নিষিদ্ধ রাত্রি


সে  রাতটাও এমন  ছিল। ঝিরিঝিরি  বৃষ্টি। ঝুম  বৃষ্টি  না। দ্বিধা  করছিল  বারবার  বৃষ্টি। তার  সমস্ত  দুঃখ, কষ্ট, লজ্জা একত্রে স্বচ্ছ  তরলাকারে  পাঠিয়ে  দিয়ে পরক্ষণেই  ভাবত, “না পাঠালেই  ভাল  হত  বোধহয়।” তারপর  থেমে  যেত।

একটু পর আবার ভেঙে পড়ত।

আপাতত  স্তব্ধ  সে। অভিমানী প্রেয়সীর গভীর  চোখের  তারার  মত- স্থির, নিশ্চল, প্রতিক্রিয়াহীন। বৃষ্টিও  প্রেয়সীর  মতই  ভাবছে  হয়ত, “না, আর  ঝরব না। কষ্ট  বুকে  আগলে  রাখব। আর  কারো  জানার  দরকার  নেই।”

তারপর  অপেক্ষা  যখন  ধৈর্য্যের  খেলা  থেকে  ব্যথায়  পরিণত হয়, তখন  ভেঙে পড়েছিল  সে। বৃষ্টি  আজ  ভেঙে পড়েছে  তার  মত  করেই। আমার  জন্য নিষিদ্ধ  এ  রাতটি  দীর্ঘ  সময়  পর  ফিরে  পেলাম। আজ  আমি  নির্লজ্জ  হব। উপভোগ  করব  অনেকদিনের  পুরনো  সেই  ফেলে  আসা  সুখগুলো, যা এতদিন পড়ে  ছিল  অবহেলায়, অগোচরে।

অনেক  মিথলজিতে  মানুষের  সাথে  দেবীর  ভালোবাসার  কাহিনী  রয়েছে। ওই  প্রেমিকগুলোর  মত  দুর্ভাগা  বোধহয়  আর  কেউ  নেই। বেচারারা  একটুখানি দুঃখবিলাসও  করতে  পারত  না। করলেও  দেবী  সেটা  জেনে  ফেলে  উৎসব  বন্ধ  করতে  ছুটে  আসত!

সৌভাগ্যের  বিষয়, অন্যসব  ক্ষেত্রের  মতই  এক্ষেত্রেও, জীবন  রূপকথা  নয়। তাই  আমার  আজ  রাতের  এ  মহোৎসব  তুমি  পণ্ড  করতে  পারবে  না, যেটা করে  এসেছ  এতদিন  ধরে!

 

প্রথম  মেলামেশা  হবে  বৃষ্টির  সাথে।  না,  এই  বৃষ্টি  প্রকৃতির  বৃষ্টি, সম্পূর্ণভাবে  প্রাকৃতিক। এর  মধ্যে  মনুষ্যত্ব  (মতান্তরে  কৃত্রিমতা)  নেই। তিল  তিল  করে  গড়ে  তোলা  বিশ্বাস  আর  আস্থা  এক  মুহূর্তে  ভুলে  গিয়ে  অবসাদে  পতিত  হওয়ার  অভ্যাসটি  তোমাকে  আরও  একবার  চর্চা  করতে  দিলাম  না। রাগ  করো  না।

অবশ্য  তুমি  কথা  শুনবে  না  জেনেই  কথাটা  বলেছি। বলাটা  আমার  কাজ, শোনা  না  শোনা  তোমার  ব্যাপার। সবই  বলতাম  তোমাকে, তাই  বলে দিয়েছিলাম  বৃষ্টিতে  ভেজার  ব্যাপারে  কড়া  ডাক্তারের  কড়া  নিষেধের  কথাটাও, ভিজলেই  বীভৎস ঠাণ্ডা  আর  জ্বরের  শিকার  হতে  হয়  আমাকে। তোমাকে বলার  ফলাফল- বৃষ্টির  সাথে  মেলামেশা  বন্ধ  আমার। আজ  কে  বাধা  দেবে  আমাকে? পুরনো  প্রেম  জাগ্রত  হয়েছে,  ক্ষতস্থানগুলো  আজ  বৃষ্টির  আদর উপভোগ  করবে।

কথা  শুনোনি  জানি, রাগ  করে  ফেলেছ।

মানুষটা  আমি  অত্যন্ত  অলস  এবং  এতগুলো  ওষুধ  প্রতিদিন  কষ্ট  করে  বের  করে  একটা  একটা  করে  খেতে  আমার  অনিচ্ছা  প্রবল । কিন্তু  তোমার অপূর্ব  হাসি  দেখার  ইচ্ছেটা  বরাবরের  মতই  তীব্রতর। তাই  আমাকে  বলতে  বলতে  তোমার  মুখের  হাসির  চিহ্নটুকু  যখন  অদৃশ্য  হত,  তখন  ওষুধ  না খেয়ে  পারতাম  না। আজ  জোর  করার  কেউ  নেই। তোমার  সম্মোহনী  হাসি  তো  আমাকে  আর  অবশ  করতে  আসবে  না।

রাগ  ভেঙে  তোমার  মুখে  হাসি  ফোটানোর  প্রিয়তম  চাকরি  থেকে  যে  অবসর  নিয়েছি  আমি!

 

হারমোনিকা  জিনিসটা  নেশার  মত  আমার  কাছে। বাজানো  শুরু  করলে  যদি  কোনরকমে  একবার  সুরের  ঘূর্ণিঝড়ে  ঢুকে  পড়তে  পারি, তবে  উন্মাদ  হয়ে যাই  আমি। পাগলের  মত  বাজিয়ে  যাই…একটানা, একহারা  সুরে।

“অনেক  বাজিয়েছ, এবার  থামো। আরে! শ্বাসকষ্ট  উঠে  যাবে  তো  আবার, যাও  পানি  খেয়ে  বিশ্রাম  নাও!”

তোমার  কণ্ঠের  উৎকণ্ঠাটা  এড়াতে  পারতাম  না। অতীত  কাল।

আজ  আবার  আমি  সুরের  নেশায়  মাতাল, বেসামাল, উন্মাদ  হব।

 

বৃষ্টি  শেষে  নিস্তব্ধ  রাত। শেষরাতের  এ  নিঃসঙ্গ  নীরবতাটুকু  আমার  অনেক  পছন্দের। কিন্তু  তোমার  মত  অতিমাত্রায়  ভাল  সঙ্গিনীর  অপার্থিব  ভালোবাসার  কুফলস্বরূপ  রাতও  জাগা  হত  না  একা  একা। এ  স্বর্গীয়  নীরবতাটুকুও  অধরাই  থেকে  যেত।

না,  আজ  আর  থাকবে  না।

নিঃসঙ্গ  রাত  জাগতে  কেমন  লাগে, তা  প্রায়  ভুলেই  গিয়েছিলাম- আমার  অন্যসব  দুঃখবিলাসের  উপকরণের  মতই। নিস্তব্ধ  রাত্রির  সাথে  আমার  এবারের অভিসার।

বিশ্বাসযোগ্য  কথাটাই  আগে  বলি। আমি  স্বার্থপর। তুমি  পাশে  থাকাকালে  এ  অদ্ভুত  নিষিদ্ধ  সুখগুলো  গুমরে  কাঁদত। ওগুলোকে  ফিরে  পেতে, ওগুলোর  সাথে  আনন্দে  উন্মাদ  হওয়ার  আশায়  তোমায়  বিদায়  দিয়েছি।

সত্যটা  জানতে  চাও? কিন্তু  পৃথিবীর  আরো  অনেক  সত্যের  মতই  এটাও  যে  নিষ্ঠুর  কিন্তু  বিশ্বাসযোগ্য  নয় ! কিছু  সত্য  আছে  যেগুলো  চিরকালই মানুষের  অগোচরে  থাকলে  ভাল  হত  বোধহয়!  এটা  সেসব  সত্যের  মতই।

বলেছিলাম, “কখনও  ছেড়ে  যাবে  কি?”

বলেছিলে, “তুমি  যেতে  না  দিলে  কখনও  যাব  না।”

 

তুমি  বিদায়  নিয়েছ  বিশ্বাসযোগ্য  কথাগুলো  বিশ্বাস  করে, যুক্তিকে  ঈশ্বর  মেনে। আমি  যেতে  দিয়েছি।

কারণ,  আমার  এতগুলো  রোগকে  প্রতিনিয়ত  জ্বালানি  যুগিয়ে  যাওয়া  ব্যাধিটার  কথা  তোমাকে  আমি  জানাতে  চাইনি। আড়াল  করেছি  একটা  ছোট্ট  সত্যকে, যেটা  তুমি  জানতে  পারলে  চলে  যেতে  না। ক্যান্সার  রোগীকে  কেউ  দূরে  ঠেলে  না। আর  তুমি? তুমি  তো  ভালোবাস! পৃথিবীর  কারও  শক্তি  ছিল  না  তোমাকে  আমার  পাশ  থেকে  সরায়। অথচ, একটা  ছোট্ট  সত্য আড়াল করে কত  কষ্ট  থেকে  তোমায়  বাঁচিয়ে  দিলাম  আমি! একটা  ছোট্ট  সত্য!

 

নেমেছে  আবার  বৃষ্টিরূপী  প্রলয়…

হারিয়ে  গেছে  তরতাজা  সময়,

হারিয়ে  যেতে  করেনি  আমার  ভয়…

কখন  কীসের  টানে  মানুষ  পায়  খুঁজে  বাঁচার  মানে-

ঝাপসা  চোখে  দেখা  এ  শহর…

বৃষ্টির  সময়  এই  ‘বৃষ্টি’ গানটা  শুনলে  নিজেকে  অঞ্জন  দত্ত  মনে  হয়- যেন  আমিই  গাইছি।

আমার  আকাশ  কুসুম  স্বপ্ন  দেখার  খেলা  থামেনি,

শুধু  তুমি  চলে  যাবে- আমি  স্বপ্নেও  ভাবিনি।

 

না।

রঞ্জনা,  আমি  আর  আসব  না।।

ইতস্তত বিপ্লবী সম্পর্কে

যদি কখনো আমায় মনে পড়ে যায়,খোলো দুয়ার আকাশের-আমি তারাময়!
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প, পাগলামি, সাহিত্য-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

16 Responses to নিষিদ্ধ রাত্রি

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    ভালো লাগছে।

    আচ্ছা এই পেইজে আসলে এক রকম ব্যানার, অন্য পেইজে অন্য রকম! কাহিনী কী?

  2. মুবিন বলেছেনঃ

    ঘোর লাগানো লেখা।
    ভালো লাগলো 🙂

  3. শারমিন বলেছেনঃ

    অন্যরকম
    ভালো লেগেছে। 🙂

  4. জ্ঞানচোর বলেছেনঃ

    ঘোরে চলে গ্যাছি। আজব দুনিয়া।
    এত সহজে চলে যেতে দিতে পারলো? বিশ্বাস হয় না। স্মৃতি গুলো ফের বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে।

    • ইতস্তত বিপ্লবী বলেছেনঃ

      :thinking:
      বিশ্বাস নাই বা করলেন! কখনও কখনও বিশ্বাসযোগ্য কথাটা বিশ্বাস করা উচিৎ না, কেননা তখন আরো বড় কোন বিশ্বাসযোগ্য কথা আড়ালে থেকে যায়!

      স্মৃতি গুলো ফের বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে।

  5. নূরবাহার ঈয়াশা বলেছেনঃ

    অসম্ভব ভালো লাগলো!

  6. সামিরা বলেছেনঃ

    শুরুতে বুঝতে একটু সমস্যা হচ্ছিল কিন্তু শেষ করে – অসাধারণ ভাইয়া! 🙂

  7. নিলয় বলেছেনঃ

    অন্যরকম, তবে সুন্দর 🙂

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।