এসএসসি ও এইচএসসিতে প্রাপ্ত জিপিএ এর উপর ভিত্তি করে মেডিকেলে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রচুর পয়েন্ট সরব নিশম এর আগে একটি পোস্টে লিখেছে, আমি সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করছি না। আরও কিছু পয়েন্টসহ গঠনমূলক সমালোচনা করার চেষ্টা রাখছি মাত্র।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মেডিকেলে ভর্তির বর্তমান পদ্ধতির খুব বড় ফ্যান নই, এবং এই পদ্ধতির পরিবর্তন হোক তা আমিও চাই। কিন্তু উন্নত করার বদলে আরও পিছিয়ে দেয়া, এবং আক্ষরিক অর্থে নিষ্ঠুর একটি পদক্ষেপ নেয়া সমর্থন করতে পারি না!
কিছু প্রশ্ন দিয়ে শুরু করিঃ
১.
অনেক শিক্ষার্থী দ্বিতীয় প্রচেষ্টার প্রস্তুতি নিয়েছে। সরকারি সিদ্ধান্তের পূর্নাঙ্গ বিবরণ না জানা পর্যন্ত বুঝা যাচ্ছে না তাদের ব্যাপারে কী করা হচ্ছে।
(ক) যদি তাদেরকে নতুন নিয়মে ভর্তির সুযোগ দেয়া না হয়, তাহলে তা খুব নিষ্ঠুর একটা ব্যাপার হবে, কেননা আগের বছর মোট সিটের একটি বড় অংশ তখনকার সেকেন্ড টাইমাররা নিয়ে গিয়েছিল; সুতরাং এই শিক্ষার্থীরা ন্যায্য সুযোগটুকু পায়নি নিজেকে প্রমাণ করার।
(খ) যদি এই নিয়মে ভর্তির সুযোগ দেয়া হয়, তাহলেও ঝামেলা আছে। ২০১১ ব্যাচে HSC তে কোন সৃজনশীল ফরম্যাট ছিল না, ২০১২ সালে বাংলায় সৃজনশীল ছিল। তাছাড়া আমাদের ৮ বোর্ডে ৮ রকম প্রশ্ন হয়। অর্থাৎ, দুই বছরে ১৬ ধরণের প্রশ্ন। ১৬ স্ট্যান্ডার্ডের প্রশ্ন, যার অর্ধেকে আংশিকভাবে সৃজনশীল পদ্ধতি আছে এবং বাকি অর্ধেকে নেই, তা দিয়ে কীভাবে শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই করা সম্ভব?
ও লেভেল, এ লেভেলে সারা বিশ্বে একই প্রশ্নে পরীক্ষা হয়। আমাদের তো তা নয়। কোন বোর্ডে পুরো ১০০ স্কোর করা সহজ, কোন বোর্ডে ৯০ স্কোর করা দারুণ কৃতিত্বের পরিচায়ক! কমন স্ট্যান্ডার্ড থাকছে?
২.
ধরা যাক, ডাবল গোল্ডেন প্রাপ্তদের সংখ্যা সীটের তুলনায় বেশি হয়ে গেল। তখন বোর্ড পরীক্ষার স্কোর দেখা হবে বলে শুনলাম [এই পোস্ট লেখার সময় পর্যন্ত বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি] প্রশ্ন হল, কোন বিষয়ের স্কোর?
(ক) শুধু জীববিজ্ঞানের স্কোর দেখলে তো হবে না, অন্য বিষয়েরও গুরুত্ব আছে! রসায়ন, পদার্থ, ইংরেজিসহ অন্যান্য বিষয়ের দক্ষতাও প্রয়োজনীয়।
(খ) যদি সব বিষয়ের স্কোর দেখা হয়, তবুও ঝামেলা আছে। ধরা যাক, আমার প্রাপ্য নম্বর ছিল ৯৮, খাতা দেখার ত্রুটির কারণে তা ৮১ দেখানো হচ্ছে। যেহেতু দুটোই এ+, আমি এতদিন এর কথা জানতে পারিনি, চ্যালেঞ্জ করতে পারিনি। এখন যেহেতু এর উপর আমার ক্যারিয়ার নির্ভর করছে, প্রাপ্ত নম্বর আমার আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে আপিল করার সুযোগ থাকছে কী?
৩.
বোর্ড থেকে কোন মার্কশীট সরবরাহ করা হয় নি।
(ক) যদি সরবরাহ করা হয়, তাহলে প্রশ্ন, গ্রেডিং সিস্টেমের কি আদৌ কোন দরকার ছিল? কেননা তখন বলা হয়েছিল শিক্ষার্থীরা নম্বরের পেছনে দৌড়ায় বলে, একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয় বলে গ্রেডিং সিস্টেম উত্তম; এখন যদি আবার সেই নম্বরই দেখা হবে তো গ্রেডিং সিস্টেমের পুরো উদ্যোগটা কি মাঠে মারা গেল না? এবার যে ছেলেটা ক্লাস নাইনে পড়ে, সে নিশ্চয়ই চেষ্টা করবে যত বেশি সম্ভব নম্বরের পেছনেই দৌড়াতে যাতে মেডিকেলে পড়া যায়?
(খ) যদি সরবরাহ না করা হয়, তাহলে প্রশ্ন, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে কীভাবে? একটি অপ্রকাশিত নম্বরতালিকার ভিত্তিতে কাউকে পেশা গড়বার সুযোগ করে দেয়া কি আইনত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে না? একই ফলাফল নিয়ে একজন ঢাকা মেডিকেল পেল আরেকজন চান্সই পেল না– অথচ তাদের স্কোরের পার্থক্যও জানানো হল না— এটা মেনে নেয়া যায় না।
৪.
পদোন্নতি পোস্টিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্বাচিপ শ্রেণীর দৌরাত্ম্যের কথা সর্বজনবিদিত। ভর্তি প্রক্রিয়া সন্দেহমুক্ত রাখার পন্থা কী?
আমি মোটেই বলছি না মেডিকেল ভর্তির বর্তমান পদ্ধতি খুব ভালো, কিন্তু নতুন পদ্ধতির এই সিদ্ধান্ত খুব হঠকারী। আমার ধারণা, এই মুহূর্তে বাস্তবায়নের উপযোগী সিদ্ধান্ত এটি নয়।
– সাজেশন আর গাইডের দৌরাত্ম্য বন্ধে সৃজনশীল পদ্ধতির সার্থক ইমপ্লিমেন্টেশন নিশ্চিত করা হোক, কেননা সেটি এখনও সম্পূর্ণ নিখুঁত নয়। তা করা গেলে আর কেউ অভিযোগ করতে পারবে না, যে একজন শিক্ষার্থী পুরো বই না পড়ে এ+ পেয়েছে। এই মুহূর্তে নতুন পদ্ধতিতে ভর্তি হলে এই অভিযোগ উঠতেই পারে, কেননা দুই ব্যাচের কেউই সম্পূর্ণ সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা দিয়ে আসেনি। আক্ষরিক অর্থেই পাঞ্জেরী গাইড সর্বস্ব গোল্ডেনপ্রাপ্তরা এবছর ডাক্তার হতে চলেছে।
– খাতা দেখার মান নিশ্চিত করার জন্য স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করা হোক। বিভিন্ন দেশে খাতা মূল্যায়নের জন্য মার্ক স্কীম সরবরাহ করা হয়, সেখানে ঠিক কী কী দেখে নম্বর প্রদান করা হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা থাকে। এ ধরণের পদক্ষেপ নেয়া হলে সারা দেশে কমন স্ট্যান্ডার্ড থাকবে। তাছাড়া, প্রশ্নপত্রও সব বোর্ডে অভিন্ন হতে হবে, যাতে যাচাইয়ের মানদণ্ড সমান থাকে!
আমাদের মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার কোয়ালিটি বিশ্বমানে উন্নীত করা গেলে আমার ধারণা নতুন এই প্রস্তাবের বিরোধিতাকারীর সংখ্যা অনেক অনেক কমে যাবে। সেই মান অর্জন না করা পর্যন্ত সরকারের এই সিদ্ধান্ত কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না।।
প্রশ্নগুলো আমার মনেও ঘুরঘুর করছিল।
এগুলোর উত্তর একমাত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গই দিতে পারেন।
রাইয়্যান তোকে অনেক ধন্যবাদ।
সব প্রশ্নগুলো গুছিয়ে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য।
সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
ধন্যবাদ। অনেক সময়োপযোগী একটা লেখা। যারা এই নতুন নিয়মটার খারাপ দিকগুলো বুঝতে পারছে না তাদের জন্য সহায়ক হবে।
আমরা সকলে সরব হলে প্রশাসনের টনক নড়বেই!
সময়োপযোগী+খুবই গোছানো পোস্ট। :dhisya:
তবে আমাদের অন্য সব প্রতিবাদের মত এটাও মাঠে মারা না গেলেই হয়।
আমরা সামর্থ্যের পুরোটা দিয়ে চেষ্টা করে যাই!
প্রশাসন আসলে চায় কি? যেভাবে রেজাল্ট দেয় তাতে তো বাচ্চাগুলোর ঘাড় ভেঙে দেয়, এখন কি মেরুদণ্ডের হাড় একটা একটা করে ভাঙতে চায়! যতটুকু মেধা অবশিষ্ট আছে তা ধ্বংস করে কি উপকারিতা পাবেন তারা!!
গোছানো একটা লেখার জন্য ধন্যবাদ দাদা তোমারে।
প্রশাসন ভুল করে থাকলে সেটি তুলে ধরা গণমাধ্যমের কাজ, আমরা আমাদের অবস্থান থেকে সেটাই চেষ্টা করছি! ধন্যবাদ!
মাঝে মাঝে ভয় পাই, যদি জেলে ডুকায়ে দেয়!! :voypaisi:
“আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে!”
সেই জন্যই তো বারবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই সরব হওয়া!
exactly!
ফেসবুকে “ভালো মানুষ” আইডি থেকে এই স্ট্যাটাসটা আপডেট করা হয়েছে, দুর্দান্ত কিছু কথা তাই এখানে শেয়ার করলামঃ
“এইচএসসি একটা জেনারেল এগজাম, হায়ার সেকেন্ডারি লেভেলের শেষ ও চুড়ান্ত পরীক্ষা। মেডিক্যাল, এঞ্জিনিয়ারিং অ্যাডমিশন টেস্ট হচ্ছে ওই বিশেষ শাস্ত্র (ডিসিপ্লিন) গুলোতে প্রস্তুতিমূলক স্তর (প্রিপারেটরি লেভেল) চেক করে দেখা। এইখানে ফোকাস সংকীর্ণ ও কিন্তু ডেপ্থ বেশি। এইটা না বোঝার কী আছে?
একটা হলো সাধারণ শিক্ষার (K 12 বা আমেরিকানরা যা বলে হাইস্কুল লেভেল) গ্রাজুয়েশন বা সমাপণী পরীক্ষা আরেকটা উচ্চশিক্ষার একটা স্পেশালাইজড ফিল্ডে প্রবেশিকা (অ্যাডমিশন) পরীক্ষা। ফোকাস ও অ্যাপ্রোচ অবশ্যই ভিন্ন হবে। দুটোর দরকার আছে। আমরা যদি কোচিং বানিজ্য বা পরীক্ষার্রথীর হয়রানী কমাতে চাই তাহলে অন্য বিকল্প ভাবতে হবে। এইএসসিতেই প্রি-মেড, প্রি-এঞ্জিনিয়ারিং মডিউল (২-৪ টা সাবজেক্ট) রাখা যায় কিনা ইত্যাদি। আর প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাচ্ছে ইদানীং, তো এইটা নিয়া পরীক্ষার্থীরা কী করবে? এইটা তো কর্তৃপক্ষের ফেইলিওর।
আর এইরকম একটা ডিসিশন নিবে ভালো কথা। এইটা বছরের শুরুতে সবগুলোতে রিলেটেড স্টেকহোল্ডারের সাথে খোলাখুলি আলোচনা ও মতবিনিময়ের পরে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কীভাবে অ্যাডমিশন নেয়া হয় সেসব তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে তার পরে নিলে কী হতো?
এইভাবে কেবিনেট লেভেলের একপিস মিটিং এর পরে বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো ঠাঠা ফেলে দেয়াটা মনোযোগ (মূলত নেতিবাচক) আকর্ষণ করে বটে কিন্তু আখেরে সিস্টেমকে মারাত্বক ক্ষতি করে। ব্রেইন স্টর্মিং পলিসিমেকিং এর একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ বটে, কিন্তু শুধু মগজে ঝড় তুলে তোগলকী কায়দায় পলিসি চেঞ্জ করলে লোকে পাগল বলবে।
আর বাজারে যে কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে, যে যেহেতু আসনসংখ্যার তুলনায় প্রার্থী সংখ্যা অনেক এবং তাদের মধ্যে গ্রেডের মধ্যে ফারাক খুবই কম বলা যায় নেই, সুতরাং এই সিদ্ধান্ত অসৎ বানিজ্যের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে সেটাও দেখতে হবে। এইভাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ক্রেডিবিলিটি ( খুবই কম ছিল টু বিগিন উইথ) নষ্ট করার কী মানে? নাকি ওনারা এতোটাই শেইমলেস হয়ে গেছেন যে এখন কিছুই গায়ে লাগে না?”
কোন সন্দেহ নেই যে সিদ্ধান্তটা হঠকারী। যদি শেষ পর্যন্ত এভাবেই মেডিকেল ভর্তি হয় তাহলে এটা আমাদের সকলের জন্য একটা অশনি সংকেত। আর আমার একটা কথা, সবাই কোচিং বন্ধ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। কিন্তু কেউ কি ভেবে দেখেছে কেন ছাত্ররা কোচিং -এ যায়? কলেজ এর ক্লাস,পড়ানো-শিক্ষা পর্যাপ্ত কিনা? শ্রদ্ধেয় ডঃ কায়কোবাদ স্যার একটা লেখায় লিখেছিলেন, “অনেক ছাত্রই আমাকে বলেছে তারা দুই বছরে কলেজ থেকে যা শিখেছে,৩-৪ মাসের কোচিং থেকে তাঁর চেয়ে বেশি শিখেছে।”
মূল সমস্যা যেখানে তার দিকে নজর না দিয়ে কোচিং বন্ধ করলে কোন ভালো ফল পাওয়া যাবে না। কলেজ গুলোর পড়ানো ও আমাদের সিস্টেম ভালো হলে কোচিং প্রবণতা এমনিতেই কমে যাবে। তা না করে এরূপ হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া বোকামিরই নামান্তর।
দারুণ বলেছিস! ধন্যবাদ!
প্রশ্নগুলো খুবই যৌক্তিক। আগেই কিছু প্রশ্ন আমার মনেও ছিল। কিন্তু এখানে বেশ গোছানো আছে। 🙂
সকলে সরব হই!
খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। ভালো হয়েছে।
সকলে সরব হওয়ার মতন একটা বিষয় এইটা। এত বড় একটা হঠকারিতা মেনে নেয়া উচিত নয় আমাদের।
ঠিক!