আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় একই দৃশ্য দেখি। পুরানো ঢাকার গলি, তস্যগলি পার হয়ে আরও ভেতরে কোথাও ল্যাম্পপোস্টের আলোতে অবাক হয়ে দেখি আমি। একজন আধুনিকা, স্বাস্থ্যবতী চমৎকার পোশাক পরা তরুণী দৃঢ় পায়ে হেঁটে যান গলির মুখে। তার পিছনে পিছনে হেঁটে আসে নয় কি দশ বছরের অপুষ্ট এক শিশু। আধুনিকার দু-তিন বছরের স্বাস্থ্যবান বাচ্চাটা কোলে নিয়ে হেঁটে যায় পিছনের বাচ্চা মেয়েটা। ওজনে বাঁকা হয়ে যাওয়া মেয়েটার দিকে মাঝে মাঝেই বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে আধুনিকা ঝাঁঝিয়ে ওঠেন শ্লথগতির জন্য।
আমি ঘৃণায় চোখ বন্ধ করি।
তুমি অফিসে যাওয়ার জন্য টেম্পুতে ওঠার জন্য তাড়াহুড়ো কর রোজ। সামনের সিটে একজনের সিটে দু’জন; ভেতরে দশজনের জায়গার বারো-তবুও পেট ভরে না টেম্পু মালিকের। টেম্পুর বাইরে পা-দানি তে কোনরকমে দাঁড়িয়ে থাকে আরও দু’টা মানুষ। তবুও এক কোণা দখল করে কোনরকমে ঝুলতে থাকা হেলপারটাকে দেখ তুমি। বয়স আট কি দশ হবে। তোমার ওই বয়সী ছেলেটাকে আদর দিয়ে এসেছো ঘুমন্ত চোখে। দুর্ঘটনার সাথে বাজি লেগে একটা হাতে শক্ত করে রড ধরে রাখা বাচ্চাটা তোমার পিঠে শিরশিরে স্রোত বইয়ে দেয়।
তুমি অসহায় হয়ে চোখ বন্ধ কর।
রিটায়ার করে সে খুব বিরক্ত সময় পার করছে সে। আগের সেই ব্যস্ততা উধাও হয়ে গেছে ধুম করে। তাড়াহুড়োয় অভ্যস্ত জীবনটা হঠাৎই যেন এসে দাঁড়িয়েছে এক গহীন খাদের সামনে। সামনে কিছুই নেই, শুধুই স্থবিরতা আর নৈঃশব্দ্য। পত্রিকা খুলে সকালের বিশাল সময় কাটিয়ে দেয়াটা যেন খুব জরুরী কোন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেদিন পত্রিকা খুলে লিমনের খবর পড়ে হতবাক হয় সে। এই ছেলেটাকে আর কত বিভীষিকা পার করতে হবে এক জীবনে? আর কত অকূল পাথার পার হলে তবে ছেলেটাকে মুক্তি দেবে ওরা?
অক্ষমতার লজ্জায় চোখ বন্ধ করে সে।
তিনি একজন নামী ব্যক্তিত্ব। অনেক বছর আগে ছেড়ে আসা বিশ্ববিদ্যালয়টাকে ঘিরে এখন আবেগ ছুঁয়ে যায় তাকে। তাই সেই বিশ্ববিদ্যালয়টাকে যখন আস্তাকুড়ে টেনে নিয়ে যাবার আয়োজন করা হয়েছে, তখন খুব অসহায় বোধ করেন তিনি। অনেক মানুষ রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে শুনেছেন তিনি, তবুও যাদের উপর নির্ভর করে আছে সেই ফেলে আসা স্বপ্ন উদ্যান এর ভবিষ্যৎ, তাদের নির্লিপ্ততা হতবাক করে তাকে।
তিনি রাগে কাঁপতে কাঁপতে চোখ বন্ধ করেন।
উনি একজন সাধারণ মানুষ। অফিস যান, অফিস থেকে বাড়ি ফেরেন, ছেলেমেয়েদের ভাবনায় প্রেশার বেড়ে যায় মাঝে মাঝে, রাতে টিভিতে নাটক দেখে খুব হাসেন-যেন আমাদের দেশের সাধারণ জনতার প্রতিচ্ছবি। তার আদরের ছেলেটা যখন মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার দাবিতে শহীদ মিনারে প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের খুব মার খেয়ে ফেরত আসে, অফিস থেকে কাঁদতে কাঁদতে ফেরত আসেন তিনি।
চোখের নোনা জলের অঝোর ধারার মাঝেও চোখটা বন্ধ হয় উনার।
আমি, তুমি, সে, তিনি, উনি-সবার, এক অদ্ভুত না পারার বেদনায়, রাগে, দুঃখে, হতাশায়, হৃদয়ের হাহাকার জাগানো অনুভূতিগুলোর মাঝে থমকে গিয়ে চোখটা বন্ধ হয়ে আসে।
হয়তো, এ ভয়াবহ অনুভূতি মুখোমুখি হবার চেয়ে সবসময়ের জন্য চোখ বন্ধ করে ফেলার আশাতে, মরে যেতে চাওয়ার মতো হতাশাতে……
ভালো লাগে না, এতো সব খারাপ খবরের মাঝখানে, হারিয়ে যাচ্ছে অনেক ভালো খবর, ভালো লাগে না, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে খেলা করা, ভালো লাগে না, আমাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা, ভালো লাগে না অনেক কিছুই……
ভালো লাগে না, এতো হতাশার আঁধারে হারিয়ে যায় আশার আলোরা……
“এক অদ্ভুত না পারার বেদনায়, রাগে, দুঃখে, হতাশায়, হৃদয়ের হাহাকার জাগানো অনুভূতিগুলোর মাঝে থমকে গিয়ে চোখটা বন্ধ হয়ে আসে।” – এখন তো আর কোন অনুভূতিও হয় না, কমফোর্টেব্লি নাম্ব!
🙁
🙁
পাল্টে যাক সব মন খারাপের গল্প……
অনুভূতিগুলো আজকাল ভোতা হয়ে গেছে …
🙁
কষ্ট লাগে ।
কষ্ট লাগে, খুব কষ্ট লাগে……
আপনি খুব অল্প কথায় অনেক কিছু বলে দেন…… এমন কেন আপনার লেখা গুলা যে পড়তে পড়তে ভিতরটা দুমড়ে- মুচড়ে উঠে……
জেগে জেগে ঘুমানো মানুষ গুলো ঘুম থেকে জেগে উঠুক……
ধন্যবাদ!
“জেগে জেগে ঘুমানো মানুষ গুলো ঘুম থেকে জেগে উঠুক……”