ইদানিং, যখন ক্লাসের পাশে করিডোর ধরে হেঁটে যাই কিংবা ক্যাফেতে, অথবা হলের পথে যেতে, আর কমন রুমে – আমার বড্ড একঘেয়ে লাগে। এত মানুষ চারপাশে, সব্বাই শুনি একই কথা বলছে, বলছে তো বলছেই। সেই যে আমরা প্রথম এখানে এসে যেই কথাগুলো বলতাম, নতুন ব্যাচের মুখে একই কথা – একদম ঠিক ঠিক সেই কথাগুলোই শুনতে পাই। আমরা ঠিক যেই যেই কথাগুলো যে সময়ে বলে এসেছি, সে সময়ের মানুষগুলো ঐ পুরনো একঘেয়ে কথাগুলোই বলতে থাকে। কে রাত জেগে ড্রয়িং করেছে…কোন্ স্যার পরীক্ষায় তুলোধুনো করেছে, কোন্ ম্যাডাম কেমন করে যেন কথা বলে, কে কে পড়াতে পারে না, কার কার কার…। পুরনো এই বিল্ডিং-এর ছাদ বেয়ে যখন বৃষ্টির পানি চুঁয়ে পড়ে তখন একঘেয়েমিতে পায় না, যখন হঠাৎ এত্ত এত্ত সবুজের ফাঁকে একটা পথহারা কাঠঠোকরাকে খুঁজে পাই তখনো না, কিংবা হেঁটে হেঁটে একই ক্যাম্পাস অসংখ্যবার চক্কর দিতে অথবা একই মানুষদের সাথে এতদিন ধরে ক্লাস করতে বা এইসব হাবিজাবি একই একই ভাবনা এতবার করে ভাবতে কখনো একঘেয়ে লাগে না – কিন্তু ওদের, এই সবার কথাগুলো, অনেক সময় নিজের কথাগুলোও নিজের কানে এত অসহ্য একঘেয়ে ঠেকে কেন? জানি না। শুধু আমারই হয়? সে-ও জানি না।
হঠাৎ করে রাস্তায় চলতে কিংবা বাসের জানালা দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার সময় কেউ বা কারা এই একঘেয়েমির সুতো ধরে টান দিয়ে যায়। তখন আবার মানুষের কথা শুনে না-শোনা অংশটুকু নিয়ে গল্প বানাতে ভাল লাগে…কারা কথা বলছে তাদেরকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নেওয়ার লোভ সামলানো দায় হলেও বিব্রত করতে চাই না বলে নিজেকে থামিয়ে দিতেও ভাল লাগে। তখন অনেক অনেক গল্প ঘুরতে থাকা জট পাকিয়ে জড়িয়ে যাওয়া ঘুড়ির মত, এই মনের আকাশে – সেখানে রিনরিনে হাসি থাকে, চোস্ত বাংলার কথা থাকে, অনুনয় থাকে, ভান থাকে আর আরও অনেক কিছু; তারপর সব গল্পে জল ঢেলে দিয়ে রাজ্যের ঘুম এসে নামে চোখের পাতায়। কিছুই আর লেখা হয় না।
ঘুম ভাঙা আকাশ ভর্তি থাকে মেঘে, সব আমার প্রিয়তম মেঘ। অনেক রকমের নীল মেঘ, আর কোনটা সাদাটে থাকে, কালোও থাকে কোনদিন, আর সূর্যের আলো পড়ে সোনালি…কখনো আবার লাল আর কমলাও হয়, কী অদ্ভুত! তারপর সব মেঘ মিশে গিয়ে সারা দিন ঝির ঝির শব্দ করে এসে আমার জানালা-বিছানা-টেবিল আর শরীর-মন ভিজিয়ে চুপচুপে করে দিয়ে যায়। সেই দিনের শেষে আরেকটা দিন আসে, তখন আর আকাশে মেঘ থাকে না, প্রিয়তম মেঘেরা একদিনের নোটিসে হাওয়া হয়ে গিয়ে খটখটে রোদ এনে দেয় পৃথিবী জুড়ে।
তখন? তখন আমি কিছু করার পাই না, আর বড্ড হা-হুতাশ জাগে, আর-আর মনে হয় যে আমার পৃথিবীটা কেমন ফাঁকা পড়ে আছে। সেখানে পায়রাদের ডানা ঝাপটানোর সুর নেই, হঠাৎ জানালার পাশে গাছটার পাতার ফাঁক গলে আসা শরীর জুড়িয়ে যাওয়া নরম বাতাস নেই, অনেক দূর থেকে ভেসে আসা হঠাৎ বাঁশির সুর নেই, তুমি নেই, সে নেই, ওরা কেউ নেই…শুধু কাঠফাটা রোদ আর ধু ধু শূন্যতা আছে।
কে যেন গতকাল রাত থেকে বলছিল যে সে আর আগের মত লিখতে পারে না। আগের মত বৃষ্টি-বিকেল, একাকী রাত আর মেঘের গল্প লিখতে পারে না।
কে যেন বলেছিল, তার গল্পেরা এখন আর বাঁশি বাজায় না, চুড়ির রিনিঝিনিতে ছুঁয়ে যায় না কিংবা ঘুমের দেশের টুক করে মিঠে রোদের স্বপ্নও দেখে না।
কে যে বলেছিল, খুব একাকী কিছু কথা, খুব নিজের কিছু কাব্য, হারিয়ে যাওয়া সুতো ছেঁড়া ঘুড়ির হাহাকার এখন আর গল্প আঁকে না।
কে যেন বলেছিল কাল রাতে, কী যেন বলেছিল।
আমি শুধু জানি, সে ভুল বলেছিল, ভুল বলেছিল।
কারণ তার গল্প, মেঘলা আকাশ, শরতের রঙ, টুকরো হাসি আজও আমায় ছুঁয়ে যায়।
(লেখা প্রিয়তে নিতে বাধ্য হলাম, আগের মতই)
আর তোমার মন্তব্য তো আমার লেখার চেয়েও সুন্দর!
এইরকম বললে কিন্তু এরপর থেকে আর তোর কোন লেখাতেই কোন মন্তব্য করব না! :nono:
আহ মেঘ! বড্ড ভালোবাসি লাল মেঘ,নীল মেঘ, সাদা মেঘ, ছাই রঙ্গা মেঘ… মন খারাপ করা মেঘ, মন ভালো করা মেঘ…এই এক মেঘের এত রূপ, এত এত অনন্য অনুভূতি দেবার ক্ষমতা!
আমার খুব প্রিয় একটা গান মনে পড়ে গেল। তোমাকে গিফটাইলাম সুন্দর লেখার জন্য। :love:
“মেঘ হলে মন বিকেল বেলায় একলা যেতাম মেঘের বাড়ি…মেঘ হত কাশফুলের দু’চোখ, দৃষ্টি কিন্তু খুব আনাড়ি…
কিন্তু মনে মেঘ থাকে না, মেঘ ছাড়া আকাশ খালি…বোতাম খোলা জানলা বুকে, বইছে হাওয়া শুধু শুণ্যতারই…”
এই গানটা তো শুনি নি আপু আগে! লিঙ্কুটা দিবেন? 😀
সরি লিঙ্কটা নিচে চলে গেছে ভুলে।
শ্রীকান্ত আচার্য্যের গান। 😀
http://www.youtube.com/watch?v=KTySQbTPGkE
শুনলাম আপু। শ্রীকান্তের গান সবসময়েই সুন্দর। 🙂
মাই অল টাইম ফেভারিট! 😀
খুব ভালো লেগেছে।
হিংসে হয় এই রকম মুক্তগদ্য লিখতে পারি না বলে! 🙁
আমারও ভীষণ হিংসে হয়!
আমিও পারি না। :crying:
ধন্যবাদ ধন্যবাদ
কি সুন্দর!!! সত্যি! আমি নিজেই ভাবনার আকাশে যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম।
বলিস কী! 😀
জীবন পথে চলতে আমরা প্রত্যেকেই বিশেষ কিছু অর্থহীন কাজ আর অনুভূতির মধ্য দিয়ে যাই,
অতপর একসময় ঐ কথা বা কাজগুলো অন্যরা করলে কখনো হাসি পায় কখনো বিরক্তি লাগে;
ঠিক একইভাবে আমরা এখন হয়ত এমন কিছু কথা বা অনুভূতিকে এতটা মূল্য দিচ্ছি সেটা ভেবে ভবিষ্যতে নিজেই হাসব…:P
তাই বলে এই কথা আর অনুভূতিগুলো কি মিথ্যে বা মূল্যহীন???
…মনে হয়না।।
সামিরা আপু, অনেক ভালো লাগলো লেখাটি; কারণ সময় আর বয়সের বৃত্তে আমাদের বন্দিত্বকে খুব সাবলিল ভাষায় প্রকাশ করেছেন…
অনেক ধন্যবাদ। খুব ভাল লাগলো মন্তব্যটা। 🙂
ভাল লেগেছে।
ধন্যবাদ।
………শুধু কাঠফাটা রোদ আর ধু ধু শূন্যতা আছে……
….. সেই শূন্যতা বুকে পুরেই যদি এত সুন্দর কথা বেরোয় তবে আরো আরো শূন্যতা চাই 😛 😀
খারাপ খুব খারাপ তুই!
“হঠাৎ করে রাস্তায় চলতে কিংবা বাসের জানালা দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার সময় কেউ বা কারা এই একঘেয়েমির সুতো ধরে টান দিয়ে যায়। তখন আবার মানুষের কথা শুনে না-শোনা অংশটুকু নিয়ে গল্প বানাতে ভাল লাগে…কারা কথা বলছে তাদেরকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নেওয়ার লোভ সামলানো দায় হলেও বিব্রত করতে চাই না বলে নিজেকে থামিয়ে দিতেও ভাল লাগে। তখন অনেক অনেক গল্প ঘুরতে থাকা জট পাকিয়ে জড়িয়ে যাওয়া ঘুড়ির মত, এই মনের আকাশে – সেখানে রিনরিনে হাসি থাকে, চোস্ত বাংলার কথা থাকে, অনুনয় থাকে, ভান থাকে আর আরও অনেক কিছু; তারপর সব গল্পে জল ঢেলে দিয়ে রাজ্যের ঘুম এসে নামে চোখের পাতায়। কিছুই আর লেখা হয় না।”
🙂
ভীষণ ধরণের হিংসা করি এই আপনাকে, আপনার লিখার মধ্যকার খামখেয়ালীপনা-টাকে, কিংবা হঠাৎ করেই লেখাকে বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে শব্দ থেকে বৃষ্টি নামিয়ে আনা, কখনো এমন করে লিখতে পারতাম যদি……
তবু সৌভাগ্য এতোটুকু, আমার ভাবনাটা ঠিক আমার মতো করেই আরেকজন লেখনীতে জড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে……
অসাধারণ, সবসময়কার মতোই……
হাহা! আর আমি আপনাদের এত সুন্দর মন্তব্যগুলিকে হিংসা করি। কত লেখা ভাল লাগে, এত সুন্দর করে তো বলতে পারি না। 🙂
অনেক সুন্দর।
মেঘের মতন শব্দগুলো পাঠকমনের নীলাকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে যেন … তুলোর মতন করে… মুক্ত স্বাধীন… অদ্ভূত …
এমন লেখা আরো আসুক।
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। 🙂
কি সুন্দর এক একটা শব্দের সাথে আরেকটা শব্দের বুনন! এত সুন্দর সুন্দর লেখা পড়ে সত্য ঈর্ষা হয় আপু।
খুবই সাধারণ লেখা। 🙂
এখানেই তো তোমার স্বার্থকতা আপুজী। সাধারণটাকে অসাধারণ করে তোলা। :yahooo: