ঢাকা শহর। এপার্টমেন্টগুলোর লোহার গ্রিলের ভেতরে আমাদের বন্দী জীবন! হাসি-কান্না সব ই যেন চার দেয়ালেই আবদ্ধ।ব্যস্ততম এই শহরের অসংখ্য দালানকোঠা, মানুষের ভিড়ে প্রায়ই আমি আমার সত্ত্বাকে হারিয়ে যেতে থাকে দেখি। একটু সবুজের খোঁজে দৃষ্টির হাহাকার! প্রাণ ভরে বাতাস নেবার জায়গা পর্যন্ত নেই। নিজেকে সান্ত্বনা দিতেই বুঝি পিছিয়ে যাই বছর খানেক, আমার ছেলেবেলায়।
ছেলেবেলার সর্বোচ্চ স্বাধীনতার জায়গা-নানু বাড়ি।শীতকালটা নানুর বাসায় যেতে হবেই, আনন্দময় নিয়ম ছিল এটা। বোনাস হিসেবে গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষায়; বিধায় হরেক রকম প্রকৃ্তির দেখা মিলত। যমুনা সেতু হবার আগে ১২/১৪ ঘণ্টা লেগে যেত। তবু কোনোদিনই উৎসাহের কমতি হয়নি। যাত্রা শুরুর আগে খুব যুদ্ধ-যুদ্ধ লাগত! মহা আনন্দে ব্যাগ গোছাতাম। দুনিয়ার হারিং তারিং সম্পত্তি নিতে হত আমার! স্কুলের ফ্লাস্কে পানি আর পটেটো ক্রেকারস ছাড়া যেন পুরো অভিযানই বৃথা-নিতেই হবে। ফেরীতে বসে মা’র হাতের খিচুড়ি আর ডিম ভাজি অমৃত লাগত। মনে আছে, আম্মু আমাকে ফেরীর রেলিং বসিয়ে আমাকে রঙ সম্পর্কে জ্ঞান দিত। ঐযে দূরের গাছটা, তার পেছনের গাছগুলো কেমন করে রঙ বদল করে দাড়িয়ে থাকে, কেমন করে মাঝিরা নৌকা বায়, মাছ ধরে, পালতোলা নৌকার পালের বুনন, নদীর পাড় কিভাবে ভাঙে আর গড়ে, লোকালয় স্থাপিত হয় আম্মু সেগুলো বর্ণনা করতো। আমি গল্প শোনার মত করে মা’র চোখ দিয়ে দুনিয়া দেখতাম, বে–শ লাগত।
আগে কত মানুষে ভরপুর ছিল এ বাড়িটা! নানু, নানাভাই, আম্মুর নানা এবং নানী- এই হল নানুর ছোট্ট সংসার। নানু বাদে বাকি তিনজন মানুষ এখন কেবল ই স্মৃতি। নানুর বাসাটা আমার স্মৃতি-পাতায় এতটা গাঢ় হবার প্রধান কারণ হল- “ইনফিনিট স্বাধীনতা”। যেকোনো ধরনের আবদার অথবা দুষ্টুমিতে কোনও বাধা নেই। ছোটবেলাতে নানাভাইতো আম্মুকে খুব করে বকা দিত আমাদের কিছু না দিলে! বাজারে গেলে শার্টের বুক পকেটে আমার জন্য চকলেট আনতে কোনদিন ভুল হত না তার;আমিও কোলে চড়ে ঠিক বের করে আনতাম। নানপুর বাসা মানেই ফ্রি ফ্রি চা, বাধা নাই কোন। ছোটবেলায় ব্যাপারটা বেশ বড় রকম স্বাধীনতা ছিল।
বাচ্চাকালে আমি বেশ দুষ্টু ছিলাম। নানপুর বাসায় ল্যান্ড করা মাত্রই সর্বপ্রধান কাজ ছিল ভাল দেখে একটা শিনট(পাটকাঠি) খুঁজে বের করা। ওটা থাকা মানেই- যুদ্ধে জয় অবধারিত। ভাবটা এমন যে নানুর বাসা রক্ষার দায়িত্ব আমার। কার বাসার হাঁস-মুরগি আমাদের বাসায় অবৈধভাবে প্রবেশ করল অথবা কুকুর আসলো- ঘুরে ঘুরে এসব তদারকি করাই ছিল আমাদের কাজ। আহা! সারাদিন রোদে পুড়ে সন্ধ্যায় ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরতাম, তবু ক্লান্তি থাকতো না।
গ্রামদেশ-এখানে মানুষ জলদি ঘুমায়। আমার আর আপুর ঘুম নাই, যত বেশি রাত জাগা যায়। কত যে বকা খেয়েছি এজন্য !আর ফজরের পর থেকে চোখ পিট্-পিট্! মুরগির ঘরটা খুলে দিতে হবে না? নানুকে একটু পর পর জাগাতাম “ও নানপু!মুরগির ঘরটা খুলে দিব না?” নানু রাগ করে বলত “ঘুমাতো তোরা” মনটাই খারাপ হয়ে যেত। ইস্! ওদের স্বাধীনতা বলে একটা কথা আছে না? তখন আমি মুরগি– স্বাধীনতাকামী।
আমার আর আপুর ছিল গলায় গলায় বন্ধুত্ব। সকাল হতে না হতেই লম্বা বাঁশ নিয়ে মহা সমারোহে পুবদিকের বাগানে কুলবড়ই পাড়তে যেতাম আমরা। এতগুলো পাড়তাম যে,নিজেরাই খেয়ে শেষ করতে পারতাম না। কিন্তু প্রতিবারই কেন যেন বেশি করে পাড়া হতো। ক্যাঁচ দিয়ে মালা বানানো, পাতা দিয়ে নৌকা, বাঁশি বানানো-এসব করে দিন কাটাতাম। বাইরের আম গাছ আর আঙিনার সরিফার গাছটাতে উঠতে কত যে হাঁটু ছুলেছি, তার ইয়ত্তা নাই। এখানে এলে মাটির একটা চুলা বানাতেই হবে, আর চুলার পাড়ের আমগাছটাতে দড়ি দিয়ে একটা দোলনা না বানালেই নয়। টিউবওয়েলটা একটু চাপার জন্য কতবার যে হাত পা ধুতাম!! গ্রীষ্মকালে এতো বড় বাগান বাড়ির আম তদারকি……আমগুলো মানুষ চুরি করল নাকি শালিক,বাঁদুরে খেলো-এইসব গবেষণা!“কাঠবিড়ালি, কাঠবিড়ালি পেয়ারা তুমি খাও?” এই কবিতাটা নানপুর বাসায় আসলেই যেন সার্থক হয়ে উঠত। জোনাকি পোকা চিনেছি এখান থেকেই।নানভাই এর সাদা টুপিটার নিচে নানু আলতো করে জোনাকি রেখে আমাদের দেখাতো। বাবুই পাখি নাকি ওর ঘরে গোবর লাগিয়ে জোনাকি আটকে রাখে। জোনাকিরা ওর ঘরে আলো দেয়। পিচ্চিকালে এখানে হাড়ি-পাতিল খেললে কাঁচামালের অভাব হত না, মহা আরামসে বাজার করা যেত বাগান থেকে।
আমার আরও আজব আজব কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- কোনো মুরগি-বাচ্চা তার মা থেকে আলাদা হয়ে গেলে কেমন করে বাচ্চাটাকে মা’র কাছে ফেরত দেয়া যায়, কোনদিক দিয়ে তাড়িয়ে আনলে ওদের মুখোমুখি দেখা হবে-কি মারাত্মক প্লানিং করতাম সব, এক্কেবারে সিনেম্যাটিক! আরও ছিল-চিল কোন পাখির বাচ্চাকে ঠোকর মারল(মনে আছে, একবার একটা ট্যাঁরট্যারার বাচ্চাকে বাঁচাতে কী না করেছিলাম), হলুদ মাখিয়ে ওদের সেবাযত্ন করে সারিয়ে তোলা, কোন মুরগি কোথায় ডিম পাড়ল-নানপুকে আপডেট জানানো,খড়ির চুলায় জ্বাল দেয়া…কত্ত কাজে ব্যস্ত সেই ছোট্ট আমি!! রোজ সকাল হতেই যখন বড়নানা বাগানে নেমে একগোছা ফুল উঠিয়ে এনে বলত “মামুনি, ফুল নেবে নাকি?” অনুভূতিটা “u have made my day” এর মত। আর কেউ আমাকে ফুল দিয়ে অমন খুশি করতে পারেনি।
এরকম অজস্র স্মৃতি হৃদয় পটে! নানু বাড়িতে এখন ঢুকতেই ডানে নানভাই, বড়নানী আর বড়নানার কবর। প্রধান ফটক থেকে বাইরের বারান্দা-কী বিশাল দূরত্ব লাগত ঐ সময়! এখন দু’পা ফেললেই পৌঁছে যাওয়া যায়! বোধোদয় হল- আমি আর ছোট্টটি নেই, আমার রাজত্ব করারও দিন ফুরিয়েছে। আমার এই কাজগুলো করার বয়স এখন আমার ভাগ্নির। শিনট নিয়ে আর মুরগি তাড়িয়ে রাজ্য উদ্ধার করা হয়না……এক্কাদোক্কা,গোল্লাছুট খেলার ঘরের ছক কাটা হয়না…নানাভাই এর চকলেট, বড়নানার ফুল, বড়নানীর অ্যালার্ম ক্লকটার শব্দ- কোনটাই আর বাস্তবে রূপান্তর হয়না। বড় মাঠের কৃষ্ণচূড়ার গাছগুলোও আর নেই, নেই পুব দিকের বাবলা গাছটাও। আম গাছটার নিচের আমার আর আপুর সেই প্রিয় সাদা ফুলগুলোও আর ফোটে না। কিন্তু এখনও নানুর বাসা আমার “ইনফিনিট স্বাধীনতা”র জায়গা। পায়ের ধ্বনিতে আর হৃৎস্পন্দনে আমি এখনও ছেলেবেলার মত মুরগি তাড়াই, লড়াই করি, রাজ্য জয় করি। দোলনচাঁপার অসাধারণ ঘ্রাণটুকু নাক ছুঁতেই আমার বড়নানার কণ্ঠস্বরটা কানে ভেসে আসে “মামুনি, ফুল নেবে নাকি?” এই বাসার প্রতিটা ইঞ্চি-ইঞ্চি যেন আমার চেনা। চোখ বন্ধ করলেই আমি বলে দিতে পারি- বাইরের বারান্দায় উঠতে কতগুলো সিঁড়ি, ওটার রাইযার কত, ওটার টেক্সচার কি, ভিতরের আঙ্গিনায় ঢোকার আগের দরজার পাটাতনের ম্যাটেরিয়াল, হেক্সাগনাল শেইপের গ্রিল, কাঠের জানালাগুলোর মেকানিজম, সিমেন্টের লাল মেঝেটা কোথায় গিয়ে আবার সিমেন্টের রঙ হয়, আঙ্গিনায় কতটুকু জায়গা পাকা, আর কতটুকু কাঁচা, কোনটা কোন দরজার তালা খোলার শব্দ, নানপুর কাঁসার ভারি জগটা থেকে পানি খেতে হলে কতটা ফোর্সে ওটাকে উপর করতে হয়, নানপু কোথায় আচার লুকিয়ে রাখে-সব জানি আমি।
শেষ বিকেলে পুকুরপাড়ের নিঃসঙ্গ সফেদা গাছটা যখন আমার মনটা খারাপ করে দেবার চেষ্টা করে আমি তখন খুব করে সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করি-এই এত সুন্দর একটা ছেলেবেলার কারণে।
এই বন্দী জীবনে ছেলেবেলার স্মৃতি আজও এক পশলা বৃষ্টি নামায় আমার মনে, বারবারই ভাবি-আহা! আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম!
মন ভালো হয়ে গেলো লেখাটা পড়ে 🙂
মুরগির ঘর খোলা দেখার ব্যাপারটা আমারও হত পিচ্চিবেলায় যখন নানিবাড়ি যেতাম, মুরগির ঘর খোলার পর পিচ্চি মুরগির ছানাগুলোর দৌড়ে বের হওয়া দেখে কি যে আনন্দ পেতাম 😀 আর কত কত আজব খেলা যে খেলতাম ওহ! … স্মৃতি… 🙂
সুন্দর লেখা :clappinghands:
হুম… মুরগির ঘর খোলাটা আসলেই মজার ব্যাপার ছিল খুব।
ধন্যবাদ সাদামাটা 😀
সুদূর প্রবাসে বসে লেখাটি পড়ে অসম্ভব রকম আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়লাম, শৈশবের স্মৃতিকাতরতা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। কি ছিল সেই দিনগুলো!! পরীক্ষা শুরু হবার আগেই অপেক্ষার প্রহর শুরু হয়ে যেত, কবে পরীক্ষা শেষ হবে, নানুবাড়ি যাব এবং আমার দস্যিপনা শুরু হয়ে যাবে। আহা! খুব খুব মিস করি সেই মধুর অপেক্ষার মুহুর্তগুলো… 🙁
“পরীক্ষা শুরু হবার আগেই অপেক্ষার প্রহর শুরু হয়ে যেত, কবে পরীক্ষা শেষ হবে, নানুবাড়ি যাব এবং আমার দস্যিপনা শুরু হয়ে যাবে। আহা! খুব খুব মিস করি সেই মধুর অপেক্ষার মুহুর্তগুলো… ”
আমিও… এখনকার দিনের বাচ্চারা খুব কম ই আমাদের মত দস্যিপনা করে…
উফ! এত্ত সুন্দর লিখিস কী করে?!
দারুণ লাগল।
নানপুর বাসায় “ল্যান্ড” করা …
মুরগি স্বাধীনতাকামী
চমৎকার সব লাইন/ শব্দ…
“উফ! এত্ত সুন্দর লিখিস কী করে?!”
:yahooo:
আমার কাজকামই এমন টাইপ ছিল…আসলেই ল্যান্ড করতাম আমি,মনে মনে
ধন্যবাদ বোহেমিয়ান
কী সুন্দর লেখা। অদ্ভুত রকমের একটা ভাল লাগা ছুঁয়ে গেল…
ধন্যবাদ অহর্নিশ।
ভাল লাগাতে পেড়েছি বলে আনন্দিত! 😀
এত এত সুন্দর বর্ণনা!
ছোটবেলায় গ্রামে বেড়াতে যাওয়া আর সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ানো – কি যে মিস করি! 🙁
শেষটা অসাধারণ হয়েছে আপু। 🙂
ধন্যবাদ সামিরা।
শেষটুকু আসলে আমার সবসময়ের অনুভূতি!
ধন্যবাদ সামিরা 😀
এখন গ্রামে গেলেও আর সেই মজাটা হয়না। বদলে গেছে আমার গ্রামখানি 🙁
হায় আমার সফেদা, বকুল আর শিউলি গাছ! নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। 😐
:yahooo:
ধন্য আমি ধন্য!
আপুর নানাবাড়ি সম্ভবত উত্তরবঙ্গে।
আমারও।
শিনট নামের মহামুল্যবান অস্ত্রটার কথা ভুলতে বসেছিলাম। মনে করিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ।
আপনার লেখাটা পড়তে পড়তে আমিও আমার নানাবাড়িতে চলে গিয়েছিলাম।
অনেক অনেক ধন্যবাদ এত্ত চমৎকার একটা লেখা আমাদের উপহার দেয়ার জন্য।
ঠিক ধরেছ মুবিন 😀
“শিনট” ওই অঞ্চলের মানুষরাই বেশি বলে। এখনও আমি নানুবাড়ী গেলে মহামুল্যবান অস্ত্রটা নিয়ে ঘুরি, মুরগি তাড়াই না বটে… 😳
ভাবতেই ভাল লাগছে- কাউকে তার নানুবাড়ী ঘুরিয়ে আনতে পারলাম।
তোমাকেও ধন্যবাদ সময় করে পড়ার জন্য। 😀
শেষটা পড়ে কেমন যেন মন খারাপ হয়ে গেলো। 🙁
শৈশবের স্মৃতিগুলো এতো সুন্দর হয়। এই ইট আর লোহার শহরে বন্দী আমাদের মনের জানালা খোলার চাবিটা যে বেশিরভাগ সময় শৈশব থেকেই নিতে হয়। ইচ্ছে হয়,আবার ফিরে যাই ছোটবেলায়,আবার জড়িয়ে ধরি স্বাধীনতাটাকে………
” ইচ্ছে হয়,আবার ফিরে যাই ছোটবেলায়,আবার জড়িয়ে ধরি স্বাধীনতাটাকে………”
ধন্যবাদ বন্ধু। শৈশব আসলেই সুন্দর! অসম্ভব সুন্দর!
অসম্ভব ভাল লাগলো । ধন্যবাদ :happy: