মাজেদা খালা জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। প্রায় দেড় হাজারবার ফোন দেয়া হয়ে গেছে। হিমু ফোন ধরছে না। একটা খারাপ ঘটনা ঘটেছে, জানানো দরকার হিমুকে। রুপার হাত কেটে গেছে, গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে। হাসপাতালে নেয়া দরকার, ঘরে কোনো পুরুষ মানুষ নেই, হিমুর খালুর শরীরের অবস্থাও বেশী একটা ভালো না। খালা হাতের কাটা জায়গাটা চেপে ধরে রাখলো। তার নিঃশ্বাসে টান পরছে। অক্সিজেনের অভাবে ঝাপসা দেখাচ্ছে সব কিছু। হিমু, কই গেলি ?
আয়নাঘরের দরজা ভেতর থেকে আটকানো, লিলিয়ান একা ভেতরে। তাহের জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগলো, প্রচণ্ড ভয়ে তার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। “লিলিয়ান, দরজা খোলো”, চিৎকার করে উঠে তাহের, প্রচণ্ড চিৎকারে তাহেরের গলা থেকে ছলাত করে রক্ত বেড়িয়ে আসে। সে চিৎকার করতে থাকে, লিলিয়ান, লিলিয়ান।
গৌরীপুর জংশনের চায়ের দোকানে মাগনা চা খাচ্ছিলো জয়নাল। পিরিচে চা ঢেলে এক চুমুকে শেষ করে পিরিচটা চেটে নেয়। দুটা টাকা এগিয়ে দেয় সে, চা ওয়ালা কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকে। জয়নাল হেসে বলে, “এতো অবাক হন ক্যান? টেকা-পয়সা হইলো হাতের ময়লা। আইজ আছে, কাইল নাই। পাওডা শুকায়া দড়ি হইয়া যাইতাসে, কেরোসিন আছে আপনের কাছে? কেরোসিনে ধক কম, পেট্রোল হইলে ভালা হইতো। শেষবারের মতো পেট্রোল মালিশ করতাম”। ছয় টাকার কেরোসিন নিয়ে সে রেল-লাইনের উপর গিয়ে পা মালিশ করতে থাকে। দূরে আলো দেখা যাচ্ছে, জয়নাল হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে আলোর দিকে, দার্শনিকের মতো চিন্তা করতে থাকে, “কতো সৌন্দর্যই না আলো, আর নাইলে পোকামাকড় কি করতে আলোর মইধ্যে জান দেয়? জগত বড়ই রহস্যময়”, ট্রেনটা আওয়াজ দেয়- কু ঝিক ঝিক। জয়নালের বড়ই রহস্য লাগে।
পেরাপ্লেজিয়ায় আক্রান্ত আনিসের প্রচণ্ড পানির তৃষ্ণা পেয়েছে। জরীর কথা মনে পরছে বারে বারে। অনেক বছর তো হলো, আর কতো? কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের যুদ্ধে মেরুদণ্ডে গুলি লেগেছিলো, তার পর থেকে শরীরের নিচেরটুক অবশ। বহু বছর এভাবে চেয়ার টেবিলের মতো বেঁচে রইলো। ভালোবাসা একবার মুখ তুলে তাকাতে চেয়েছিলো, চেয়ার টেবিলের মতো জড়বস্তুর ভালবাসতে মানা। আনিসের পিপাসায় বুক ফেটে যাচ্ছে, সে ডাকছে “হোসেন চাচা ! হোসেন চাচা !”, সবাই ব্যস্ত জরীর বিয়ে নিয়ে। সে নির্বাসন-এর প্রস্তুতি নিতে থাকলো। উলটো করে গুনতে লাগলো – নিরানব্বই, আটানব্বই …….
অরু হাঁটু গেড়ে মুহিবের পাশে বসে আছে। তার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। সে চাপা গলায় বললো, “ডাক্তার সাহেব, আমি কি ওর হাত একটু ধরতে পারি?”
বৃদ্ধ ডাক্তার কোমল গলায় বললেন, “অবশ্যই ধরতে পারো মা, অবশ্যই পারো”
“আমি যদি ওকে কোনো কথা বলি, তাহলে কি ও তা শুনবে?”
“জানিনা মা। কোমার ভেতরে আছে, তবে মস্তিষ্ক সচল, শুনতেও পারে। মৃত্যু এবং জীবনের মাঝামাঝি সময়টা খুব রহস্যময়, আমরা ডাক্তাররা এ জায়গা সম্পর্কে বেশী কিছু জানি না।“
অরু দুই হাতে মুহিবের ডান হাত ধরে আছে। সে খুব স্পষ্ট করে ডাকল, “এই তুমি তাকাও। তোমাকে তাকাতেই হবে। আমি সবকিছুর বিনিময়ে তোমাকে চেয়েছিলাম। তোমাকে পেয়েছি, আমি তোমাকে চলে যেতে দেবো না। তোমাকে তাকাতেই হবে, তাকাতেই হবে।“
কৃষ্ণপক্ষ-এর রাতে মুহিবের হাত ধরে নিষ্প্রাণ অরু বসে আছে। মুহিব নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরুর দিকে।
কাপে চা প্রায় শেষের দিকে। মিসির আলি এক দৃষ্টিতে টেবিলের খাতাটার দিকে তাকিয়ে আছেন। খাতার উপর বড় বড় করে লেখা, “আনসল্ভড”। সামনে বসে থাকা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন, “ তুমি কি রানু নাকি নীলু?”
“আমি দেবী”, রহস্য ভরা একটা হাসি দিয়ে সে উত্তর দিলো।
“আমি মিসির আলি, তুমি হয় রানু কিংবা নীলু। সেবারের ঘটনায় প্রচণ্ড মানসিক চাপের কারণে তোমাকে কড়া ডোজের ওষুধ দেয়া হয়, এরপর থেকেই তুমি লং টার্ম ডিল্যুশনে ভুগছো, সে কথা আমি জানি”, মিসির আলি ঠান্ডা ভাবে ব্যাখ্যা করলেন।
“মিসির আলি সাহেব, আপনি কথা গুলো বলছেন ঠিকই, কিন্তু নিজে কি বিশ্বাস করেন? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলুন তো!”
মিসির আলি তার চোখের দিকে তাকালেন, প্রচণ্ড ভয় পেলেন তিনি। সে ভয়ের জন্ম এ পৃথিবীতে নয়। তিনি চোখ বন্ধ করতে চাইলেন, পারলেন না। তিনি হিপ্নোটাইজড হয়ে গেছেন, বুঝতে পারছেন। কিন্তু কিছুই করার নেই।
“ মিসির আলি সাহেব। আপনার জন্য একটা উপহার এনেছি। বিনিময়ে আপনার আনসল্ভড খাতাটা নিয়ে যাচ্ছি, এটার আর আপনার দরকার পরবে না”, খাতাটা নিয়ে দেবী চলে গেলো, বেলি ফুলের কড়া গন্ধে মিসির আলির হেলুসিনেশন এর মতো হচ্ছিলো। মিসির আলি অনেক চেষ্টা করে চোখ খুলে রাখলেন। লম্বা বাক্সটার কাগজ সরালেন। একটা কফিন আর একটা টেলিস্কোপ। মিসির আলি ঘুম ঘুম চোখে কফিনের মধ্যে এলিয়ে পরলেন।
ঝিগাতলার মোড়ে শত শত কুকুর লেজ নাড়ানাড়ি বন্ধ রেখে চুপচাপ বসে রুটি খাচ্ছে। কলাপাতায় করে রুটি বিলাচ্ছে হিমু, পাশে সাহায্য করছে সন্ত্রাসী কালা মজিদ।
– হিমু ভাই
– বলে ফেলো
– আসলেই আর কোনোদিন ফিরে আসবেন না?
হিমু খালি হাসে, কিছু বলে না। তৃপ্তিভরা চোখে তাকিয়ে কুকুরগুলোর খাওয়া দেখে। ল্যাম্পপোস্ট আর ডাস্টবিনটার দিকে একবার তাকায়। সব কিছু কতো পরিচিত। কিভাবে এদের ছেড়ে থাকবে সে? পারবে, সে মহাপুরুষ, মহাপুরুষেরা সর্বত্যাগী। শুধু বৃষ্টি আর জ্যোছনাটাই ত্যাগ করতে পারলো না হিমু। না হয়তো একেবারে সাধু মহাপুরুষ হয়ে যেতো, সে ভেজাল মহাপুরুষ। মজিদকে ওদিকে রেখে সে একা একা একটা অন্ধকার গলিতে ঢুকে পরে। হলুদ পাঞ্জাবীটা খুলে যত্ন করে রেখে দেয় পাশে। ঘুটঘুটে অন্ধকার আকাশে দিকে তাকিয়ে দু হাত দু দিকে প্রসারিত করে দেয় হিমু।
মিসির আলি টেলিস্কোপে পছন্দের তারাটি খুঁজে বেড়ান। হাতের ঘড়ির দিকে তাকান। রাত ১১:৩৯ মিনিট। কফিনের ঢাকনাটি টেনে নেন যত্নের সাথে। ভয়াবহ অন্ধকারে অপেক্ষা, মাত্র ১ মিনিটের।
জয়নাল চোখ বন্ধ করে নেয়, অনুফার চেহারা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। বিড়বিড় করে অনুফা কি যেনো বলছে, ট্রেন খুব কাছে এসে পরেছে, ট্রেনের ঝিক ঝিক শব্দে অনুফার কথা শুনতে পেলোনা জয়নাল।
১১টা ৪০ বাজতে আর কয়েকটা সেকেন্ড, আনিস তৃষ্ণার কথা ভুলে গেছে। প্রচণ্ড হাহাকার নিয়ে সে তাকিয়ে আছে ঘড়ির দিকে, সেকেন্ডের কাটাটা এগিয়ে আসছে, আর কয়েকটা সেকেন্ড।
মাজেদা খালা আর রূপা সংজ্ঞাহীন চোখে তাকিয়ে রইলো। চোখের সামনে সময় কিভাবে চলে যাচ্ছে, তাকিয়ে দেখতে থাকে তারা, গলগল করে রক্তে ভেসে যায় চারদিক, রুপা বহু কষ্টে ঠোঁট নড়িয়ে বলে, হিমু।
কৃষ্ণপক্ষের রাতে অরু, মুহিব আরও সবাই অজানা কোনো অপেক্ষায় নিঃশেষ হয়ে যেতে থাকে। ১৯শে জুলাই, ২০১২। ঘড়িতে ১১টা বেজে ৪০ মিনিট। কালো আকাশে ওপারে থাকা মহাশক্তিধর একজন আস্তে করে একটি খাতা চিরতরে বন্ধ করে দিলেন। হিমু, মিসির আলি, মাজেদা খালা, রুপা, অনুফা, জয়নাল, মজিদ, আনিস, অরু, জরী – সবাই দেখলো নিজেদের শেষ হয়ে যেতে।
মরমী কবি গিয়াসউদ্দীনের গান ঐ খাতাওয়ালার খুব প্রিয় ছিলো।
মরিলে কান্দিস না আমার দায়, ও যাদুধন,
মরিলে কান্দিস না আমার দায়।
এর চেয়ে অসাধারণ করে আর লেখা যেত না মনে হয় নিশম।
আচ্ছা ১১টা ২০ মিনিট হবে না?
একজন হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যকে যা দিয়ে গেছেন, তার কথা ভুলতে পারা সম্ভব নয়………
আসলেই কি শেষ হলো?
ওরা রয়ে যাবে কাগজে, আমাদের হৃদয়ে নিশম এর মতো শত তরুণের কিবোর্ডে!
ভাই নিশম, সত্যি বলছি। অসাধারণ লেখা। পড়ার সময় আমার প্রয়াত লেখকের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো। এই হাত চলুক, আমাদেরকে হিমু মিসির আলী, রূপাদের সেই জগতের মতন অন্য কোন জগতে ভাষাশৈলী আর দৃশ্যকল্প দিয়ে ঘিরে রাখুক।
অনেক শ্রদ্ধা রইলো ভাই, অনেক ধন্যবাদ।
কি বলব খুঁজে পাইনা 🙁
ভালো লাগলো খুব …