গোধূলির ওপারে

আমি নির্বাসনে যাবনা, মাথা ভরা জটা চুলে মণী- ঋষি হবনা।

 

ধোঁয়া ওঠা খোকন ভাইয়ের দোকানের চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অনিকেত গান শুনছে। এই খোকন ভাই লোকটা কিভাবে বুঝল অনিকেতের মনে এই গানটা বাজছিল??? এটাকে মনে হয় টেলিপ্যাথি বলে। যাক গে সে কথা, অনিকেত তার চায়ে মনোনিবেশ করে। “খোকন ভাই ১টা বেনসন লাইট দিয়েন তো।” কাঁপা গলায় বলে সে। ঈষৎ অবাক হয়ে তারপর আবার স্বাভাবিক হয়ে ঊঠে চায়ের দোকানী খোকন অনিকেতের দিকে বাড়িয়ে দেয় একটা বেনসন লাইট। ৮ বছর বয়স থেকে চা-বিড়ির দোকান চালায় খোকন, কত ছেলে-পেলেই না তার দোকানে বসে প্রথম বারের মত জ্বলন্ত সিগারেট ছুইয়েছে ঠোটে। এটা নতুন কিছুনা।

 

অনিকেতের হাত কাঁপছে মুখে অনেক কনফিডেন্ট একটা লুক নিয়ে সে সিগারেটটা ধরালো, টানছে আস্তে আস্তে… সাবধানে, যাতে কেউ এটা না বোঝে যে সে নতুন স্মোকার! প্রেমে ব্যর্থ হলে সিগারেট খেতে হয়, এই ধারনা থেকেই সিগারেট খাওয়া শুরু করেছে অনিকেত। মা জানলে অনেক কষ্ট পেত, অথবা বেশ কয়দিন ধরে লেগে থাকা ঠান্ডাটা আরো বাড়বে সিগারেট খেলে… এই ধরনের কোন ভাবনাই এখন অনিকেতকে বিচলিত করছেনা, কেমন যেন সবকিছুই ভোঁতা, ভয়ানক অর্থহীন, এই চায়ের স্টল, হাতের চায়ের কাপ, ঠোটে জ্বলন্ত সিগারেট সবই। ২বছর আগে যখন দুরু দুরু বুকে মেঘের কাছে নিজের হৃদয়কে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল তখন কেমন যেন আলাদা ছিল সব কিছু। রঙিন স্বপ্ন রঙিন মন… মেঘের সাথে রাতে চ্যাট আর ফোনালাপ আর দিনে উদ্দেশ্যবিহীন ঘোরাঘুরি। একদিন অতর্কিতে মেঘকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল “এটাই জীবন মেঘ। তুমি আমাকে অনুভূতিগুলো অনুভব করতে শিখিয়েছ। জীবন দিয়েছ, আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবনা।” “পাগল!!!!” বলে মুচকি হেসে অনিকেতের এলোমেলো চুলগুলো আরো এলোমেলো করে দিয়েছিলো মেঘ। অনুভুতিগুলো এখনো অনুভব করে অনিকেত, কিন্তু কেন যেন সেগুলো ওকে সবসময় আগলে রাখে না, মাঝে মাঝে আসে, হঠাত করে আসে, ধাক্কা দিয়ে, ওকে ওলটপালট করে দেয়, সবকিছু এলোমেলো করে দেয়।

“এই অনিক তুই বিড়ি খাওয়া ধরলি কবে??” হঠাত করে কর্কষ গলায় বলে উঠল তুষার। অনিকেতের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটল… কেন যেন আরো আর্থহীন মনে হতে লাগল সব।”ধুর” বলে দোকান থেকে বেরিয়ে আসল অনিকেত, হাতের আধখাওয়া সিগারেটটা মাটিতে ফেলে দিল। ‘শালা বোকাচোদা’ ভাবে অনিকেত।

-চল রেললাইনে ঘুরতে যাই।

-নাহ আমারা ভাল্লাগছেনা। তোরা যা।

-আরে চলনা আজকে সৌমিক গিটার নিয়ে আসছে, সবাই মিলে গান গাইব। চল।

অনিকেত কিছু বলার আগেই ওর হ্যাংলা-পাতলা শরীরটাকে প্রায় টেনে হিঁচড়ে ধরে নিয়ে গেল তুষার।

 

“চল আজ ফিরে যাই গধূলির ওপারে”

 

সন্ধ্যা নেমে আসছে। বিকট সুরে সবাই গান গাইছে রেল লাইনের ধারে বসে।এই লাইনটার উপর দিয়ে ট্রেইন যায়না, তাই এখানে বসে আড্ডা দিচ্ছে সবাই। এইত ২ মাসে আগেই মেঘের সাথে এখানেই ওর শেষ দেখা হয়েছিল।মনে পড়ল একবার ওদের ভার্সিটিতে ছাত্রদের দুই গ্রুপের মধ্যে যখন মারামারি হয়েছিল সেদিনের কথা। অনিকেত সেদিন ক্যাম্পাসেই যায়নি অথচ মেঘের যেন চিন্তার শেষ নেই। কতবার যে ফোন করেছিল শুধু এটা জানার জন্য যে অনিকেত ঠিক আছে কিনা… আজ সেই মেঘ ২টা মাস হতে চলল অনিকেতের কোন খবর নেয়ান, ফোন দিয়ে ঘুমকাতুরে অনিকেতের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়না…  কথাটা মনে করতেই মাথাটা ঘুরে ঊঠল অনিকেতের।”অর্থহীন। বেঁচে থাকাই অর্থহীন। আমি বেঁচে আছি কি নেই তা দিয়ে কারোর কিছুই যায়-আসেনা”

 

 

“আলো আলো আমি কখন খুজে পাবনা…”

 

বন্ধুদের গান এখনো চলছে। পাশের ট্রেইনের লাইন দিয়ে একটা ট্রেইন আসছে মনে হয়, হূইসেলের শব্দ শোনা যায়। সংগোপনে বন্ধুদের চোখ এড়িয়ে সেই লাইনটার পাশে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অনিকেত ট্রেনটার দিকে।আর খুব বেশি হলে ৫-৬ সেকেন্ড।অনিকেত লাইনের উপর ঊঠে পড়ে। সামনে একটা পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেইন। ড্রাইভার অনিকেতকে দেখে হূইসেল দেওয়া শুরু করেছে। সারা জীবন ঈশ্বরের অস্ত্বিত্ব নিয়ে সন্দিহান অনিকেত শেষবারের মত  ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে চায়।মানুষ কেন যেন সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করার সময় উপরের দিকে চায়। অনিকেত উপরে তাকাল।চমকে গেল।গোধুলি আকাশ!! আলো আধারের খেলা! কোথাও লাল কোথাও ঈষৎ নীল কোথাও আবার অন্ধকার হয়ে গেছে!!অসাধারণ। হঠাত করে অনিকেতের মনে হল তার আসলে ফটোগ্রাফী শেখার ইচ্ছা হচ্ছে।

কিন্তু সে তো রেল লাইনের উপরে।ট্রেইনটা আসতে হয়ত আর ২ সেকেন্ড মত বাকি আছে।” নাহ আসলে মনে হয় পৃথিবীটা সুন্দর!!” ভাবে অনিকেত।একটা অনাবিল হাসি ফুটে উঠে তার মুখে।’আমি মরব না।’-সরে যাওয়ার জন্য লাফ দেয় সে।

 

 

চলো আজ ফিরে যাই গোধূলির ওপারে।

তুষার গীটার বাজাচ্ছে আর গান গাইছে। দুটো জিনিস একসাথে করতে করতেই লক্ষ করছে অনিকেত আস্তে আস্তে অন্য ট্রেন লাইনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গত দুই মাস ধরে ছেলেটার মুখে হাসি দেখিনা- ভাবে তুষার।আবার গান গাওয়াতে মনযোগ দেয়। সবাই চোখ বন্ধ করে গভীর মনযোগের সাথে বেসুরো গলায় গান গাইছে। ট্রেনের হুইসেলটা বড্ড বেরসিক ভাবে তুষার।’এই অনিক!!!’ চেচিয়ে ঊঠে সে। ট্রেনটা অনিকেতের ঠিক দুই হাত সামনে, হঠাত অনিকেত ট্রেনের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। মুহুর্তের মাঝে ভেঙ্গে যায় গানের আসর। ওরা বুঝে উঠতে পারেনা কি হয়েছে অনিকের ভাগ্যে।তুষার নখ কামড়ে ধরে ট্রেনটা পুরাটা চলে যাওয়ার অপেক্ষা করছে… সৌমিক অনিকেতের নাম ধরে অনবরত চেচিয়ে চলেছে।সৌমিকের চিৎকার আর ট্রেনের শব্দে কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা কি হয়েছে অনিকেতের ভাগ্যে।

 

 

ট্রেনটা চলে গেছে। অনিকেতের সারা দেহ রক্তাক্ত। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে এখনো। দৌড়ে যায় তুষার ওর দেহটার কাছে। আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা, বসে পড়ে মাটিতে।কিন্তু অনিকেত এখনো নড়ছে!! ওর পায়ের উপর দিয়ে ট্রেন  চলে গেছে, ডান পায়ের হাঁটুর নিচের অংশটা নেই, অবিরাম ফোয়ারার মত রক্ত ঝরছে। কিন্তু অনিকের মুখে একটা হাসি। অদ্ভুত একটা হাসি। সে আশে-পাশে দেখছে আর হাসছে। পৃথিবীটাকে কখনো এত সুন্দর মনে হয়নি ওর কাছে এর আগে। এই গোধূলি, এই বন্ধু, এই ট্রেন রেখে আমি বোকার মত চলে যেতে চেয়েছিলাম, ভাবে সে। ধীরে ধীরে আর কেন যেন ভাবতে পারছেনা… সব কিছু অন্ধকার হয়ে আসছে…

 

 

আশে-পাশে জড় হওয়া মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে ট্রেনে পা কাটা পড়া একটা মানুষ “সুন্দর সুন্দর!!” করে চিৎকার করে অপ্রকৃতস্থের মত মত হাসতে হাসতে অজ্ঞান হয়ে গেল।

 

N.B: লেখাটি একই সাথে লেখকের kuetlive.com প্রোফাইলে প্রকাশিত।

 

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প, হাবিজাবি-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

15 Responses to গোধূলির ওপারে

  1. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    এরকম পরিণতি বাস্তবে চাই না! 🙁

    :welcome: ভাইয়া! 🙂

  2. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    এত ভয়ংকর কি না হলেই নয় ভাই? একটা মানুষ বা কয়েকটা মানুষ অবহেলা করল আর কষ্ট দিল মানেই জীবন শেষ এভাবে কেন যে ভাবে কিছু মানুষ ! 🙁 এই মানুষগুলোর জন্য করুণা যারা এভাবে জীবনযুদ্ধে এভাবে হেরে যায়…

    গল্প লেখা ভালো হয়েছে। তবে ইতিবাচক চিন্তাধারার গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম। 🙂

  3. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    :welcome:

    বানান, ফরম্যাটিং ঠিক করতে হবে ভাইয়া। প্রেজেন্টেশন কিন্তু খুব জরুরি। সরব ফিনিক্স এর লেখাগুলা দেখতে পারো কীভাবে প্রেজেন্ট করে!

    গল্প লেখা চলুক। অনেক অনেক লিখলে নিশ্চয় ভালো হবে।

  4. সামিরা বলেছেনঃ

    :welcome:
    হৃদয় ভাঙার মত কষ্টের ব্যাপারটা আবার এত কমনও! প্রতিরোধের উপায় ভাবা উচিত। 🙁
    আর সরবে কিন্তু গালি/স্ল্যাং একদম আশা করি না। 🙂 এরপর থেকে খেয়াল রাখবেন আশা করি, এই পোস্টটাকেও এডিট করে দিলে ভাল লাগবে। এত সুন্দর লেখায় গালি থাকলে কীভাবে হবে?

  5. নোঙ্গর ছেঁড়া বলেছেনঃ

    প্রথম লেখাটাই দেখি দুর্দান্ত!! এরকম নিয়মিত চাই।

    :welcome:

  6. অবন্তিকা বলেছেনঃ

    :welcome!

  7. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    আপনার লেখার হাত ভালো। আশা করছি নিয়মিত লিখে যাবেন।

    সরব এ স্বাগত জানাচ্ছি! 🙂

    তবে, লেখায় গালাগালি ব্যবহার না করার বিষয়টা মাথায় রাখবেন আশা করছি 😀

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।