আমাদের, বাঙালিদের মাঝে শকুন স্বভাব প্রবল। জীবিত মানুষকে নিয়ে আমাদের আগ্রহ কম, বরং মৃত ভাইয়ের মাংসের স্বাদ আমাদের প্রিয়, জীবিত ব্যক্তির কীর্তির স্বীকৃতি দেবার চাইতে মরণোত্তর পদক আর স্তুতি প্রদানে আমাদের আগ্রহ বেশি, যদিও কবরে বা শ্মশানে এই পদক বা স্তুতি তাঁর কি কাজে লাগে জানা নেই। সেদিক দিয়ে হুমায়ুন আহমেদ ভাগ্যবান, জীবিতাবস্থায় অর্থ-সম্পদ-পদক সবই পেয়েছেন, পেয়েছেন আকাশসমান খ্যাতি আর সেই সাথে কিন্ঞ্চিৎ কুখ্যাতি। কিন্তু মৃত্যুর পর তাঁর-ও রেহাই নেই, বেচারার সাহিত্যকর্মের বিচারের বদলে তাঁর কোন বউ কোথায় আছে, সম্পত্তির উপর কার অধিকার বেশি, কার কোন মতলব, কবর কোথায় দিলে কার সুবিধা ইত্যাকার বিষয় নিয়ে সারা দেশ তোলপাড়, যদিও তাঁর লেখাগুলো নিয়ে আলোচনা খুব কম, গত বেশ ক’বছর ধরেই কম-ই ছিল। হুমায়ুনের বই পড়লে বুদ্ধিজীবি মহল থেকে নাম কাটা যাওয়ার সম্ভাবনা তো ষোল আনা আগেও ছিল, শেষ ১০ বছরে তিনি নিজেও তাঁর লেখার মান দিয়ে প্রশ্নটা আরো বড় করেছেন। প্রায় সবার মত এই অধম-ও শেষ ক’বছরে তাঁর লেখা পড়ে ভাল কোন মন্তব্য করা ছেড়ে দিয়েছিল, দায়টা পাঠকের একার না।
মৃত্যুর পরে লেখককে নিয়ে স্তুতির বানে যোগ দেবার আগে মনে হলো, যোগ দিতে হলে ব্যক্তি হুমায়ুনকে নিয়ে টানাটানি না করে তাঁর লেখা নিয়েই কাটাছেঁড়া করা ভালো, সেটা করার যোগ্যতা না থাকার পর-ও। হুমায়ুন আহমেদের লেখনীর অতিমানবীয় শক্তির পরিচয় পেতে হলে সবসময়ই ফিরতে হবে তাঁর আশি আর নব্বই দশকের লেখাগুলোর দিকে। তাঁর সামগ্রিক লেখনী নিয়ে আলোচনা করা কঠিন, ইংরেজি “প্রলিফিক” শব্দটার সঠিক বাংলা জানি না, তবে সঠিক উদাহরণ দিতে গেলে হুমায়ুন আহমেদের চেয়ে ভালো কিছু হয় না। শামুক নাকি একবারে ২-৩ লাখ ডিম পাড়ে, যার বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু যা টিকে থাকে সেগুলো-ও নেহাৎ কম নয়। হুমায়ুন শামুকের মত-ই, অথবা গী দ্য মপাঁসা’র বেলায় যেমনটা বলা হতো, তিনি সস্তা লেখা লিখেছেন, কিন্তু যদি লেখা বন্ধই করে দিতেন তাহলে এর মাঝ থেকে মুক্তা বের হতো কিভাবে?
হুমায়ুন পাঠ শুরু করতে গিয়ে তাই যখন পেছনে তাকাই, যেটা মনে পরে সেটা হলো এই শামুকের বাচ্চাকাচ্চা দিয়েই তাঁর সাথে পরিচয়, এবং সেগুলো ঐ মারা যাওয়া বাচ্চাকাচ্চার মতই, পড়বেন, ভুলে যাবেন, এবং আরো ১০টার সাথে কোন পার্থক্য পাবেন না। অন্য অনেকের চেয়ে দেরিতে পড়া শুরু হয়েছিলো তাঁর লেখা, ততদিনে রবীন্দ্র-নজরুল-শরৎ-সুনীল-সমরেশ-শীর্ষেন্দু দেখা হয়ে গেছে, কাজেই আধা পাগলা কিশোরী-তরুণী ধরণের প্রেমের লেখা পড়ে মুগ্ধ হবার মত কিছু পাইনি। ধারণা বদলেছে মিসির আলী অমনিবাস পড়ে, এক মলাটে এতগুলো অসাধারণ খানিকটা-অলৌকিক-খানিকটা-যুক্তিবাদী-ব্যাখ্যার প্রয়াস, অন্তত আগে কখনো দেখিনি। হিমু’র বইগুলো বিনোদন হিসেবেই দেখেছি, খুব বেশি দাগ কাটার মত লাগেনা এখনো, অন্তত মিসির আলী’র ধারেকাছেও না। নাটকের বেলায় অবশ্য ভিন্ন কথা, বহুব্রীহি-অয়োময়-কোথাও কেউ নেই আর ঈদের নাটক দেখে দেখে হুমায়ুন আহমেদ আমাদের প্রজন্মের কাছে সেরা নাট্যকার (দয়া করে কেউ ইবসেন-বার্নার্ড শ’ টানবেন না, অত পণ্ডিত কখনোই ছিলাম না, নাটক মানে এখনো আমার কাছে বিনোদন), অনেকটা সত্যজিৎ রায়ের মত, ভদ্রলোক যে আগে পৃথিবীর অন্যতম সেরা পরিচালক, ফেলুদা আর শঙ্কুর স্রষ্টা যে তার অপ্রধান পরিচয়, অনেকটা বড় না হয়ে জানতাম না, জানার দরকার-ও বোধ করিনি।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ভদ্রলোকের প্রথম লেখা উপন্যাস– যেটা এই মুহূর্তেও হাতে আছে আমার– উপন্যাস সমগ্র-১ এর অংশ হিসেবে, নন্দিত নরকে, পড়ি কলেজে ওঠার পর। অনুভূতিটা বোঝানো কঠিন, স্তব্দ্ধ, তবে সেটা শোকাবহ, নাকি বিষণ্নতা, নাকি মুগ্ধতা, অথবা খানিকটা রাগ-ক্ষোভ-দুঃখের মিশেল, নির্ধারণ করা যায় না, অন্তত একজন কলেজ ছাত্রের জন্য কাজটা কঠিন। মনে হয় একটা আপন মনে কথা বলে যাওয়ার সুর, সানাইয়ের চেয়েও অনেক বেশি বিষণ্ন, যেন পৃথিবীর কোন কিছুতেই তার কিছু যায়-আসে না, শুধু খুব খুব দুঃখের সুরে দেখে যাওয়া আর বলে যাওয়া। এই বক্তা কিছু করতে চায় না, কিছু বদলাতে চায় না, সেই ক্ষমতাও যে আছে সেটাও না। শুধু নিম্নমধ্যবিত্ত একটা পরিবার নয়, বরং সেই মানসিকতার একটা আশ্চর্য প্রতিফলন। যতদূর মনে আছে, নন্দিত নরকে পড়বার পর ২-৩ দিন খুব একটা স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলাম না, কেমন একটা আচ্ছন্ন অনুভূতি, কিছুই ভাল না লাগার একটা তাগিদ, কিছুই না করবার একটা ঝোঁক। মাথায় শুধু মন্টু, রাবেয়া, মাস্টার কাকা আর রন্ঞ্জু, আর গোধুলির মত একটা মনখারাপের আড়ি। এখন, আবার যখন পড়ছি, অনুভূতির খুব একটা হেরফের হয়েছে এমনটা বলা যায় না। প্রথম উপন্যাস এটা লেখকের; সম্ভবত এই একটা উপন্যাস লিখে চুপচাপ বসে থাকলেও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লিখতে গেলে হুমায়ুন আহমেদের নাম লিখতে হতো, এমনকি পরের ৪০ বছরেও হুমায়ুন আহমেদ নিজেও এই সর্বোচ্চ মানে আর পৌঁছাতে পেরেছেন বলে মনে করি না।
পরের বই শঙ্খনীল কারাগার। পড়তে গেলে ঠিক একই রকম ডুবে যাওয়া অনুভূতি, এমন এক দুঃখ যা থেকে ভেসে ওঠা যায় না, চারদিক থেকে জড়িয়ে ধরে। নিজেকেই জিজ্ঞেস করবো যে জীবনডা এত কষ্টের ক্যানে মনা; পরক্ষণেই জবাব পাবো যে জেবনডা এমন কষ্টের-ই, খুব ভাগ্যবান কেউ কেউ ছাড়া এই থেকে বের হবার উপায় নেই। তাই রণ্ঞ্জু অনেক ধনী হয়ে গেলেও ঝুনু’র জন্য কষ্টে ডুবে যাই, আর রাবেয়ার একাকীত্ব ভাগাভাগি করি। কিটকী-কে না পেয়ে এই রণ্ঞ্জু আত্মহত্যা করে না বা দেবদাস হয় না, অনেকগুলো ভাই-বোন আর মা-বাবা রেখে যার-তার জন্য হঠকারী কিছু করার চেয়ে ৪৯০ টাকার একটা কলেজের মাস্টারি একটা নিম্নমধ্যবিত্ত ছেলের জন্য অনেক বেশি দরকারি, গোপন প্রেমের জন্য সাহস দেখাবার সাহস কোথায় তার? এই লেখাটা পড়ার সময়েও বারবার মনে হবে, হুমায়ুন এই ভাষারীতি ধরে রাখতে পারেননি পরে, ৪০ বছর আগের এই হুমায়ুন বর্তমান হুমায়ুনের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক, অনেক বেশি শেকলছাড়া, প্রকাশক আর পাঠকের রুচির ব্যাপারে শঙ্খনীল কারাগারের লেখক কেয়ার করেন না, যেমনটা করেন হিমু ও হার্ভার্ড পিএইচডি বল্টু ভাইয়ের লেখক। একই অনুভূতি হবে “ফেরা” উপন্যাসটি পড়ার সময়, শুধুমাত্র ব্যতিক্রমী সহজ ভাষা দিয়ে কিভাবে পাঠককে ডুবিয়ে মারা যায় সেটা জানার জন্য হলেও একবার উপন্যাসটা পড়া উচিত, পড়তে পড়তে যে অন্ধকার এক মেঠো পথে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছিলাম সেখান থেকে বের হয়ে আসতে বেশ অনেকটা সময় লেগেছে।
ঠিক অতটা গভীরে না গেলেও, বহুব্রীহি-কে প্রিয় তালিকায় রাখতে হবে হালকা রম্যের মাঝে আবারো চিরচেনা বিষণ্ন আর গভীর সুর নিয়ে আসার জন্য, অনেকটা সন্ঞ্জীবের লোটাকম্বলের মত, দর্শকরা যদিও নাটকের জন্যই বহুব্রীহি-কে মনে রাখবেন বহুদিন। হুমায়ুন আহমেদের একদম-ই একক বৈশিষ্ট্য যেটা, ভাঁড়ামি বা বাড়তি কিছু না বলে শুধু সংলাপের মাধ্যমে হাসি ফোটানো, সেটার আদর্শ উদাহরণ বহুব্রীহি, যদিও পরে হিমুবিষয়ক বইগুলোতে নিজেই এর খানিকটা সস্তা সংস্করণ প্রয়োগ করেছেন, যেটা শেষদিকের বইগুলোতে ক্লিশে শব্দগুচ্ছের ভাঁড়ামিতে রূপান্তরিত হয়েছে। নাটকের জনপ্রিয়তায় চাপা পড়ে যাওয়া আরো দু’টো ভাল উপন্যাস অয়োময় আর কোথাও কেউ নেই, সাথে আছে এইসব দিনরাত্রি। অসাধারণ– বই আর নাটক, দু’টো সংস্করণ-ই।
অন্যদের মত হুমায়ুন আহমেদের কল্পবিজ্ঞানের ঠিক ভক্ত নই আমি, তাঁর প্রথম কল্পবিজ্ঞান “তোমাদের জন্য ভালবাসা” আর পরে “ইরিনা” ছাড়া কোনটাই ভাল লাগেনি, এই জায়গায় বরং মুহাম্মদ জাফর ইকবাল পছন্দনীয়। তারচেয়ে কথা বলা যায় তাঁর আত্মজৈবনিক লেখাগুলো নিয়ে, যার মাঝে সন্দেহাতীতভাবেই ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় উপরে রাখবো “হোটেল গ্রেভার ইন”। আমেরিকাবাস নিয়েই আরো দু’টি লেখা “মে ফ্লাওয়ার” আর “যশোহা বৃক্ষের দেশে”-ও মন্দ না, পছন্দের তালিকায় আছে “আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই”, “এই আমি” আর “অনন্ত অম্বরে”-ও। শেষদিকের লেখা বলপেন-ফাউন্টেন পেন-কাঠপেন জাতীয় লেখাগুলো প্রথমদিকের লেখাগুলোর সাথে মিলিয়ে নিরপেক্ষভাবে দেখলে হুমায়ুনের নিজের-ই লজ্জা পাবার কথা, তবে তিনি কখনোই সেটা করেছেন বলে মনে হয় না।
এই অমিত প্রতিভাবান লেখক তাঁর আরো অনেক দিকের মত-ই সম্ভবত ছোটগল্প লেখার ক্ষমতার দিকে-ও সুবিচার করেননি, বলা যায় অবিচার-ই করেছেন। লেখক জীবনের মাঝামাঝি পর্যন্ত-ও টুকটাক গল্প লিখতেন, গল্পসমগ্র নামে সেরকম অনেকগুলো ছাপা-ও হয়েছে, যার অনেকগুলো-ই তুলনাহীন। সেই আটপৌঢ়ে সহজ ভাষা, কিন্তু ছোটগল্পের চমক আছে, তাঁর নিজস্ব ছাপ দেয়া বিষণ্নতা আছে, মমতা আছে, গল্পের মাঝে ডুবিয়ে দেয়া আছে। “চোর” নামের সেই গল্পটার কথাই ধরি, যেখানে মনা ডাকাতের চোখ তোলার অপেক্ষা দেখে ডাকাতের দিকেই সহানুভূতি জাগে। অথবা ধরি, “জলিল সাহেবের পিটিশন”, যেখানে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা দুই ছেলের বাবা জলিল সাহেব হানাদার বাহিনীর গণহত্যার বিচার চেয়ে স্বাক্ষর সংগ্রহ করে বেড়ান শহর থেকে শহরে, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর নাতনী সযত্নে ৫০ হাজার স্বাক্ষরের সেই ফাইল নিয়ে অপেক্ষায় থাকে কবে কেউ আসবে বিচারের সেই দাবী নিয়ে। এই গল্প সেই সময়কার যখন ভুলেও কেউ এই দাবী তুলতো না, বহুব্রীহিতে “তুই রাজাকার” স্লোগান তোলা হুমায়ুন এখানেও অগ্রণী। আবার, গুরুগম্ভীর বিষয়ের বদলে ধরা যায় “রূপা” নামের গল্পটার কথাই, এক ভদ্রলোকের ভুল মানুষকে প্রেম নিবেদন করে মমতার জালে জড়িয়ে যাবার কাহিনী, সাধারণ, তারপরেও লেখকের ছোঁয়াতে অসাধারণ।
লেখকের ব্যক্তিজীবনের সাথে তার লেখকসত্ত্বাকে গুলিয়ে ফেলা নাকি ঠিক নয়, হুমায়ুন আহমেদের বেলায় কথাটা খাটে না। তাঁর ব্যক্তিজীবন আর পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব তাঁর লেখায় অহরহ এসেছে, প্রবলভাবেই এসেছে, কাহিনীতে, চরিত্রেও। ‘৭০ দশকের আর্থিক টানাপোড়েনে বেড়ে ওঠা হুমায়ুনের গল্পের নায়ক তাই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলে রন্ঞ্জু অথবা বেকার যুবক আনিস, তাঁর বোহেমিয়ান নায়ক হিমু’র কাছে উচ্চবিত্তের কন্যা রূপা এক দূর জগতের নারী। লেখকের অর্থ-বিত্ত-খ্যাতির সাথে বদলায় তাঁর চরিত্ররাও, রন্ঞ্জুর বদলে তাই নায়ক হয়ে আসে উচ্চবিত্তের মেধাবী সন্তান শুভ্র, পায়ে হাঁটা হিমুর দহরম-মহরম বাড়ে মাজেদা খালার বাড়ির সাথে আর তাই রূপা হয়ে আসে ঝাপসা, অভাবী পরিবারের জরী-পরী-রানু থেকে মধ্যবিত্তের মীরা হয়ে নায়িকা হয়ে ওঠে উচ্চবিত্তের কন্যা মৃণ্ময়ী। চরিত্রের বয়স-ও বদলায়, হুমায়ুন আহমেদ নিজেই সেটা বলেছেন, প্রায় বালিকা বধূকে ঘরে তুলেছিলেন বলে তখনকার রুনু-ঝুনু-জরীরা বালিকার মত ছটফটে, জীবনসঙ্গীনির বয়স বাড়ে বলে সময়ের সাথে দেবী-নিশীথিনীর রানু বা নীলু সদ্য তরুণী, মীরা পড়ে ভার্সিটিতে, আর কোথাও কেউ নেই-তে মুনা অনেক বেশি পরিণত-সংযত-ধীর। ব্যক্তিজীবনের পরিবর্তন আর ওলোটপালোটের সাথে সাথে কি নিম্নমধ্যবিত্তের হুমায়ুন-ও সাধারণের থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে যান? এজন্যই কি তাঁর লেখার সেই ডুবিয়ে দেয়া জড়িয়ে ধরা আবেশ শেষ দশকে রূপান্তরিত হয় অনেকটাই অর্থহীন কথামালায়? তাঁর নায়ক-নায়িকারা তখন ঠিক যেন আমাদের পাশের বাড়ির ছেলেটা বা মেয়েটা না, বাবাগুলো ঠিক যেন মধ্যবিত্তের বাবা না, চরিত্রগুলো তাঁর কাহিনীবিন্যাসের মতই বিশৃঙ্খল। কলমের ধার আছে, কিন্তু সেটা যেন কোথায় কাটবে স্থির করতে না পেরে ডন কুহ্যোতে’র মত বাতাসের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত।
পাঠক হিসেবে হুমায়ুন আহমেদকে তাহলে কোথায় রাখবো? একজন অতিমানব যার প্রতিভার সবটুকু অনূদিত হয়নি? একজন পথভ্রষ্ট যিনি অমর হতে গিয়ে শেষমেশ মানব হয়েছেন? একজন খেয়ালী যাঁর জীবনটা গেছে নিজের ইচ্ছামত কিন্তু বন্ঞ্চিত করেছেন পাঠকদের? ব্যক্তি হুমায়ুন আহমেদের ভক্ত হওয়াটা কঠিন, তাঁর লেখনীর সাথে ব্যক্তিজীবনের বিবর্তন মিলেমিশে গেছে বলে সেটা আরো বেশি করে মনে করায়। তাঁর শেষ দশকের বইগুলোকে অনেকটাই মনে হয় পাঠকের সাথে প্রতারণা, প্রকাশক যেমন জানে পাঠক খাবেই, হুমায়ুন নিজেও সেটা জানতেন সম্ভবত, কাজেই একের পর এক নিজের খেয়ালখুশিতে অখাদ্য লিখে গেছেন। কিন্তু অখাদ্যের আড়ালেও কেউ একটিবারের জন্য-ও ভুলতে পারেনি তিনি কি লিখেছেন অতীতে, ঠিক কিসের জন্য তাঁর অখাদ্যগুলো-ও আশায় আশায় পড়তে হয় আমাদের, যদি আরেকটা নন্দিত নরকে বা শ্যামল ছায়া অথবা আগুনের পরশমণি বা নিদেনপক্ষে একটা বহুব্রীহি বের হয়ে আসে! আলোচনায় থেকেছেন, মধ্যাহ্ণ বা মাতাল হাওয়া বের হলেই জোর তুলনা হয়েছে, হলো কি এটা সেই আগের হুমায়ুনের মত?
হয়নি, কিন্তু আশা করেছে সবাই, হবে, ফিরে আসবে, আবারো দেখা হবে কোন এক অচিনপুরে, শ্যামল ছায়ায়।
লেখালেখির ৪০ বছর পার করে এতসব “অখাদ্য” লিখেও যিনি এই প্রত্যাশা জাগিয়ে রাখতে পারেন, লেখক বা মানুষ হিসেবে ইতিহাসে তাঁর স্থান স্বর্গে যদি না-ও হয়, অন্তত নন্দিত নরকে হতে-ই হবে।
হুমায়ূন বানান এর দিকে খেয়াল কইরেন বস 😛
দুর্দান্ত লেখা। :huzur:
বিশেষ করে লেখক আর লেখার মধ্যে তুলনাটা। হুমায়ূন এর বই এর নায়কদের বয়স যদি দেখি, দেখা যাবে লেখক ৩৫/৩৬ বছর পর্যন্ত নিজের বয়সই গুঁজে দিয়েছেন/ ব্যবহার করেছেন।
শেষের দিকে লেখার পরিবর্তন এর কারণ এর সাথে আমি একমত।
সত্যজিৎ আকিরা কুরোসাওয়া এর পরিচালনাও বয়সের সাথে সাথে বদলেছে বলেই মনে করি। পথের পাঁচালিই দেখা গেছে সত্যজিতের সেরা পরিচালনা রয়ে গেছে!
নন্দিত নরকের লেখকই হার্ভাড বল্টু ভাই লিখেছেন এইটা নিয়ে অবশ্য অভিযোগ তোলাটা ঠিক মনে করি না!
লেখকের স্বাধীনতা আছে তাঁর মতো করে লেখার!
(লেখকের স্বাধীনতা নিয়ে চমৎকার একটা স্পীচ আছে। সময় পেলে পড়ে দেখতে পারেন )
তবে এটাও বুঝি পাঠক হিসেবেই এই সব আপনার অনুযোগ অভিযোগ! লেখকও কিন্তু তাঁর পক্ষে সাফাই গাইতে পারেন 😛
হুমায়ূন আহমেদ একটা নন্দিত নন্দিত নরক কিংবা অল্প কিছু গল্প (চোখ গল্পটার কথা খুব মনে পড়ছে) দিয়েই সাহিত্য জগতে টিকে থাকবেন।
শঙ্খনীল কারাগার, ফেরা এই সব শুধু তাঁর আসনকেই পোক্ত করেছে।
(btw নন্দিত নরকে পড়ার পর আমারও এমন অনুভূতি হইছিল, আর পথের পাঁচালি পড়ে শুধু এমন অনুভূতি হইছে। বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে)
বাংলা কীবোর্ড কই? 🙂
স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতা এক জিনিস না, এই সূক্ষ্ম সীমারেখাটা বুঝতে এত কষ্ট কেন সবার? তুমি বই লিখলেই পাঠক কিনবে, সেইটা জানো বলে শ্রম না দিয়ে যা-তা লিখবা? হুমায়ূন জানতেন তাঁর নাম দেখলেই পাঠক কিনবে, কাজেই তিনি শেষ দশকে গাদা গাদা ফর্মায় ফেলে বই লিখে পাঠকের চাহিদার বদলে প্রকাশকের চাহিদা মিটিয়েছেন, পাঠক তাঁকে যে ভালবাসা দিয়েছে, এই ধাপ্পাবাজিটা করে সেটার খানিকটা হলেও এইখানে তিনি অসম্মান করেছেন বলে আমার ধারণা, এছাড়া পাঠক হিসেবে তাঁর দিকে আমার কোন অভিযোগ নেই।বাংলা কীবোর্ড কই? 🙂
স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতা এক জিনিস না, এই সূক্ষ্ম সীমারেখাটা বুঝতে এত কষ্ট কেন সবার? তুমি বই লিখলেই পাঠক কিনবে, সেইটা জানো বলে শ্রম না দিয়ে যা-তা লিখবা? হুমায়ূন জানতেন তাঁর নাম দেখলেই পাঠক কিনবে, কাজেই তিনি শেষ দশকে গাদা গাদা ফর্মায় ফেলে বই লিখে পাঠকের চাহিদার বদলে প্রকাশকের চাহিদা মিটিয়েছেন, পাঠক তাঁকে যে ভালবাসা দিয়েছে, এই ধাপ্পাবাজিটা করে সেটার খানিকটা হলেও এইখানে তিনি অসম্মান করেছেন বলে আমার ধারণা, এছাড়া পাঠক হিসেবে তাঁর দিকে আমার কোন অভিযোগ নেই।
একজন লেখক স্বেচ্ছাচারী হলে সমস্যাই বা কোথায়?!! ধরেন আপনি এখন থেকে ঠিক করলেন যে টোয়াইলাইট এর পক্ষে লিখবেন…কেন এইটা অতীব জরুরি একটা ফিকশন ব্লা ব্লা…আপনার সেই রাইট আছে। আমারও রাইট আছে আপনাকে পরিত্যাগ করার!! আপনার লেখা পড়ব না! স্ট্যাটাসে লাইক দিব না 😛
…
এটা ধাপ্পাবাজি কেন হবে? পাঠক বই কিনেছে কেন? পাঠক ছাড়লেই তো হয়ে যেত! সিম্পল! খারাপ লিখলে পাঠক থাকবে না। পাঠক প্রিয়তার দায়ভার পাঠকেরই। ১২/১৫ বছরেও যদি পাঠকরা না বুঝে এই লেখক সেই সাহিত্য আর লিখেন না তাহলে তো দোষ পাঠকেরই!
(নজরুলের ইচ্ছা হইছে হামদ নাত লিখছে ইচ্ছা হইছে শ্যামা সংগীত লিখছে সমস্যা কই?! এইটা ওর রাইট!)
বাংলা কিবোর্ড সাইট স্লো করে 🙁
যতটা সিম্পল বলে মেরে দিলা অতটা সিম্পল মনে হয় না। দোষটা ২ পক্ষের-ই, এই ক্ষেত্রে পাঠককে আমি অপেক্ষাকৃত “ইনোসেন্ট” পক্ষ হিসাবে রাখবো। ধর আমাদের জনগণ আর রাজনীতিবিদদের কথা। জনগণ জানে এরা সব চোর, তারপরেও আশায় আশায় ঘুরেফিরে ঐ ২ লাউ আর কদু-রেই ভোট দিবে, এইভাবে তো গেল ৪০ বছর। এই সরলতা বা বোকামি-ও একটা দোষ, কিন্তু যারা সেইটার সুযোগ নেয় তাদের দায়টা আরো বেশি, হুমায়ূন ঐ দায় এড়াইতে পারেন না।
বাংলা কীবোর্ড ছাড়া বাংলা ব্লগে লেখা বা কমেন্ট করা একটা মহা পেইন।
অসাধারণ একটা লেখা।
আমার কাছে মনে হয়, জীবনের সাথে মিশে যাওয়ার মতো অনেক লেখাই লিখে গেছে হুমায়ূন আহমেদ। সহজবোধ্যতার স্রোতে হারিয়েছি সেই লেখায় বহুবার এবং হারাবো হয়তো আরো অনেক বার……
তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাহেচড়া করাটা রীতিমতো কদর্য রূপ নিয়েছে……
কেউ ভাবে না তাঁর নিজের বাপ-রে নিয়া এইভাবে টানাটানি করলে কেমন লাগবে! সীমালঙ্ঘন শব্দটার অর্থ-ই আমরা বুঝি না।
ভাল লেগেছে লেখাটা। প্রায় সবগুলো জায়গাতেই একমত!
আমার কাছেও লেখকের ব্যক্তিজীবনের সাথে লেখকজীবন না মেলানোটা কঠিন মনে হয়। তবে সেজন্য ফেসবুক তর্কে নামি না, এই আর কি। গানের বেলাতেও তাই দেখছি। কেউ লেখার ধরন/গান গাওয়ার ধরনের জন্য প্রিয় হলে তখন ব্যক্তিজীবনকে ইগনোর করা যায়। কিন্তু লেখার কিংবা গানের বিষয়বস্তুতে ব্যক্তিত্বের প্রভাব থাকে, আর তখন ব্যক্তিসত্ত্বা আর শিল্পীসত্ত্বা অনেক সময়েই এক হয়ে যায়।
এক মনে হলেও দুইটা এক না। আমি ফেসবুকে বিয়ের ছবি দেই তারমানে তো আর এই না যে সবাইকে আমার বাসরঘরে ঢুকতে বলি, নাকি?
:S
আমি তো বললামই যে আমি তর্কে নামি না। লেখক সম্পর্কে আমার মনোভাব বদলে যায়, সেটা বলেছি। ফেসবুকের/রিয়েল লাইফের হুমায়ূন বিতর্কে আমার অংশগ্রহণ শূন্য।
আমার মন্তব্যটা আপনার এই কথার প্রেক্ষিতে ছিল: “লেখকের ব্যক্তিজীবনের সাথে তার লেখকসত্ত্বাকে গুলিয়ে ফেলা নাকি ঠিক নয়, হুমায়ুন আহমেদের বেলায় কথাটা খাটে না।”
সমস্যা আমার লেখার-ই, অল্প জায়গায় বেশি বলতে গিয়া আর বুঝাইতে পারি নাই, কাজেই খানিক ব্যাখ্যা করি। বলতে চাইছি হুমায়ূনের অবস্থা আর অভিজ্ঞতার পরিবর্তনের সাথে সাথে তাঁর লেখার ভঙ্গি বা প্লটেও পরিবর্তন এসেছে, সেটা আমাদের ভাল-ও লাগতে পারে, খারাপ-ও লাগতে পারে, কিন্তু সেটা আমাদেরকে তাঁর ব্যক্তি বা পারিবারিক জীবন নিয়ে টানাটানির বা সেটার সাথে তাঁর সাহিত্যকে ভাল লাগা মন্দ লাগায় ফেলে দেয়ার অধিকার দেয় না, এই ২টা বিষয় ২টা স্বাধীন চলক।
nice
ধন্যবাদ।
ভাল লাগল।
ধন্যবাদ 🙂
অসাধারণ পোস্ট!
শক্তিশালী, একই সাথে পাঠককে টেনে নিয়ে যাবার মত।
তুলনাগুলো ভালো লেগেছে।
আপনার পুরো পোস্টটির সাথে সহমত। আসলে আমরা লেবু কচলাইতে কচলাইতে তিতা না বানাইলে শান্তি পাই না। ফেইসবুকের কল্যাণে এই প্রবণতা লাগামহীন ঘোড়ার মত ছুটে চলেছে। 🙁
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হইল……… অসাধারণ একটি লেখা পড়লাম !! 🙂
লেখা ভাল হয়েছে তবে একটা তথ্যবিভ্রাট আছে। গল্পটার নাম চোখ, চোর নয়।
হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে জীবিতকালে (সাহিত্য বিষয়ে ) সমালোচনা হয়নি হয়েছে মূলত অতি স্তাবকতা এবং হিংসা নিন্দার চর্চা। তোমার সমালোচনা ভাল লাগল ফারহান। বেশ বস্তুনিষ্ঠ।
সুন্দর