আমি ঝাল খেতে পারি না একদম। আমার বাসাতেও রান্নাতে ঝালের নামগন্ধ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কাউকে বেশি ঝাল খেতে দেখলে আমার বিস্ময়ের অবধি থাকে না, যেমন আমার নানী। নানীর হাতের ভর্তা খেতে গেলে চোখের পানি-নাকের পানি এক হয়ে যায়। আমার এক বন্ধু আছে, তার কাঁচামরিচ খাওয়া দেখলে থ হয়ে যেতে হয়।
তো, সেবার অসুখ বাঁধানোর পর শাস্তিস্বরূপ ডাক্তারের দেয়া একগাদা ঔষধ খেতে গিয়ে আমার মুখ এমন তেতো হয়ে গেল, যা খাই তাই অতি বিস্বাদ লাগে। কী করি ভাবছি, এমন সময় একদিন খালামনির রান্না বেশ ঝাল একটা তরকারি খেয়ে আবিষ্কার করলাম, কয়েকদিনের মধ্যে এই প্রথম কোনকিছু তেতো লাগছে না। সেই থেকে শুরু। কাঁচামরিচের প্রতি আমার হঠাৎ জেগে ওঠা ভালবাসা আর প্রতি বেলায় একটা করে কাঁচামরিচ ধ্বংস করে অবাক হয়ে ভাবা – আরে, আমি মরিচ খাচ্ছি! 😛
প্রতিদিনের মত সেদিনও আবোল-তাবোল নানান কথা ভাবছি, এমন সময় মনে হল, আচ্ছা, আমরা যে এত হরেক রকম ফলমূল, শাকসব্জি খাই, ঠিক এগুলোই যে খাওয়ার মত, অন্যগুলো নয়, সেটা আমরা জানলাম কিভাবে? তার মানে আমরা মানুষরা গাছপালায়, বনে-বাদাড়ে যা কিছু পাওয়া যায় সবই চেখে দেখতে দেখতেই ঠিক করেছি যে কোন্টা কোন্টা খাওয়া সম্ভব?! ভাবুন তো, একটা কিছু চাখতে যেয়ে দেখা গেল সেটা বিষাক্ত, তখন কী হত? টুপ করে মরে যেত সে মানুষটা? কী ভয়াবহ! ইন্টারনেটে একটা আর্টিক্লে এটা নিয়ে পড়লাম সেদিন। মিষ্টি পছন্দ করা আর তেতো স্বাদ অপছন্দ করার ব্যাপারটা নাকি এখান থেকে এসেছে, কারণ ভিটামিনে ভরা, নিরাপদ পাকা ফলগুলো সাধারণত মিষ্টি হত, আর বিষাক্ত খাবারগুলো তেতো। আদিম মানুষের এই স্বভাব এখনো রয়ে গেছে আমাদের মাঝে, যে কারণে বাচ্চারা মিষ্টি খাবার পছন্দ করে আর তেতোটা করে না। এটা অনেকটা অন্ধকারে ভয় পাবার মত, হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের জন্য আদিম মানুষ অন্ধকারে ভয় পেত, যেটা আমরা ছোটবেলায় শহুরে কংক্রিটের জঞ্জালে থেকেও কাটিয়ে উঠতে পারি না।
আমি জীবনে যে উপলক্ষে আম্মুর সবচেয়ে বেশি বকা হজম করেছি, সেটা হল খাওয়া-দাওয়া। খাবার নিয়ে বেশি খুঁতখুঁত করি দেখে আমার স্বাস্থ্য-সচেতন মায়ের দুঃখের অবধি নাই। এত পড়াশোনা শিখেও(!) স্বাস্থ্য সম্পর্কে আমার জ্ঞানের স্বল্পতার কথা প্রতিদিন আমাকে মনে করিয়ে দেয় সে। 😛 খাবার নিয়ে এমন খুঁতখুঁতানিরও অনেক রকম কারণ থাকে। যেমন যেসব বাচ্চাদের জোর করে খাওয়ানো হয়, তারা বড় হয়ে বেশি খুঁতখুঁতে হতে পারে। আবার অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর কিংবা উদ্বিগ্ন মানুষেরাও খাবারের বেলায় বেশি বাছবিচার করতে পারেন। বাচ্চাদের মধ্যে বেশি দেখা যায় এমন খুঁতখুঁতানি, যেটাকে বলা হয় food neophobia ((http://en.wikipedia.org/wiki/Food_neophobia)) ।
খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাসের ব্যাপারে পরিবারের অবদান থাকে অনেক সময়। যেমন যেসব পরিবারে নানান রকম খাবারের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়, একই ধরনের খাবারে মেন্যু সীমিত থাকে না, সেসব পরিবারের ছেলেমেয়েদের নতুন নতুন খাবার চেখে দেখতে আগ্রহী হয়। আবার চঞ্চল কিংবা রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষদেরও খাওয়ার ক্ষেত্রে নতুনত্বের দিকে ঝোঁক থাকে। টক, ঝাল, কিংবা যেসব খাবার খেলে অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে, সেগুলোও নাকি এদের পছন্দ! 😯
মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাবা-মারা চাইলে জন্মের আগ থেকেই বাচ্চাদের খাওয়ার ব্যাপারে ট্রেইন-আপ করতে পারেন! জন্মের আগে মায়ের amniotic fluidএ আর জন্মের পর মায়ের দুধে বাচ্চারা তাদের মায়েরা যেসব খাবার খান, তার স্বাদ-গন্ধ টের পায় আর বড় হয়ে সেসব খাবারের দিকে ঝুঁকে পড়ে। যেমন এক সমীক্ষায় এমন মায়েদের গাজরের জুস খেতে দিয়ে দেখা গেছে, এসব বাচ্চাদের বড় হবার সাথে সাথে গাজর খাওয়ার অভ্যাস হয়েছে, যা অন্য বাচ্চাদের হয় নি।
খাওয়ার অভ্যাস পাল্টানোটা এমনিতে যতটা কঠিন মনে হয়, আসলে ততটা না। নিউ ইয়র্কের এক সাইকোলজিস্ট অসুস্থতার জন্য তার এভারেজ খাবার মেন্যু পালটে ভেজিটারিয়ান হয়ে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর একদিন লোভ সামলাতে না পেরে পুরনো অভ্যাসমত প্রিয় আইসক্রিম স্যান্ডুইচ খেতে যেয়ে দেখেন, আগের মত ভাল লাগছে না আর। অনেকদিন চিনি না খাওয়ার পর একদল ডায়াবেটিক রোগীর কাছে একটা ফল স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক মিষ্টি লাগছে, এমনটা দেখা গেছে এক সমীক্ষায়। অনেকদিন কোন খাবার খেতে থাকলে সেটাতে অভ্যস্ত হয়ে যাই আমরা, খেতে যেমনই হোক। একইভাবে কোন পছন্দের খাবারও টানা অনেকদিন না খেলে সেটার প্রতি আকর্ষণ কমে যায়।
সবশেষে, যেসব দুখী বাবা-মার আমার মতন food neophobic বাচ্চা আছে, তাদের জন্য কিছু অপ্রয়োজনীয় টিপস:
১/ কোন নতুন খাবারে অভ্যস্ত করতে হলে সেটা আপনার বাচ্চাকে কমপক্ষে ১৫ বার সাধুন! 😯 বেশির ভাগ মা-বাবাই ৫ বারের পর ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আপনি হাল ছাড়বেন না যেন!
২/ অপছন্দের খাবারের সাথে পছন্দের খাবার মিশিয়ে দিন। যেমন সবজির সাথে চিনি মেশাতে পারেন প্রথম প্রথম! 😛 আমরা অনেকেই প্রথম প্রথম চা-কফি চিনিসহ খেলেও পরে চিনি ছেড়ে দেই। সেক্ষেত্রেও একই পলিসি কাজ করে।
৩/ খাবারের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানলে নাকি খাওয়ার অভ্যাস পালটানো সহজ হয়ে যায়। তাই আর কিছুতে কাজ না হলে আমার মায়ের মত অনবরত আপনার বাচ্চাকে জানাতে থাকুন কোন্ খাবার খেলে তার জীবনে কী উন্নতি হবে। তবে এতে কতটুকু কাজ হবে বলতে পারছি না! :babymonkey:
Bon appétit!
তথ্যসূত্র: সাইকোলজি টুডে ((http://www.psychologytoday.com/))
হেহেহে একেবারে খাদ্যময় পোস্ট! :happy: আমি আগে এত ঝাল খেতাম না, ইদানিং কি যেন হইসে, ঝালে ঝালময় খাদ্য বড়ই ভাল পাই। :thinking:
আরে আমরা দুজন দেখি একই পথের পথিক! 😛
হিহিহি 😛 তবে ঝাল খাওয়া কমাতে হবে, স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। 🙁
ওহ ভুলে গিয়েছিলাম, বাচ্চাদের খাওয়া নিয়ে খুব সুন্দর কিউট একটা ভিডিও এখানে দেখতে পারো যদি না দেখে থাক। 😀
http://www.youtube.com/watch?v=8FbmnaiZjMQ&feature=relmfu
দেখলাম আপু, খুবই সুন্দর! :love:
এই নিয়ে পোনে তিনবার পড়লাম লেখাটা। পোনে দুইবার ব্লগে দেয়ার আগে, একবার ব্লগে দেয়ার পরে। প্রতিবারই মজা লাগছে পড়ে। (তোর স্টাইলে লিখলাম 😛 )
আগের মতই ১ নাম্বার সূত্রের সাথে দ্বিমত পোষণ করছি। যদিও জানি সূত্রটা তোর না। 😛
আর ঝালের সাথে আমার প্রেমের কথা তো সর্বজনবিদিত! :love: :love:
অফটপিক-
আমার শ্বশুরবাড়ির কথা চিন্তা করে মায়া লাগতেছে! 🙁
বেচারারা আমি রান্না করলে ঝালে মুখেই দিতে পারবে না হয়ত! 😛
নানীর মত অবস্থা! আমরা নানীর রান্না খেয়ে ঝাল-ঝাল করি আর নানী বলে ঐটাই নাকি স্বাভাবিক। 😯
তোর নানী আমার সাথী তাহলে! :happy:
আমার রান্না তো খেয়েছিস।
অবশ্য তুই ডেজার্ট আইটেম খেয়েছিলিস, তবে অন্যরা স্ন্যাকসও খেয়েছে। খেয়ে ঠিকঠাক হজম তো করল দেখলাম। 😛
হিহি। আমার রান্নাও আমার শ্বশুরবাড়ির কেউ খাইতে পারবে না ঝালের জন্য। মা প্রচুর বকা দেয়, কাজ হয় না। তোমার রান্না খিতে মন চায় আপু। 😛
*খাইতে
ঢাকায় আয়, এসে খেয়ে যাস।
দাওয়াত থাকল। 🙂
তোর জন্য তাহলে রান্নায় মেপে ঝাল দিতে হবে না আর আমাকে।
কী মজা! 😛
শ্বশুর বাড়ি ঝালের হাঁড়ি ! 😛
পড়িয়া ‘শ্বশুরবাড়ি’
অক্ষরের আহ্লাদ বাড়াবাড়ি! 😛
:happy:
Lekhikar shontanera shukhi hok!
দোয়া করেন! 😛
তথ্যবহুল দারুন পোস্ট আপু। :happy:
😀
প্রথম প্যারাতেই বাজিমাত!! হাসতেই আছি =))
শেষদিকের চিকন বুদ্ধিগুলাও জোস 😀
আমার আবার কোন খাওয়াতেই অরুচি নাই ! :happy:
😛
মনে হইলো যেন লেখিকা নিজেকে ডিফেন্ড করলেন। যুক্তি টুক্তি বের করে টিপস দিয়ে দেয়া হইলো। এক কপি লেখিকার আম্মুকে প্রিন্ট করে হাতে ধরিয়ে দেয়া হোক 😛
ভিন্ন স্বাদের লেখা। নতুন খাবার খেতে অরুচি নেই আমার 😀
😀
সহমত।
বলেন কী! আমি একদম নিষ্পাপ, কোন মোটিভ নিয়ে লিখি নাই এটা। :angel_not:
আপাতত খাদ্যময় পোস্টে ঢুকে পেটের খিদে বাড়িয়ে গেলাম। ভয় হচ্ছে, আবার রেসিপী শুরু করবেন না কিন্তু, পরে মনের দুঃখে বনে চলে যেতে হবে।(আজীবন কেবল রেসিপীই দেখে গেলাম। রসনায় পেলাম না।)
তবে, খাদ্যাভ্যাসজনিত ব্যাপার বাচ্চাদের জন্য একটা বড় সমস্যা। যে সময়ে তাদের সুষম পুষ্টি প্রয়োজন, সে সময় এসব কারণে, অনেক ক্ষেত্রে, শিশু প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় না। এক্ষেত্রে মূলত মা বাবার ক্রিয়েটিভিটি অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে। (ম্যান ভার্সাস ওয়াল্ডের কথা মনে পড়ে গেল, কি অসাধারন ক্রিয়েটিভিটি) 8)
আসলে পোস্টের আলোচনা তো এটা না। পোস্টের আলোচনা হলো অসুস্থ হলে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনটা। (আমার আবার অত বাছবিচার নেই, ঠেকায় পড়লে আলকাতরাও খাই) এটা নিয়ে তেমন কোন ভাল বাংলা আলোচনা নেই, যদ্দুর জানি। সামিরা শুরু করেছেন বলে ধন্যবাদ।
রেসিপি শুরু করবো না কখনোই – এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমার অপূর্ব রন্ধনশৈলী নিয়ে এখনো ব্লগে কিছু লিখি নি দেখেই এরকম কথা বলতে পারলেন। 😛 আমি চুলা ধরানোই শিখলাম বছরখানেক হল, চা-ও বানাতে পারি না এখনো!
একটা রেসিপি পোস্ট দিয়েছিলাম অবশ্য, মনে পড়লো মাত্র। ‘চা বানানোর নিয়ম-কানুন’ নামে। 😀
যতদূর জানি রাঁধতে জানেন না। পোস্ট কিন্তু দারুণ সুস্বাদু হইছে!
food neophobia এর বাংলা কী হইতে পারে?
সাইকোলজি টুডে’র অনেক লেখাই বেশ লাগে। আরও চাই 😀
বলেন কী! আমার রন্ধনশৈলী এতই বিখ্যাত যে দূর-দূরান্তের নামিদামি ব্লগারেরাও জেনে ফেলেছে! এখন কী হবে! 😛 😛
“As the word ‘neo’, means ‘new’, and the word ‘phobia’ means fear, it quite literally means a fear of trying new things.” এটা উইকিতে লেখা। ‘নব্য খাদ্য ভীতি’ খুবই কেমন কেমন জানি শোনাচ্ছে।
oi tui ki samira from DU? Sounds like her…harsh
না ভাই। আমি অন্য সামিরা।
ঝাল দিয়ে লেখা শুরু করার পরই তো ভেবেছিলাম, লেখায় সরব ফিনিক্স চলে আসবে। 😛
লেখা ভালো হয়েছে বরাবরের মতোই। পোলাপান মানুষ করার সময় ভালোমতো চেষ্টা করবো এগুলো 😛
😀 লেখাটা অনেক আগের তো, তখন ফিনিক্স পাখির ঝালপ্রীতির কথা জানতাম না। জানলে সেটাও লিখতাম।
জ্বী অবশ্যই করবেন। 😛