গোলাপের গন্ধ আর আমাদের পোষা বেড়াল গায়ে করে নিয়ে আসে ধুলা, সাদা গোলাপের পাঁপড়ি, মাকড়শার জাল আর বৃষ্টির পানি। এই সব আকস্মিকতায় চমকে উঠে তুমি কাপ থেকে চা ফেলে দাও কার্পেটে, জ্বলন্ত সিগারেট পড়ে যায় চায়ের কাপে…আমাকে ডেকে ওঠো তুমি প্রানপনে, আর সেই ডাকটা ছড়াতে ছড়াতে ছড়াতে ছড়াতে…।

স্বপ্নে তুমি আমাকে অনেক ডাকো। স্বপ্নে আমি তোমার সবচেয়ে আপন।

* * *

আমাদের বাসার সামনের সেই বালির মাঠটার কথা তো কত বলেছি তোমাকে। একদিন সকাল বেলায় খুব রোদ ঝলমল করছিল। বাসার সবাই ঘুমাচ্ছিল তখনও। ঘরের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল গতরাতের বাতাস। আমি দরজা খুলে বাইরে গেলাম। দেখি আগের দুইদিন বৃষ্টিতে বালির মাঠের উপর একটা পুকুর হয়ে গেছে, আর সেই পুকুর ঘিরে এক ঝাঁক শালিক পাখি হইচই করছে, কেউ কেউ পানিতে ভিজছে, কেউ উড়ে যাচ্ছে পানির উপর দিয়ে – পানিতে ওদের ছায়া পড়ছে, আকাশ আর গাছের ছায়া আগেই ছিল সেখানে…

আজ বোধহয় পূর্ণিমা। আমার জানালার বাইরেটা চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। তোমার সাথে আমার হাজার হাজার বছর ধরে কোন কথা হয় না। তবু তোমার কন্ঠস্বর শুনি আমি। শুনতে শুনতে কিছুতেই ঘুমাতে পারি না।

তুমি বলো ‘জীবনে…ও না, মরণে…ও না!’

আমি বলি ‘আবার…আবার…আবার!’

আমি মনে মনেই দেখতে পাই বালির মাঠের ওই হঠাৎ পুকুরের পানিতে মিশে যাচ্ছে জ্যোৎস্না।

* * *

বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরেও গাছের পাতায় লেগে আছে ফোঁটায় ফোঁটায়। তার উপরে শেষ বিকালের আলো চিকমিক। রাস্তার পাশের সেই ঘাসের মাঠে রোজকার মতন মিটিঙে বসেছে এক ঝাঁক সাদা কাকাতুয়া। এখন কাকাতুয়ার সময়…

গাড়িতে সেতার। একই বাজনা বাজছিল সেই রাতেও – তখন বৃষ্টি ছিল আর রাস্তায় একটাও গাড়ি ছিল না।

আকাশটা কমলা হয়ে যাচ্ছে। সেই লম্বা করিডোরের রেলিঙের ওপর তোমার শান্ত হাতের পাতা আমি দেখবো না কোনদিন। সেন্ট মার্টিনে তুমুল বৃষ্টিতে পাশাপাশি চলতে চলতে ব্যাঙদের কোরাস শোনা হবে না। সাগতালক্ষীর কনসার্টে আর আমাদের যাওয়া হলো না শেষ পর্যন্ত। ল্যাম্পপোস্টের উপরে একটা পাখি ডানায় মুখ ঘষে ঘষে সারাদিনের সব স্মৃতি মুছে দিচ্ছে আর আমার মনে আসছেন জীবনানন্দ –

‘একদিন যারে আমি চাহিয়াছি-দূরের পায়ের শব্দ যার
একদিন জাগাত পিপাসা,
তারে আমি ভুলে যাব, -ভুলে যাব জাগিবার ভাষা!
ঘুমাবার আগে আমি হয়তো ভাবিব একা এক বার কবেকার কথা!
কিন্তু এই পৃথিবীর শীত-অসাড়তা
আমারেও করিবে অসাড়,-
একদিন যারে আমি চাহিয়াছি ফিরে তারে চাহিব না আর!’

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে হাবিজাবি-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

16 Responses to মেঘের নীচে সাদা কাকাতুয়া

  1. অনাবিল বলেছেনঃ

    মেঘের নিচে কাকাতুয়ার কথামালা পড়ে একটু বিষন্ন হলাম…… আমার কল্পনায় একরাশ গাংচিল উড়ে যায় আকাশ ভেঙ্গে, আর সেই আকাশের নিচে একলা আমি আদিগন্ত বিস্তৃত শুন্যতায় মগ্ন থাকি এই কোলাহল মুখর পৃথিবীতে……

  2. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    উফফফ উফফফ উফফফ!!! আপ্পি আমি কি করব বলেন তো! এত্ত সুন্দর করে কেমনে লেখেন? প্রতিটা অক্ষর, প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা বাক্য এত এত পাগল করা ভালো লাগল! কোনটার চেয়ে কোনটা বেশি বলা দায়! আপনাকে কাছে পাইলে একটা Hug দিতাম! :beshikhushi: :beshikhushi:

    “…কিন্তু এই পৃথিবীর শীত-অসাড়তা
    আমারেও করিবে অসাড়,-
    একদিন যারে আমি চাহিয়াছি ফিরে তারে চাহিব না আর!’
    আহ জীবনানন্দ! বরাবরের প্রিয় আমার…

    লেখাটা প্রিয়তে না নিলে চলছেই না একেবারে :happy:

  3. নোঙ্গর ছেঁড়া বলেছেনঃ

    এতো সুন্দর লেখা! প্রতিটা শব্দই যেন শৈল্পিক বুনন।
    মুগ্ধপাঠ করলাম…

  4. নূরবাহার ঈয়াশা বলেছেনঃ

    সুন্দর……

  5. সামিরা বলেছেনঃ

    আপনি এত অসাধারণ করে কীভাবে লিখেন আপু? সিমপ্লি অসাধারণ। অনেক অনেক অনেক বেশি!

    • লুনা রুশদী বলেছেনঃ

      এই রকম মন্তব্য পড়লে আমার সব দাঁত বের হয়ে যায় খুশিতে! আমার বোন বলে আমি নাকি প্রশংসা শুনলে পুরা বাকবাকুম করি! এখন যেমন মনিটরের সামনে বসে বসে হাসি ঢাকার চেষ্টা করছি। 😀

  6. নিলয় বলেছেনঃ

    “একদিন যারে আমি চাহিয়াছি ফিরে তারে চাহিব না আর!” :clappinghands:

    লেখাটা এত্ত সুন্দর কেন? বাক্যশৈলী, শব্দচয়ন অসাধারণ লাগলো! 🙂
    নিয়মিত লিখবেন, আপু 🙂

  7. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    এই লেখাটা কেন যে বারবার পড়েও মন ভরে না! কেমন একটা ঘ্রাণ পাই আমি এ লেখাটার মাঝে…মাটির ঘ্রাণ, বালির মাঠের ঘ্রাণ, বৃষ্টির ঘ্রাণ, সাদা কাকাতুয়ার ডানার ঘ্রাণ…এই ঘ্রাণের টানে ছুটে আসি পড়তে…আপু এর একটা সিকুয়েল দিয়ে দেয়া যায় না? 🙂

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।