বাংলাদেশ গণিত দলের স্বপ্নসারথীদের অভিনন্দন! / নাজিয়া চৌধুরী

১৫ জুলাই ২০১২– রাত দশটার মত বাজে। দুই সপ্তাহের জ্বরে ক্লান্ত আমি বসে বসে ঝিমাচ্ছি। এমন সময়েই এল খবরটা, আর আমি জ্বর-টর ভুলে পুরো বাসায় দৌড়ে দৌড়ে খবরটা প্রচার করলাম- বাংলাদেশ গণিত দল পেয়ে গেছে তাদের প্রথম রৌপ্য পদক! ম্যারাডোনা- মেসির দেশ আর্জেন্টিনা এখন থেকে হবে আমাদের ছেলেদের ‘আর্জেন্টাম’ জয়ের দেশ। আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত ২০১২ সালের আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ দলের অর্জন একটি রৌপ্য, দুইটি ব্রোঞ্জ পদক, দুইটি সম্মানসূচক স্বীকৃতি এবং মোট ৭৪ পয়েন্ট- বাংলাদেশের এই পর্যন্ত সবচেয়ে ভাল ফলাফল। প্রাণঢালা অভিনন্দন মাহবুব স্যার, মুনির স্যার, এবং আমাদের পাঁচ ক্ষুদে গণিতবিদ- ধনঞ্জয়, মাহি, সৌরভ, মুগ্ধ এবং আদিবকে- দেশে আনন্দের এমন একটি উপলক্ষ্য তৈরি করার জন্য।

সারা বিশ্বে প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড (আই এম ও) তে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু ২০০৫ সালে। এরপর থেকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি আমাদেরকে- আস্তে আস্তে এগিয়ে গেছি আমরা।

  • ২০০৬ সালে এসেছে আমাদের প্রথম সম্মানসূচক স্বীকৃতি।
  •  ২০০৯ সালে এসেছে আমাদের প্রথম ব্রোঞ্জ পদক।
  • আর এবার ২০১২ সালে এল প্রথম রৌপ্য পদক। 

আমাদের মাইলফলক অর্জনগুলো যেন তিন অন্তর বিশিষ্ট একটি ধারা অনুসরণ করছে! এই যে বিশ্বের দরবারে আমাদের ছেলেমেয়েদের এত বড় বড় সাফল্য, এর চেয়ে বড় একটা অর্জনও কিন্তু আছে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের। সেটা হল দেশের আনাচে-কানাচে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে গণিতের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা, গণিতভীতি দূর করা। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের শুরুর দিকে আমাদের ডেপুটি লীডার মুনির হাসান স্যারকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ধরে আনতে হত। আর এখন বিভাগীয় অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে না পারলে ছাত্র-ছাত্রীরা কান্না করে! দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় ২০,০০০ ছাত্রছাত্রী অংশ নেয় বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের বিভাগীয় পর্যায়ে। গণিত অলিম্পিয়াড এখন শুধুই একটা প্রতিযোগিতা নয়, বরং স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের উৎসব! শত শত ছাত্র-ছাত্রী আর তাদের বাবা-মা দেশের স্বনামধন্য গণিতবিদদের সান্নিধ্যে একটি দিন কাটায়। তারা চিৎকার করে মিথ্যা, মুখস্থ এবং মাদককে না বলে। মাকে ভালবাসার, দেশের জন্য কাজ করার এবং সর্বোপরি একজন ভাল মানুষ হওয়ার শপথ নেয়। রাইজার্ড প্রাজকিয়ার তাঁর বই Social Entrepreneurship: Theory and Practice এ যথার্থই বলেছেন,

বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড একটি সফল সামাজিক উদ্যোগ।

এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ যে নেই তা নয়। দেশের ছেলেরা গণিত অলিম্পিয়াডে যেমন এগিয়ে গেছে, সেই তুলনায় মেয়েরা বেশ পিছিয়ে আছে। বিশেষ করে গত দুই-এক বছরে গণিত অলিম্পিয়াডে মেয়েদের পারফর্মেন্স ভাল নয়। এটার সমাধান করতে হবে আস্তে আস্তে। আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। মেয়েদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় ক্যাম্প, ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হচ্ছে, তবে যেতে হবে বহুদূর। এই সুযোগে আমি দেশের মেয়েদেরকেও বলব, যেসব সুযোগ সুবিধা আছে সেগুলো প্লিজ ব্যবহার কর। ইন্টারনেটে ফেসবুক দেখার পাশাপাশি বাংলাদেশ গণিত ফোরামে যোগ দাও- চমৎকার চমৎকার সমস্যা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেখানে প্রতিনিয়ত। বাসায় গণিতের বই পড়, সমস্যার চর্চা কর। গণিতে ভাল না হলে, ভাল হতে পারবে না বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কোন বিষয়েই, এমনকি অর্থনীতিতেও।

অনেকের মাথায় হয়তো ঘুরছে, গণিত অলিম্পিয়াড আমার কাছে কী? আমার আজকের ‘আমি’র মধ্যে বিশাল একটা অংশ জুড়ে আছে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড। এই গণিত অলিম্পিয়াড আমাকে গণিতের পাশাপাশি শিখিয়েছে স্বপ্ন দেখতে, স্বপ্নটা পাওয়ার জন্য লড়তে, ভালবাসতে, বড় আশা রাখতে, ধৈর্য ধরতে। গণিত অলিম্পিয়াডের সাথেই আমার এই ছোট জীবনের খুশির মুহূর্ত যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে ব্যর্থতার মুহূর্তও। ব্যর্থ যখন হয়েছি, পরীক্ষায় যখন শূন্য পেয়েছি, তখন মনে হয়েছে পুরো আকাশটা যেন মাথায় ভেঙ্গে পড়ল। কিন্তু গণিত অলিম্পিয়াডের স্বপ্নালু মানুষগুলো আমাকে বারবার করে বলেছেন, লেগে থাক, লেগে থাক। এটাই এখন আমার জীবনে চলার মন্ত্র- লেগে থাক। এই মন্ত্রটা শেখানোর জন্য, এই ‘আমি’টাকে গড়ে দেয়ার জন্য বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের কাছে আমি ঋণী। আলাদা করে দুইজনের কথা না বললেই নয়। প্রথমজন আমাদের গণিত দলের লীডার ড. মাহবুব মজুমদার স্যার। তাঁর মত ভাল, মাটির মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। এম আই টি, স্ট্যানফোর্ড, ক্যামব্রিজের মত বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী এই মানুষটির মধ্যে কোন অহংকার নেই। কী সুন্দর, সাদা সিধে, নিয়মমাফিক জীবন যাপন করেন তিনি। এত বড় মানুষ হয়েও দেশের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরকে গণিত আর সুন্দর জীবনযাপনের নিয়ম শিখিয়েই আনন্দ পান। অপর মানুষটি হলেন আমাদের ডেপুটি লীডার মুনির হাসান স্যার। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম আর সাংগঠনিক গুণেই বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড আজকের জায়গায় এসেছে। গণিত অলিম্পিয়াডের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবার প্রিয় এই মানুষটি। কেবল তো দুইজনের কথা বললাম। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডে এমন বড় মাপের মানুষের অভাব নেই। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকের পাশাপাশি আছেন এক দল অসাধারণ ভলান্টিয়ার্স। এরকম অসাধারণ মানুষে ভরা একটি পরিবারের অংশ হতে পেরে আমি নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করি।

শেষে আবার অভিনন্দন জানাই আমাদের গণিত দলকে। তোমরা নিজেদের যত্ন নিও, সুস্থভাবে দেশে ফিরে আস, তারপর আমরা আনন্দ উৎসব করব ইনশাআল্লাহ।

– নাজিয়া চৌধুরী

অন্য স্বর সম্পর্কে

ননরেজিস্টার্ড সদস্যগণও যেন সরবে লিখতে পারেন সেই জন্য এই একাউন্ট। যোগাযোগ পাতায় কিছু লিখে জমা দিলে সরব এর মডারেটরগণ তা মূল্যায়ন করবেন। মনোনীত হলে এই একাউন্ট দিয়ে ছাপা হবে।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে অনুপ্রেরণা, ইতিবাচক-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , , , , , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

8 Responses to বাংলাদেশ গণিত দলের স্বপ্নসারথীদের অভিনন্দন! / নাজিয়া চৌধুরী

  1. অক্ষর বলেছেনঃ

    অভিনন্দন :love: :love:

  2. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    দুর্দান্ত এক গর্বের বিষয়!

    বিস্তারিত কমেন্ট করছি পরে আপু। অনেক সুন্দর একটা লেখা।

    শুধু গণিত এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের বিজ্ঞান নির্ভর দেশ নয়… অন্যরকম এক সামাজিক আন্দোলন। যার ছোঁয়া আমরা নানান জায়গায় দেখছি!

  3. অনুজ বলেছেনঃ

    Say, valiant!
    Say, high is my head!

    আমরাও যে পারি, তার প্রমান এই অর্জন।

  4. জ্ঞানচোর বলেছেনঃ

    দুর্দান্ত এই্ সাফল্য! :dhisya: :dhisya: চারপাশের এত্ত এত্ত খারাপ খবরের মাঝে এই অসাধারণ খবরটি মনকে আনন্দে ভরে দিয়েছিল। ঠিক স্বপ্ন দেখতে পারছি- নতুন দিন আসবে।
    রৌপ্য জয়ীদের মতো আপনিও একজন পোড় খাওয়া গণিত যোদ্ধা। তাই অভিনন্দন আপনারও প্রাপ্য। অনেক অনেক শুভেচ্ছা আর অভিনন্দন।
    আপনাকে দাঁড়িয়ে সেলাম। :love:

    আমাদের এই ট্যালেন্টগুলোকে আরো সুযোগ দিতে হবে বিশ্বের দরবারে অংশগ্রহণ করার। আশা করি একসময় বাংলাদেশের গণিতযোদ্ধারা স্বর্ণ জেতাকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলবে।
    মেয়েদের পিছিয়ে পড়ার ব্যপারটা পুরোটাই সামাজিক। দুর দুরান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রখর গণিতপ্রেমী ছাত্রীরা কেবল সামাজিক নিরাপত্তা কিংবা উৎসাহের অভাবে ধীরে ধীরে ঝরে পড়ে। শুনে ভাল লাগলো, তাঁদের এই ঝরে পড়া রোধ করতে বিশেষ ব্যবস্থার কথা। চলতে থাকুক এগিয়ে যাওয়া।
    8) 8)

  5. সামিরা বলেছেনঃ

    খুব ভাল লাগলো, সত্যি! আপনাদের দেখলে মাঝে মধ্যে দুঃখই হয়, কেন যে সময় থাকতে গণিত অলিম্পিয়াডে যোগ দেই নি!
    অনেক অনেক শুভকামনা বিজয়ীদের জন্য। মিথ্যা, মুখস্থ আর মাদককে সত্যি যেন ‘না’ বলতে পারি আমরা। 🙂

  6. প্যালারাম বলেছেনঃ

    নাজিয়া, পারলে একটু সময় করে ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা নিয়া একটা লেখা লেইখা ফেইলো! জনগণ জানুক, ক্যাম্পের পোলাপাইন কোন লেভেলের ফাইজলামি করতে পারে! 😀 😀

    আর বিশেষ কইরা ক্যাম্প নাইট!

    লেখা ভাল্লাগসে, আরো বড় হইলে ভালো হইতো!

  7. ফেরারী পথিক বলেছেনঃ

    ব্যাপারটা বেশ প্রাউড ফিল করার মত!
    বাংলাদেশী হিসেবে আমি আমার ইউনিভার্সিটিতে বেশ ভাবের উপ্রে আছি! 😀

    লেখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ! 🙂

  8. ইয়াদ বলেছেনঃ

    ভয়াবহ রকম ভালো খবর। আরো ভালো লাগছে, এই যে সময়ের সাথে সাথে আরো উন্নতি করার ব্যাপারটা। সবার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে দিতে হলে এই অভিজ্ঞতাগুলোও শেয়ার করতে হবে।
    ধন্যবাদ লেখার জন্য 🙂

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।