রাজকুমার বিলু,কালু আর গিলু’র রোমাঞ্চকর অভিযান ৩

প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব

গুরুৎ ভাবলো, আজ তো পূর্ণিমার রাত, কিন্তু শালার চাঁদটা গেল কই! চারদিকে কেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার। বনের পথটা অবশ্য তাও ঠাহর করা যাচ্ছে, আকাশ জুড়ে হাজার নক্ষত্র।

দশ বছর! সময়টা কম নয়। লীলাবতি’র কী খবর কে জানে, ওর রাজ্যের মানুষও হয়তো ওর কথা ভুলে গেছে। ভাবতে ভাবতে গুরুৎ আনমনা হয়ে যায়, সাথের দুই ত্যাদর ছেলে আর ওদের দাঁতছাড়া হাতিটার কথাও মনে রইলো না।
অনেক কাজ পড়ে আছে!

বনে তখন উথাল পাথাল বাতাস বইছে, সেই বাতাসে ভেসে এল দারুন পরিচিত এক সুবাস।
থামা গাড়ি! গুরুৎ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো।
বন্দীর কর্কশ চিৎকারে কালু লাগাম টেনে ধরলো তৎক্ষনাৎ।
নেমে আসলো ওরা ঘোড়ার গাড়ি ছেড়ে। গিলুও বসে ছিল গাড়িতে গুটিসুটি মেরে, নেমে আসলো শুড়ে ভর দিয়ে।

একটা সুবাস পাচ্ছিস?
ওরা সবাই নাক উঁচু করে বোঝার চেষ্টা করলো।
কই নাতো! বিলু বলল। কালুরও কিছু মনে হল না।
গুরুৎ হতাশ হল, কী নাক তোদের বুঝি না। তারপর গিলুর দিকে ফিরে বলল, তুইও পাচ্ছিস না, অতবড় নাকটা দিয়ে?
গিলু মুখভাড় করে এপাশওপাশ মাথা নাড়লো।
অতবড় নাকটা থেকে তাহলে কী লাভ হল? লাভ হল কিছু? গিলুর কাছে মুখ নিয়ে গুরুৎ চেঁচিয়ে বলল।
ওটা নাক নয়, ওর হাত, ওটা দিয়ে সবকিছু ধরে দেখতে পাও না! কালু এসে গিলুর পক্ষ নিল।
হয়েছে, সব অকর্মার ঢেকি! তোদের পেতে হবে না, যা বলছি শোন,সুবাসটা আসছে দখিন দিক হতে, এলাচ ফুলের গন্ধ!
এলাচ ফুল?
হ্যাঁ, চল ওদিকে যাব।
কেন যাব? বিলু বলে উঠে, আমাদের কারো এলাচ ফুল চাই না।
কালু বলল, আমারো চাই না।
গিলুও মাথা নাড়লো।
না চাইলেও যেতে হবে, কেননা আমি যাচ্ছি। আর আমাকে ছাড়া এই বন থেকে তোরা বেড়ুতেই পারবি না, গোলকধাঁধায় আটকে রইবি সারা জীবন, এ বনের পথঘাট এতটাই ঘোড়ালো যে, কেউ পথ হারালেই বুড়ো হয়ে মরে।
বুড়ো হয়ে মরে?
নয়তো কী, ভয়ংকর কোন জীবজন্তুও নেই যে এসে খেয়ে নেবে, শুধু গাছগাছালি আর পাখপাখালির বন!
শুনে ওরা শিউড়ে উঠল।
তোরা তাহলে থাক, বছর বিশ ত্রিশ পর আবার এ পথে আসতে পারি, দেখা হবে তখন। আর তোদের চুল যখন সাদা হয়ে যাবে তখন কাপুল গাছের রস মাথায় দিস, খুব ভালো রঙ হয়, দাঁত নড়ে উঠলে শিলকলী কান্ড চিবিয়ে খাস, গোড়া শক্ত হবে আর হাঁটতে কষ্ট হলে লম্বকী গাছের কান্ড ভেঙে ভর করে হাঁটিস, আরাম হবে।
বলে গুরুৎ হাঁটা দেয়।

বিলু, কালু  আর গিলুও পড়িমড়ি করে ওর পিছু নেয়।

***

সুবাসটা বাড়ছে ধীরে ধীরে।
বিলু,কালু আর গিলুও একসময় সে সুবাস পাওয়া শুরু করলো।

কী মিষ্টি গন্ধ!মাথা ঝিমঝিম করে উঠে।
জায়গাটা কেমন পাথুরে, আস্তে আস্তে যেন উপরের দিকে উঠছে। গাছপালাও অত ঘন নয়, হালকা হয়ে আসছে যতই এগুচ্ছে ওরা।
হঠাৎ চারপাশটা কেমন জ্বলজ্বল করে উঠলো, অন্ধকারটা ধবধবে জোৎন্সায় গুলে গেল, পাথরগুলো চকচক করে উঠলো। আকাশের দিকে ওরা তাকিয়ে দেখলো মস্ত একটা চাঁদ ঝুলে আছে।
চাঁদটা  এতক্ষণ কই ডুব মেরে ছিল ভেবে পেল না ওরা, আকাশে তো মেঘের নাম গন্ধ নেই। ব্যাপার ভারী আজ্জব! বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো গুরুৎ, আর বিলু কালু ভাবলো চন্দ্রগ্রহণ চলছিল বোধহয়, আর গিলু যে কী ভাবলো বোঝা গেল না ভাল করে।
এমন সময় ওদের চোখে পড়লো সামনে বিশাল এক গাছ, জোৎন্সায় যেন জেল্লা দিচ্ছে গাছটা, ধবধবে সাদা হাজারো ফুলে ছেয়ে আছে। এটাই তবে এলাচ বৃক্ষ।
এমন সুন্দর গাছ ওরা জীবনে দেখেনি, হা করে তাই চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। আর রাজপ্রাসাদের বন্দী গুরুৎ আবারো গান ধরলো-
♪পেয়েছি পেয়েছি!
এলাচ আমার, গাছটা আমার!
ওরাও গলা মেলাল- পেয়েছি পেয়েছি
এলাচ আমার! গাছটা আমার!

♪তোর গা চকচকে, জোৎন্সা পড়ে দিচ্ছে কেমন জেল্লারে
তোর গুড়ির তলে আসবো বলে ভেঙেছি কত কেল্লারে
তোর রূপার ডালে পা ঝোলাবো কত্ত দিনের খায়েশ মোর
তোর সোনার ফুলে নাক ডুবিয়ে করবো যত আয়েশ মোর♫

ওরা গলা মেলাল আবার-
পেয়েছি পেয়েছি!
এলাচ আমার! গাছটা আমার!

তোর এলাচ ফলের সুবাস এমন আহ  তুলনা নাইতো রে
এসেছি আজ এবার তবে মূল উপড়ে খাই তোরে♫

শেষের প্যারা শুনে বিলু কালু  আর গিলু ভড়কে গেল। ওরা গলা মেলানো বন্ধ করে দিল।
খাবে মানে? বিলু মুখ ভার করে বলল।
খাবই তো, দারুন সুবাস যে। গাছটা উপড়ে ফেলে মূলটা কেটে নিয়ে খেতে হবে, দারুন সুস্বাদু।
এত সুন্দর গাছটা তুমি খেয়ে ফেলবে? ওরা যেন মানতে পারে না।
হয়েছে বেশি বকিস না। না খেলেও এই গাছটা উপড়ে ফেলতে হবে। এটার জন্যই এতদূর এসেছি। তোদের হাতিটাকে ডাক, বল যে শুড় দিয়ে পেচিয়ে টান দিতে।
গিলুর অত শক্তি নেই, দুবছরী বাচ্চা। কালু বলে উঠে, এতবড় গাছ পারবে না টান দিতে।
হুম, তাইতো দেখছি! গুরুৎ চিন্তিত মুখে তাকালো গিলুর দিকে।
দাঁতও গজায়নি দেখছি!
হ্যাঁ, কালু বলল।
তারপর গুরুৎ কালুর দিকে ফিরে বলল, তা ফিডারটা কই ওর?
কার?
কেন এই অকম্মার ঢেঁকি দুধের বাচ্চা গিলুটার, ফিডারটা আনিস নি ক্যানো? বলে গিলুর দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে গুরুৎ।
তাই শুনে, গিলু রেগেমেগে গিয়ে এলাচ গাছের গুড়ি পেচিয়ে ধরে গিয়ে।
কালুও দৌড়ে যায় ছাড়াতে, আর বিলুর ভারী রাগ হয় বন্দী গুরুতের উপর।

কিন্তু কী আশ্চর্য, গিলু একটানেই এলাচ গাছটা উপড়ে ফেলে।
বিলু আর কালু দুজনাই চমকে যায়।
গুরুৎ বলে,যার জেল্লা যত বেশি তার স্থিতি তত কম, এলাচ গাছের এই বাহার দেখেই তোদের বোঝা উচিত ছির ওর গোড়াটা মোটেও শক্ত নয়।

গুরুৎ তারপর সেই উপড়ানো গুড়ির গোড়ার কাছে মাটিতে কী যেন খুঁজতে থাকে। মাটি হাতড়ে হাতড়ে অনেকক্ষণ পর খুঁজে পায় ও যা খুঁজছিলো।
উঠে আসে একটা কুড়াল হাতে, মাঝারী গড়ন, ফলাটা চাঁদের আলোয় চকচকিয়ে উঠলো।
অবশেষে পেলাম তোকে!
গুরুৎ পারলে কুড়ালটা বুকে জড়িয়ে ধরে, চোখে পানি টলমল করে উঠে।

এটার জন্যই গাছটা উপড়ালে? কামারের দোকানে গেলেই তো পারতে! বিলু অবাক হয়ে বলল।
সে তোরা বুঝবি না, এ কুড়ালের মাহাত্ম্য যারা বুঝতো তারা কেউ আজ বেঁচে নেই।
বেঁচে নেই?
কীভাবে থাকবে, এ কুড়াল দিয়েই তো সবগুলাকে মেরেছি। কত দৈত্য দানো, রাক্ষস খোক্কষ এ কুড়ালের ফলার নীচে মাথা দিয়েছে সেটা যদি জানতি তাহলেই না বুঝতি! ব্যাপারখানা নয়কো সোজা।

তারমানে তুমি বীর?কালু বিলু দুজনারই হঠাৎ চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে।
তাতো বটেই! আমি রাজকুমার গুরুৎ। নাম শুনিস নি?
নাহ! দুজনাই মাথা নাড়ে, গিলু কিছু বলে না, ওর অপমান এখনও কাটে নি। তাই মুখ ভার করে অন্যদিকে চেয়ে আছে।
কি পড়ায় তোদের আজকাল? পড়ার বইয়ে তো এতদিনে আমার নাম চলে আসার কথা ছিল! আফসোস করে গুরুৎ।
কোন রাজ্যের রাজকুমার তুমি? বিলু উৎসুক হয়ে ওঠে।
সে রাজ্য অনেক দূর,অচীনপুর!
অচীনপুরের নাম তো অনেক শুনেছি, সব গল্পেই তো থাকে! কালু বলে উঠে।
হ্যা, আসলে অচীনপুর রাজ্য মানে হল চীন ছাড়া যেকোন রাজ্য। আসল নাম না বলতে চাইলে অচীনপুর বলতে হয়।
কেন আসল নাম বললে কী হয়? আর চীনপুর নিয়ে কোন গল্প নেই কেন?
ওইটা প্রাইভেসি রক্ষা, নইলে দেখতি লোভী লোকজন কেমন হা হা করে সাত রাজার ধন আর বেঙমা-বেঙমীর সোনার পালকের লোভে দল বেঁধে রওনা দিত।
আর চীনপুরে আমাদের যাওয়া নিষেধ, তাই সেটা নিয়ে কোন গল্প শুনতে পাস না।
কেন কেন? বিলু কালু দুজনাই কলকলিয়ে উঠে।
কারন হল, একবার এক ব্যাঙ রাজপুত্র ভুলে চীনরাজ্যে চলে গিয়েছিল, ভেবেছিল চীনের রাজকুমারীর দেখা পেলেই সে ব্যাঙ থেকে রাজপুত্র হয়ে সুখে শান্তিতে বাস করতে পারবে। কিন্তু সেই চীনা রাজকুমারী মিচাওপিচাও করলো কী, যেই না ব্যাঙ রাজকুমারকে দেখলো, অমনি রাঁধুনী পাঠিয়ে ধরে নিয়ে ইচ্ছামত মসলা দিয়ে কেটেকুটে রান্না করিয়ে খেয়ে ফেলল। রাজকুমারীর প্রিয় খাবার ছিল সাপ-ব্যাঙ, সেটা কে জানতো!
তারপর থেকে অচীনপুরের কেউ কখনো চীনরাজ্যে যায় না, ওদের নিয়ে গল্প লেখাও নিষেধ।
শুনে বিলু আর কালু  দমে গেল, চীনরাজ্য কী ভয়ংকর!

চাঁদটা ততক্ষণে নেমে গেছে অনেক নীচে, খানিক পরে আঁধার কেটে যাবে।
গুরুৎ ওর কুড়ালটা পিঠে বেঁধে নেয়।
তোরা আর আমার পিছু পিছু আসিস না। মেজাজ চড়ে গেলে আমি খুব মারকুটে হয়ে যাই, কুড়াল দিয়ে কারো গলা না কাটলে তখন খুব অশান্তি হয়, বুক ব্যথা হয় আর চোয়া ঢেঁকুর উঠে। তাই সময় থাকতে চলে যা। আমার অনেক কাজ পরে আছে। কত কত দৈত্যদানোর সাথে যে বোঝাপড়া বাকী আছে, তার ইয়ত্তা নেই। বিশেষ করে কনকপুরের রাজামশাইকে পেলে হত এখন, আমার দশটা বছর কেড়ে নিল। ওর মাথাটা কেটে যেতে পারলে খুব আরাম হত, অনেক কাজ পড়ে আছে বলে ব্যাটা বেঁচে গেল, ফের যদি এ পথে আসা লাগে তখন একটা দফারফা হয়ে যাবে।
শুনে বিলু চেচিয়ে উঠলো, বাজে কথা বলবে না, কনকপুরের রাজা আমার বাবা হয়।
অ্যা, তাই নাকি! গুরুৎ যেন নিজ কানকে বিশ্বাস করতে পারেন না।
তাইতো বলি, এইটুকুন ছেলে এত ত্যাদড় কেন? তবে তোর গলাটাই কাটি, কনকপুরের রাজপুত্র, নরমগদিতে শুয়ে বসেই তো সারাজীবন কাটাবি, তারচেয়ে মরে যাওয়াই তো ভাল। আয় গলাটা কাটি, খানিকটা আরাম যদি হয়।
আমি মোটেও নরম গদিতে বসে থাকি না, রাজকুমার বিলু চেচিয়ে উঠে। তাছাড়া আমরা তোমাকে উদ্ধার করেছি, অকৃতজ্ঞ!
না না ,ওইটে কখনো বলবি না। আমি মোটেও অকৃতজ্ঞ নই। কোন দৈত্য দানোও অমন কথা কোনদিন বলেনি।
অকৃতজ্ঞই তো, কালুও বলে উঠে। যে উদ্ধার করলো তাকে মারতে চাইছো।
গিলুও শুড় তুলে কিছু একটা বলল, একই কথাই হবে বুঝে নিল গুরুৎ।

শুনে গুরুৎ কিছুটা থমকে গেল, তবে শোন, কে অকৃতজ্ঞ, শুনলেই বুঝবি। কীভাবে আমার কুড়ালটা এখানে আসলো সেটাও বুঝতে পারবি।
শুনে বিলু, কালু  আর গিলু তিনজনাই উৎসুক হয়ে গুরুৎকে ঘিরে বসে পড়লো, কেউ গল্প বললেই ওদের খুব আগ্রহ হয়।
তারপর গুরুৎ বলা শুরু করলো।

সে বহু বছর আগের কথা! গুরুৎ বলা শুরু করলো।
দশ বছর? কালু জিজ্ঞেস করলো।
হ্যাঁ, দশ বছরই তো, কিন্তু নির্দিষ্ট করে বললে ভাল শোনায় না, বহু বছরই ঠিক আছে। ফের মাঝে কথা বললে তিনটার গলাই কেটে নেব, গুরুৎ রেগেমেগে বলল।
তারপর খানিকটা ভেবে নিয়ে বলল, না দুইটার গলা আর একটার শুড়, আড়চোখে গিলুর দিকে চেয়ে বলল।
ওরা তাই আর কথা বলল না।
গুরুৎ আবার বলা শুরু করলো…

(চলবে)

মাশুদুল হক সম্পর্কে

হাত ভর্তি চান্দের আলো ধরতে গেলে নাই... https://www.facebook.com/masshood
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

10 Responses to রাজকুমার বিলু,কালু আর গিলু’র রোমাঞ্চকর অভিযান ৩

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    আমি তো ভেবেছিলাম ভুলি নাই! এখন দেখি ভুলে গেছি। আবার পড়ে মনে করতে হবে। কিন্তু এত দেরি করলে চলবে কেনু?

  2. সামিরা বলেছেনঃ

    আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। ভুলে গেছি সব। 🙁

  3. নিলয় বলেছেনঃ

    ভাইয়া- আগের দুই পর্ব পড়েই এইটা পড়েছি, কিন্ত্রু একদম নতুন লাগছে। হয়ত পরের পর্বে মিলিয়ে দেবেন 🙂

  4. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    ভাইয়া পর্বগুলো আরও কম সময়ের ব্যবধানে দিলে ভালো হয় না? 😳

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।