নায়লা চুপচাপ রুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লাল রঙের ড্রেসটায় তাকে কেমন মানিয়েছে বোঝার চেষ্টা করছে। ভাসাভি থেকে এতো টাকা খরচ করে ড্রেস কেনার পরও যদি ভালো না লাগে তাহলে কী আর করার আছে! গলায় অবশ্য ডায়মন্ড ওয়ার্ড এর নেকলেসটা দারুণ মানিয়েছে। নেকলেসটার উপর চোখ ফেরাতে পারছে না সে। ঈদের দিন ফ্রেন্ডদের দেখিয়ে কেমন চমকে দেয়া যাবে, ভাবতেই ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। হঠাৎ ঘুরে ঘড়িটার দিকে তাকায় সে। আজ আবার ছুটতে হবে পারসোনায়। ঈদের আগের দিন কী ভিড়টাই না হবে! তবুও ফেসিয়ালটা না করালেই নয়।
টুকটুকির বয়স পাঁচ। এবার তার জন্মদিন পড়েছে ঈদের ক সপ্তাহ পরে। তাই ঈদ আর জন্মদিন দু’টার শপিংই একসাথে করতে হচ্ছে। আব্বু, আম্মু, দাদু, নানু, মামা, চাচ্চু- সবার কাছ থেকে নতুন ড্রেস পেয়েছে টুকটুকি। শুধু ফুপ্পিটাই কিছু দিল না। কী পচা ফুপ্পি! নতুন একটা ড্রেসও দিতে পারে না। এবার ঈদের দিন ফুপ্পির সাথে কথাই বলবে না টুকটুকি। তিন জোড়া নতুন জুতোও পেয়েছে সে। ইশ, সারাবছর ঈদ থাকলে কত্তো ভালো হতো! ঈদের পর স্কুলে গিয়ে সবাইকে নতুন ড্রেসের কথা বলা যাবে। কতগুলো ড্রেস তার। ওদের স্কুলের কতগুলো মেয়েই মাত্র একটা ড্রেস পায় ঈদে! ওদের সাথে চলে না টুকটুকি। দে আর জাস্ট বোরিং!
শহিদ বঙ্গবাজারে তিনবার চক্কর দিয়ে ফেলেছে। এখানেও জিনিসপত্রের দাম এতো বেশি যে, হাত ছোঁয়াতে ভয় লাগছে। যদি দামের গরমে হাত পুড়ে যায়! দু’টা টিউশনি করে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে সে। মাসের খরচের অর্ধেক বাড়িতে পাঠানোর পর হাতে তেমন কিছুই থাকে না। তবুও ঈদের আগে বাড়িতে যাবার সময় মা, ভাই, বোন এর জন্য কিছু কিনতে ইচ্ছে করে। এবার কি পারবে কিনতে তিনজনের জন্য। চিন্তায় নাকি গরমে শহিদ এর কপালের ভাঁজে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যায়।
জুলেখা বেড়ার ফাঁকে আলো দেখেই লাফ দিয়ে উঠে। সকাল সকাল ওই বড় রাস্তার পাশে সাদা বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। ঈদের আগের দিন ওখানে নতুন কাপড় দেয়। পেটের খিদের কথা না ভেবেই রওনা দেয় জুলেখা। রোজার দিনে পেটে খিদে থাকলেও সারাদিন কিছু খাওয়া নিষেধ। না খেয়ে থাকতে পারলেই সওয়াব। অনেক সওয়াব হলে মরার পরেই বেহেশত। সেখানে চাইলেই যা ইচ্ছে খাওয়া যাবে। ভাত, মাংস, মিষ্টি, দুধ-আরও কত কি! সবকিছুই নানীর কাছ থেকে জেনেছে সে। পুরো রোজায় জুলেখা অনেক সওয়াব পায়। হাঁটতে হাঁটতে সে ভাবে, সারা বছর যখন সে না খেয়ে থাকে তখনও কি তার সওয়াব হয় না?
রহিমা বেগম ছেঁড়া কাপড় দিয়ে কোনরকমে গা ঢেকে ভিড়ের দিকে এগিয়ে যায়। এই বছর একটা যাকাতের শাড়ি তাকে পেতেই হবে, নইলে সারা বছর পরবে কী? ভিড় ঠেলে সামনে পৌঁছানোর দুরন্ত চেষ্টার মাঝেই মাটিতে পড়ে যায় সে। উঠে বসার চেষ্টা মাঝে শত পায়ের নিচে পিষ্ট হবার সময়ও সে ভাবতে থাকে, এবার মনে হয় শাড়িটা পাওয়া যাবে না।
আমি লেখা শেষ করে হাঁটতে বের হই। ঈদের আগের দিনের অপরিচিত নগরী। ফাঁকা পথঘাট, নিস্তব্ধ রাস্তা। গাড়ির ভিতরে বসে থাকা চকচকে তরুণী বা রঙিন জুতো পায়ে পুতুলের মতো বালিকার হাসি আমাকে স্পর্শ করে না। ফুটপাথ ধরে ছুটে চলা খালি গায়ে শিশু, পুরনো শার্ট পরা বিষণ্ণ যুবক, যাকাতের কাপড় নিতে আসা মানুষের লাশ আমার চোখ ঘোলা করে দেয়।
তবুও আমি হাসি। ঈদের সকালে নতুন পোষাকে রাস্তায় নেমে তবুও আমি ভাবি, ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ।
চোখ ভিজে গেল ভাইয়া।
পিষ্ঠ>পিষ্ট
বানান ঠিক করে দিয়েছি
কালকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছি, দেখি ৮-১০ বছরের একটা ছেলে রাস্তায় শুয়ে কিছু খাবার জন্য টাকা চাচ্ছে। কথা বলে বুঝলাম, ছেলেটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। ঠিকমতো চলতে পারছে না দেখে শুয়ে মানুষের কাছে টাকা চাচ্ছে।
মনটা এতো ভীষণ খারাপ হয়ে গিয়েছিলো! আমরা সবাই ঈদে কত খরচ করছি, আর কত মানুষ কত কষ্ট করছে।
কী লিখলি রে এটা তুই!
কী ভয়ঙ্কর, কী অব্যক্ত একটা ব্যথায় লীন হয়ে যাওয়া, কী একটা বাধ ভাঙ্গার আওয়াজ দু’চোখের তারায়।
আমি জানি না কী নাম এই অনুভূতির, জানতে চাইও না।
প্রতি ঈদে এই কষ্টগুলো ভীষণ জ্বালায় আমায়………
অনেক কষ্টের, কিন্তু ভীষণ বাস্তব কিছু কথা। মন খারাপ হয়ে গেলো 😳
এই বাস্তবতাটাকে যদি কোনভাবে ইতিহাস করে দিতে পারতাম……
ইতিহাস হবে, ভাইয়া। আমরা সবাই চাইলে নিশ্চয়ই হবে 🙂
নিশ্চয়ই 🙂
আমি আজকেই এই কথাগুলো ভাবছিলাম।।
এই যে দেখবি, আমাদের দারওয়ান ভাই, রিকশাওয়ালাদের কোনও ছুটি নাই।।। ব্যাপারগুলো কেমন যেন! নিজেকে অপরাধী লাগে।। অন্তত, আমাদের বাড়ি পাহারার জন্য যে মানুষগুলো তাদের ঈদ বিসর্জন দিচ্ছেন, তাদেরকে ঘরে ডেকে খাওয়ানো উচিৎ নয় কী…
জীবনে “empathy” শেখা দারুণ জরুরী
লেখাটা চমৎকার বন্ধু। ঈদ মুবারাক
ধন্যবাদ!
ঈদ মোবারক! 😀
ঠিক আমি যা বলতে চাই,তাই যেন বলে গেলেন কী সুন্দর ভাবে।
কিন্তু আমি বলতে পারি না, সুন্দর করে গুছিয়ে,বুঝিয়ে প্রকাশ করতে পারি না।তাই নিজের ভিতর ছটফট করি আর এক অব্যক্ত কষ্ট নিয়ে বছরের পর বছর ঈদ করি……
আবারো বলতে হচ্ছে আর কত কাল এভাবে যাবে???
আমি আর কত বড় হব? আমার মাথা এই ঘরের ছাদ
ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়ে
তিন প্রহরের বিল দেখাবে?”
আর খুব বেশিকাল নয় বলেই বিশ্বাস করি! 🙂
মন খারাপ করতেও কেন জানি অপরাধী লাগে নিজেকে, অনেক কিছু করার পরেও একটা জায়গায় এসে থমকে যাই আবার, আসলেই কী সুবিচার করতে পারছি সবা প্রতি?
ভালো লাগলো লিখাটা, অনেক সত্যি কথাগুলো……
“আসলেই কী সুবিচার করতে পারছি সবার প্রতি?”
এই প্রশ্নে এসেই থমকে যাই বারবার……
সারা বছর যখন সে না খেয়ে থাকে তখনও কি তার সওয়াব হয় না? – চমৎকার কথা
গল্পটা এর আগের বার পড়তে নিয়েও শেষ করতে পারি নাই।
এম্প্যাথিক হওয়া দরকার আমাদের।
যাকাতের কাপড়ের কারণে মানুষ পিষ্ট হয়, কোরবানির গোশত নিতে গিয়ে আহত হয়। 🙁
শিবলী ভাই এর লেখার কথা মনে পড়ল, ঈদে বাচ্চাদের ড্রেস এর জায়গায়
“এম্প্যাথিক হওয়া দরকার আমাদের।”
-সহমত!
“গল্পটা এর আগের বার পড়তে নিয়েও শেষ করতে পারি নাই।”
-কেন? ভালো লাগে নাই?
কী দারুণ লিখলেন ভাই! একেবারে মনের ভেতরে গিয়ে লাগে!
ধন্যবাদ!
sad but true!
ভুল হয়ে যাক সত্য এমন,
ধুলোমাখা এই শহরে।
”ভুল হয়ে যাক সত্য এমন,
ধুলোমাখা এই শহরে।”
🙁 🙁
“ভুল হয়ে যাক সত্য এমন,
ধুলোমাখা এই শহরে।”
তাই যেন হয়……