কোন কোন দিন থাকে কোন কারণ ছাড়াই বিষন্ন লাগতে থাকে , তার উপর কেউ যদি বিষন্নতাবিলাসী হয় তাহলে তো কথাই নেই , একেতো নাচুনে বুড়ি তার উপর ঢোলের বাড়ি ! আমি ঠিক সেরকম নাচুনে বুড়ি ! কোন কারণ ছাড়াই আমার মন খারাপ হয় , একটুতেই আমার চেহারায় বিষন্নতার মেঘ জন্মে আর আমার কষ্ট পেতে পেতে এতোটুকু হয়ে যাওয়া হৃদয়টায় সেই মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে ঝরে পড়ে ।
সেরকমই এক বৃষ্টি ঝরা বিকেলে আমার ছোট্ট রুমের বারান্দার দরজার পাশে হাঁটুতে মুখ ঢেকে বসেছিলাম । ভয়াবহ কান্না পাচ্ছিলো আমার ,হঠাত্ ই তপ্ত হয়ে যাওয়া চোখ দুটো থেকে অবিরত পানি পড়ছিলো , কোনভাবেই নিজেকে মানাতে পারছিলাম না , বলা ভাল চোখ দুটো বাঁধা মানছিলো না!
আমার তখন খুব ইচ্ছে করে কারো পাশে গিয়ে বসি , কেউ আমার চোখের পানি মুছে দিক কিন্তু আমি কখনোই সেরকম কাউকে কাছে পাই নি । আমার খুব কাছে থাকা মানুষ গুলো আমাকে কখনো বুঝেনি কিংবা বুঝার চেষ্টাও করে নি ,আশে পাশের পরিচিত অনেক মানুষের পরিবারের সদস্যদের মাঝে থাকা বন্ধন দেখলে আমার খুব হিংসে হতো , যখন দেখতাম কারো বড় আপু পরম মমতায় ছোট বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে কিংবা কোন ভাই বোনের খুনসুঁটি …তখন আমার ভেতর একটা কষ্ট দলা পাকাতো ! অথবা বন্ধু দিবসে ক্লাসের সব মেয়ে হাত ভর্তি করে সুতোর বন্ধুডোর বেঁধে ঘুরতো , আমি শূন্য হাতের দিকে শূণ্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকতাম । এভাবে চলতে চলতে একটা সময় আমার মধ্যে একটা বিশ্বাসের জন্ম নিলো …
সেটা অনেকটা এরকম , সৃষ্টিকর্তা হয়তো তাঁর এতো সৃষ্টির সবার কপালে অনেক কিছু লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে যান ! তখন কিছু মানুষের কপালে কিছু না লিখে খালি একটা ক্রসচিহ্ন দিয়ে দেন । যাদের কপালে ক্রসচিহ্ন থাকে এদের জীবনে সব কিছুতেই ক্রস ! এবং সম্ভবত আমি সেই গ্রুপের ।এই গ্রুপের আমি একটা নাম দিয়েছি । নামটা হলো
নয়দুয়ারি !
নয়দুয়ারি কথাটার মানে হলো যারা হতদরিদ্র , যেহেতু একটু খানি ভাল থাকার ক্ষেত্রে আমার অবস্থা অতিরিক্ত মাত্রায় হতদরিদ্র , এইনামটা আমি নিতেই পারি ! এভাবেই আমার জীবনখাতার পাতার একটা একটা পাতা উল্টে যাচ্ছিলো !
যতোদিন না ইহান আসলো আমার জীবনে ।
লাভ অ্যট ফার্স্ট সাইট বলে একটা ব্যাপার আছে এই জিনিসটা আমি শুনেছিলাম কিন্তু ইহানকে দেখার পর থেকে তা বিশ্বাস করতে শুরু করলাম । ইহান আমাদের বাসায় এসেছিলো ভুল করে । আমাদের পাশের ফ্ল্যাটটা খালি পড়েছিলো অনেকদিন , বাড়িওয়ালা টুলেট ঝুলিয়ে দিয়েছিলো আমাদের বারান্দায়, ইহান আমাদের বাসাকেই খোঁজ নিতে আসে !
সেই বিকেলটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে । কলিংবেল বাজতেই দরজা খুলতে ছুটে গিয়েছিলাম , এই বাসাতে এই কাজটা আমারই ! কে জানতো সেই দরজা খোলায় আমার একলা থাকার একেকটা বিকেলে মন খারাপের আরো একটা পাঁপড়ি যুক্ত হবে ?
দরজা খুলে প্রথমেই আমার যে কথাটা মনে হয়েছিলো সেটা আমি অতিবিস্ময়ের ঠ্যালায় তার খানিক পরেই ভুলে গেছি ! আমি প্রায় ছ ফুট লম্বা ছেলেটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম . কালো মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে থাকা মেয়েদের মত বড় বড় পাঁপড়ি সমেত চোখ যার মণি কীনা নীল , আলা ভোলা চেহারা , উসকো খুসকো চুল . রোদে পোড়া ফর্সা ক্ষয়াটে গায়ের রং !
ছেলেটা অদ্ভূত উচ্চারণে যা বললো তা অনেকটা এরকম-
হাই . আমি ইহান , ইহান সাকিব , বাসা ভাড়া হবে না কি ?
উত্তর দিতে যেয়ে দু চারবার তোতলানো এবং বহু কষ্টে তাকে বোঝাতে সক্ষম হওয়া যে বাড়িওয়ালা উপরে থাকে তা নিশ্চয়ই দেখার মতো দৃশ্য ছিলো ! কখনো ইহানকে জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠেনি আসলে !
পরের মাস থেকে প্রায় দিন বিকালে আমাদের বাসার ছাদে মাউথ অর্গান বা বাঁশের বাঁশি হাতে একটা কালো টিশার্ট পরা ছেলেকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেতো ! ওর কাছে অনেকবার এই কালো টিশার্টের মহত্ব জানতে চেয়েছি পরে , এটা না পরলে নাকি ও বাজাতে পারে না ! এরকম কত সন্ধ্যা যে গেছে আমাদের কারেন্ট ছিলো না , আমি , ইহান , ওর বোন ইষিকা ছাদে ঘুরে বেড়িয়েছি !
দু ভাই বোন ছিলো ওরা , ঈষিকা আপু আর ইহানের মধ্যে যে মিলটা সবচেয়ে বেশি ছিলো তা ওদের চোখ ! ওদের বাবা কাস্টমসে চাকরি করতেন আর ওদের মা ছিলেন বিদেশিনী ! দু ভাই বোনের নীল চোখ প্রাপ্তি ঘটেছে তাদের মায়ের কাছ থেকেই ! ইহানের যখন তিনবছর বয়স তখন ওদের মা কি এক জরুরী কাজে নিজ দেশে ফিরে গিয়েছিলেন আর ফিরে আসেন নি । ইহান ই আমাকে এসব বলেছিলো , ইহান আরো অনেক কথাই আমার সাথে শেয়ার করতো , আমার মেঘে ভরা জীবনটাতে হঠাত্ ই একফালি সোনালি রোদের পরশ দিতেই যেন ইহানদের আগমন ঘটেছিলো !
ইহান অনেক কথা ই বলতো , আমার কাজ ছিলো কেবলই শোনা ! মাঝে মাঝে ইহানের নীল চোখেও গাঢ় বিষাদ জমতো , মাকে মিস্ করতো ও ভীষণ ! কিন্তু ইহান কোনদিন আমার কাছে আমাকে জানতে চায়নি , হয়তো ওর সেই প্রয়োজনই ছিল না ।
ইহান জানতে না চাইলে কি হবে , আমি সারাক্ষণ ওকে আমার সব কথা বলতাম , না ঘুমানোর রাত গুলোয় আমার পাশে ইহানকে পাশে কল্পনা করে করে কিংবা যখন আমার চোখে বৃষ্টি নামতো আমি এটাই ভাবতাম যে ইহান আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলছে ,
এই মেয়ে , চোখের মধ্যে কয় ড্রাম পানি নিয়ে ঘুরো বলতো ? আরেকবার কাঁদলে চোখ গেলে দিবো !
আমার এক একটা কল্পনার ইটে গাঁথা ঘরে প্রতিদিন নতুন ইট যুক্ত হতো ইহান কে নিয়ে , ইহানের অগোচরে …
আমি সবসময় চেয়েছি ইহানের কাছ থেকে সেই কথাটা শুনতে যা শোনার জন্যে আমি পৃথিলা হয়তো আরো অনেকদিন কল্পনার ঘর বানাতে পারি , আরো অনেক রাত জেগে পাশে ইহানকে কল্পনা করতে পারি , কল্পনায় ইহানের কাছে আমার মন খারাপ থাকা একেকটা দিনের গল্পের ঝাঁপি খুলে বসতে পারি !
যেদিন ইহান অরণীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো আমার বাতাসে বানানো কল্পনার রাজপ্রাসাদের এক একটা ইট ভেঙ্গে পড়ে যেতে শুরু করলো । আমি দেখলাম এবং বুঝলাম অরনী যদি পৃথিবীতে আসে তবে তা ইহানের জন্য ।
আমার ক্ষেত্রে দাশ বাবুর কবিতা সত্যি হয়ে গেলো-
“মনের নদীর পার নেমে আসে তাই সন্ধ্যাবেলা
সন্ধ্যার অনেক আগে !
দুপুরেই হয়েছি একেলা !”
আরো পাঁচ বছর পর–
ইহানের নির্লিপ্ততার পাশে থাকতে থাকতে আমার জায়গায় অন্যকেউ হলে হয়তো ক্লান্ত হয়ে যেতো ! ইহান অরনির বিয়ের একবছরের মাথায় ডিভোর্সের পর ঈষিকাআপুর জোর চেষ্টায় ওর সাথে আমার গাঁটছড়া তো বাঁধে ঠিকই কিন্তু ইহান আমাকে কখনোই অরনির জায়গাটা দিতে পারে নি ! আমরা দুজন পাশাপাশিই থাকছি অথচ দুজনের দূরত্ব যোজন যোজন । আমার আজকাল আর মন খারাপ হয় না , জীবন থেকে আমি আরো একটা জিনিস বিশ্বাস করতে শুরু করেছি , নয়দুয়ারিদের মন খারাপ করতে হয়না ! আর ইহান আমাকে অরণির জায়গা দিতে পারে নি তাতে কি ? আমিই কি ইহানের জায়গাটা কাউকে দিতে পারতাম ? আর একটা জীবন কাটানোর জন্য এটাতো জরুরি না কারো খুউব ভালবাসা পেতে হবে তাইনা ? আর আমার জন্যে তো ইহানের উপেক্ষার মাঝেই যেন সুখ লুকানো আছে, ও ভালবাসে না বলেই হয়তো আমি বুঝতে পারি ভালবাসা আছে ।
আর একটা জীবন কাটানোর জন্য মনে হয় আমার একার সমস্ত আবেগ , সমস্ত অনুভূতি , সমস্ত ভালবাসাই যথেষ্ট । অন্তত আমার কাছে তো তাই মনে হয় ।
:love: :love:
:welcome:
ধন্যবাদ :happy:
নতুন মানুষ! 😀
:welcome:
লেখাটা ভাল লেগেছে তো! “একটা জীবন কাটানোর জন্য মনে হয় আমার একার সমস্ত আবেগ , সমস্ত অনুভূতি , সমস্ত ভালবাসাই যথেষ্ট । অন্তত আমার কাছে তো তাই মনে হয়।” – এই কঠিন ভাবনাটা ভাবতে পারলে অনেকের কষ্টই কমতে পারতো। 🙂
আপু ধন্যবাদ , আসলেও তাই 🙂
ভালো লেগেছে আপু। ইন্টারেস্টিং প্লট।
নয়দুয়ারি শব্দটার সাথে পরিচিত ছিলাম না।
আর সরব এ স্বাগতম
হুমায়ুন আহমেদ স্যার এর কোন বই এ পড়েছিলাম ভাইয়া 🙂
অনেক ধন্যবাদ !
হাহা!! অবশেষে ব্লগের দুনিয়ায় চলেই আসলা!! 😀
আমি যখন তোমাকে বলছিলাম ব্লগিং এর কথা তুমি রিপ্লাই দিছিলা “ভয় লাগে তো”! এই লেখা পড়ে কেউ সেটা বিশ্বাস করবে না! দারুণ হইছে! প্রথমে তো ভাবলাম ইহান বুঝি বাস্তব ক্যারেকটার, তোমারে ক্যাম্নে পচাবো সব প্ল্যান করে ফেললাম, লাস্ট প্যারায় অবশ্য সব ভেস্তে গেল 😛
সরব পরিবারে স্বাগতম! 😀
:welcome:
আল্লাহ্ বাচাইসে দেখা যায় !! 😀
ধন্যবাদ , আসলেও ভয় লাগে ! :voypaisi:
“একটা জীবন কাটানোর জন্য মনে হয় আমার একার সমস্ত আবেগ, সমস্ত অনুভূতি, সমস্ত ভালবাসাই যথেষ্ট। অন্তত আমার কাছে তো তাই মনে হয়।”
সামিরা আপুর সাথে একমত, এই কঠিন ভাবনাটা ভাবতে পারলে অনেকের কষ্টই কমতে পারতো!
অফটপিকঃ “এই মেয়ে, চোখের মধ্যে কয় ড্রাম পানি নিয়ে ঘুরো বলতো?” সমগ্র নারী জাতির উদ্দেশ্যে আমার প্রশ্ন!! 😛 [কাউকে কাঁদতে দেখলে আমি পুরা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাই, সান্ত্বনা কী দিব ভেবে পাই না :S ]
পৃথিলা রে জিগাও , আমি জানিনা , আমার চোখে আবার পানি টানি কম 😛
আসলেও চিন্তার বিষয় ! :thinking:
😛
নূহা ,অসংখ্য ধন্যবাদ
লেখাটি সুন্দর হয়েছে 🙂
ধন্যবাদ উপমা 🙂
সরবে ইদানিং আমার নিজেকে ধন্য ধন্য লাগে|
এইরকম দারুন দারুন লেখনীর মাঝে তো আমার আর কিছু লিখতেই অস্বস্তি হবে! 🙂
নতুন লিখল এই মানুষটা, অথচ কী সুন্দর প্রকাশ!!
গল্পের প্লট আর আবেগের প্রকাশগুলো অনেক বাস্তব
সরবে স্বাগত জানাচ্ছি নুহাপু!
:welcome:
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া 🙂
ভালো লেগেছে।
:welcome: আপুনি
:happy:
অনেক ধন্যবাদ শারমিন আপু 🙂
:welcome:
ভাল হয়েছে :love:
ধন্যবাদ ভাইয়া 🙂
চমৎকার লেখা আপনার।
নয়দুয়ারির জন্য খোলা থাকে দখিন হাওয়ার জানালা……এই তো আমার বিশ্বাস।
আরো লেখা পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম 🙂
সরব এ স্বাগতম
অনেক ধন্যবাদ 🙂
নুহাপ্পু নাকি !!!!!!!!!!!! :welcome:
হ , আইসা পড়লাম রে নিস্মিশ 🙂 :love:
ওহ মিঠু ! তুমি আইসো ? খুব বালা হইসে !
– মীনা
:happy:
‘নয়দুয়ারি’ শব্দটা বেশ লাগল।
কিন্তু শুধু একক ভালোবাসা যে বড্ড কষ্টের বিষয়! 🙁
:welcome: আপু! 😀
ধন্যবাদ 🙂
কেন যেন মনে হচ্ছে এই লেখাটা আগে কোথাও পড়েছি। :thinking: আর কোথাও কি দিয়েছিলেন আপুনি?
:welcome:
ফেসবুকের একটা পেইজ এ দিয়েছিলাম আপু 😐
ধন্যবাদ :happy:
ওহ তাহলে ঠিকই ধরেছি। :happy:
গল্পের উপস্থাপন সুন্দর তবে চিন্তাটা আমি ব্যক্তিগতভাবে সমর্থন করি না। আরও সুন্দর সুন্দর গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম। 🙂
চিন্তার ব্যাপারটা বুঝলাম না আপু , বুঝিয়ে বললে খুব খুশি হব 🙂
দারুণ লেগেছে- প্রথম পোস্ট, অথচ পড়লাম কত্ত দিন পরে! 😀
ধন্যবাদ নিলয় , একটু আগে আগে পড়লে এক কেজি বেশি ধন্যবাদ দিতাম 🙂