স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অথবা চ্যারিটি ফাউন্ডেশন খোলার পূর্বে

যখন এটা লেখছি, তখন ঈদুল ফিতর। সবাই রাস্তায় বা বসুন্ধরায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর আমি ঘরে বসে জ্বরে কাতরাচ্ছি। তবু এটা সৌভাগ্য যে, রমজানের ত্রিশ রোজা শেষ করার পরই জ্বরটা এলো। এজন্যও আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।

এই দুর্দিনে আমার এক বন্ধু আমাকে দেখতে এল। অনেক কথার মাঝে একটা বিষয় উঠে এল যে সে সহ আমার আরো কিছু বন্ধু মিলে বিশেষ কিছু করতে চায়, বিশেষত গরিব মানুষের জন্য। আইডিয়াটা শুনে মন্দ লাগলো না। আজকালকার দিনে অনেক বাচ্চাদেরই এমন একটা শখ থাকে, গরিব মানুষদের জন্য কিছু করে স্পটলাইটে আসবে। বছরের একদিন, বিশেষ করে ঈদের দিনটায় বাচ্চাদের জন্য কিছু করা হবে বলে চ্যারিটি ফান্ড তোলা, আর তারপর হই-চই করে কিছু জামা জাপড় কেনা, বাচ্চা অথবা গরীব মানুষের মাঝে বিতরণ। অতঃপর সেই নতুন জামা কাপড় পরা বাচ্চাদের সাথে হুল্লোড় করে ছবি তোলা।

তবে আমি কাউকে ছোটো করার জন্য বলছি না। কারণ স্বল্প হলেও এই কাজের মাঝে কিছুটা নিষ্পাপ এবং নিঃস্বার্থ ভাব আছে। অনেক মানুষ দেখেছি, যারা অনেক বড় কিছু হবার পর খ্যাতিটা ধরে রাখার জন্য অথবা সস্তা খ্যাতি লাভ করার জন্য এ ধরণের কাজ করতে চায়। সে তুলনায় বাচ্চা কিংবা যুবসমাজ কিছু করছে- এর মধ্যে বহুগুণ পবিত্রতা গড়ে ওঠে। তাই এসব কচিকাচা প্রাণকে ছোট করা আমাদের মোটেই উচিৎ হবে না।

তাই এদেরকে স্বাগত জানানো যায়। তবে এ ধরণের উদ্যোগ নেবার আগে কিছু কথা মাথায় রাখা ভালো।

একটা কথা আছে, “রোম একদিনে গড়ে ওঠেনি”। কোনো মহাদায়িত্বপূর্ণ কাজ ধীরে ধীরে শুরু করতে হয়, এবং ভেবেচিন্তে শুরু করতে হয়। কারণ এ ধরণের কাজে ভুল মানুষকে অনেক সময় বিভ্রান্ত করে তুলতে পারে। আপনি আজ কোনো মহৎ কাজ করতে গিয়ে যদি থেমে যান, কাল যখন আরেকজন আপনার চেয়েও অনেক পবিত্র এবং নিঃস্বার্থ মানসিকতা নিয়ে আরেকজন একই কাজ আরো ভালোভাবে শুরু করতে যাবে, তার সমাজ থেকে উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা পাবার স্থানটি কিন্তু অনেকাংশে সঙ্কুচিত হয়ে যাবে। ফলে এটা মাথায় রাখবেন, আপনি কিছু করার আগে আরেকজন মহৎ উদ্যোক্তার সুযোগ বন্ধ করে দিচ্ছেন না তো?

দ্বিতীয়তঃ আপনার পরিবেশ। আপনি একটি উদ্যোগ নেবার আগে তার পরিবেশ, বোধশক্তি, ঐ কাজের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি করতে পারছেন কিনা- এগুলোও অনেক বেশি গুরুত্ববহ। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, “Charity begins at home.” যে কাজ আপনি শুরু করতে যাচ্ছেন, তা আপনার ঘর তথা নিজ পরিবেশ থেকেই সৃষ্টি করতে হবে। আপনি মাঠে ঘাটে রাস্তার ছেলেদের জন্য কাপড় বিলি করে বেড়াচ্ছেন, অথচ নিজ বাসার কাজের ছেলের জন্য কোনো শিক্ষার ব্যবস্থা করলেন না, তাহলে কিন্তু আপনার কাজ নিতান্তই লোকদেখানো।

তৃতীয়তঃ দূরদর্শন। আজকাল মানুষ এই বিষয়টি সম্পর্কে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। দূরদর্শন কথাটার মধ্যে আবার অনেক বিষয় চলে আসে। যেমন ধরুন, আপনি ঠিক কোন কাজটি সঠিকভাবে করতে চাচ্ছেন, আর আসলে কি করতে পারছেন, সেই সম্পর্কে সঠিক বোঝাপড়া। আবুল মনসুর আহমদের “রিলিফ ওয়ার্ক” গল্পটার কথাটা মনে আছে তো? হ্যা ঠিক ধরেছেন, আসলে আমি কী বলতে চাইছি। দানের ব্যাপারটা আসলে সে রকম যেন না হয়।

দূরদৃষ্টির বললে আরেকটা বিষয় চলে আসে। আপনি আমি সবাই ধনীগরিবের বৈষম্য দূর করার কথা বলি, অন্তত ঈদের দিনে যেন না থাকে, তাই চেষ্টা করি। কিন্তু একবার ভাবুন তো, একদিন কিছু বাচ্চাদের খাবার কিনে দেয়ার মাধ্যমে কি এ বৈষম্য দূর করা যায়? যায় না। এতজনকে একদিনের জন্য এই স্বল্প মিথ্যে আশা না দিয়ে একজনের সারাবছরের লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করি। একজন রিকশাওয়ালাকে স্বাবলম্বী করে তুলি। এই কাজ একদিনের জন্য হবে না, সমাজের চোখে ধুলো দেয়ারও প্রশ্ন উঠবে না।

তবে আমার কাছে মনে হয়, এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার অনেক রয়েছে। “জাগো ফাউন্ডেশন” বলে আমাদের দেশে এধরণের ভলান্টিয়ার অর্গানাইজেশন আছে। প্রথম আলোর বন্ধুসভাও এক্ষেত্রে অনেকদূর এগিয়েছে। বিজ্ঞান চর্চার জন্য অনুসন্ধিৎসু চক্র রয়েছে। তাই তাদের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। এদের সবাই চ্যরিটি ফাউন্ডেশন নয় অবশ্য, তবু এদের কাঠামো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাজ বুঝতে সহায়তা করে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি তাদের সাথে হাতে কলমে কাজ শেখা যায়। তাতে যেমন অভিজ্ঞতা বাড়বে, তেমনি এর বাস্তব অবস্থাও দেখা যাবে।

পরিশেষে বলি আমি কোনো অভিজ্ঞ উদ্যোক্তা নই। সাধারণ দৃষ্টিতে যা করলে অন্তত কিছু মানুষ দারিদ্র্যের কবল থেকে মুক্তি পাবে, আর কিছু মানুষের উদ্যোগ স্বার্থকতা পাবে কেবল সে কথাটাই বললাম। তবে দানের উদ্দেশ্য থাকলে এসব চ্যরিটি ফাউন্ডেশন মূল কথা নয়। রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে না?

“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে…”

বিঃ দ্রঃ যদি কারো কাছে এই কথাগুলো অর্থহীন বা এলোমেলো বলে মনে হয়, তাহলে তার মূল্যবান সময়টুকু নষ্ট করার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

মারুফ আহমেদ সম্পর্কে

মহাজ্ঞানী অথবা দার্শনিক নই...... সব কিছু দেখি আমার সরল খোলা চোখে...... আজ তারুণ্যের সাথে একাত্মতা ...... পরিবর্তনের স্লোগান ধারণ করি সত্যের নিরিখে......
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে উদ্যোগ, চিন্তাভাবনা, বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

10 Responses to স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অথবা চ্যারিটি ফাউন্ডেশন খোলার পূর্বে

  1. নিলয় বলেছেনঃ

    লেখার টপিক আর লেখা নিঃসন্দেহে ভালো 🙂

    চ্যারিটি ফাউন্ডেশন হিসেবে আপনি সবার প্রথমে ‘জাগো’র নাম বললেন- ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হিসেবে বলতে পারি, এই ফাউন্ডেশন কিন্তু কিছুটা বিতর্কিত। প্রথমে যার নাম আসবে, অনেকে সেটাকেই রোল মডেল ভেবে নিতে পারে। আপনি নিজের লেখায় ‘সস্তা খ্যাতি লাভ’ কিংবা ‘স্পটলাইটে আসার’ ব্যপারটা দারুণভাবে তুলে ধরেছেন, ইদানিংকালে ‘জাগো’র বেশ কিছু এধরনের কীর্তিকলাপ কিন্তু প্রকাশ পেয়েছে। আমি বেশি কথা বলবো না, অনেকে আমাকে ‘জাগো’বিদ্বেষী মনে করতে পারেন- তাদের সন্দেহ দূর করার জন্য বলছি, আমি বরং নিঃস্বার্থ ভলান্টিয়ারিজমের প্রতি বেশি আগ্রহী, যেখানে কাজ করে অমূল্য আনন্দ পাওয়া যাবে- যেটা সার্টিফিকেটের চেয়ে অনেক দামী। এধরনের অনেক সংস্থা আছে আশেপাশে- খুঁজলেই কাছে পাবেন 🙂

    ভালো থাকবেন। লেখা চলুক 🙂

  2. রাইয়্যান বলেছেনঃ

    ছাত্রজীবনে বন্ধুদের উদ্যোগে শিশুদের জন্য কিছু করার চেষ্টাকে সবসময়ই স্বাগত জানাই! এটা মহৎ কাজ, শুধু সেজন্য নয়, বরং এই কাজ করতে গিয়ে তারা সমাজের সুবিধাবঞ্চিত সদস্যদের আরও কাছাকাছি আসতে পারবে, দুঃখ কষ্টগুলো কাছে থেকে দেখতে পারবে, এটাই হয়ত পরিণত বয়সে তাঁদেরকে আরও সচেতন, দানশীল ও চিন্তাশীল করে গড়ে তুলবে! যে মানুষটা এখন সেই দুঃখকষ্টগুলো কাছে থেকে দেখছে, সে যদি একদিন দেশের নীতিনির্ধারক হয়, আমরা আশা করতেই পারি গরীবের স্বার্থবিরোধী নীতি সে প্রণয়ন করবে না!

    হ্যাঁ, অনেকেই আছেণ ফেসবুকে ভাব নিয়ে অ্যালবাম পোস্ট করার নিয়্যত থেকে লোকদেখানো কাজ করে থাকেন, তবে তাঁদের সংখ্যাটা খুব বেশি নয়, বরং মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করা মানুষের সংখ্যাই বেশি! তাছাড়া প্রাথমিকভাবে কারও উদ্দেশ্য যদি ভাব মারা হয়েও থাকে, তবুও কিন্তু সেই Empathy গড়ে ওঠা অসম্ভব নয়, আমি তাই এ বিষয়ে সবসময়ই অপটিমিস্ট! 😀

    দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের প্রসঙ্গটা খুব ভাল বলেছেন! “এতজনকে একদিনের জন্য এই স্বল্প মিথ্যে আশা না দিয়ে একজনের সারাবছরের লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করি। একজন রিকশাওয়ালাকে স্বাবলম্বী করে তুলি।” — সুপার ডুপার লাইক! আর সব বাদ দিলেও আমাদের যাকাতের টাকাটা এরকম দূরদৃষ্টি নিয়ে ব্যবহার করলেই কিন্তু ভাল ফলাফল আসতে থাকে! আর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দীর্ঘমেয়াদে sustainable কাজ করার কোন বিকল্প নাই!!

    “নিজ বাসার কাজের ছেলের জন্য কোনো শিক্ষার ব্যবস্থা করলেন না, তাহলে কিন্তু আপনার কাজ নিতান্তই লোকদেখানো। খুব খুব জরুরী কথা।

    ধন্যবাদ!

  3. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    ভালো লেখা।
    নিজের চিন্তাধারার প্রকাশ ভালো লেগেছে।

    রাইয়্যানের মত আমিও বলি, বড়াই করার জন্য স্বেচ্ছাসেবী কাজ করা মানুষের সংখ্যা কিন্তু আসলেই কম। এটা আমার বিশ্বাস। 🙂

  4. সামিরা বলেছেনঃ

    খুব ভাল লেগেছে লেখা। বিশেষ করে ‘দূরদৃষ্টি’র ব্যাপারটা।

    আর আমাদের আগ্রহটা ‘কাজ’কেন্দ্রিক হওয়াটাও বোধহয় জরুরি। অনেক সময় দেখা যায় ‘আমি কাজ করবো’ এটার চেয়ে সংগঠন খোলার দিকে ঝোঁক বেশি থাকে। যদি এমন হয় যে আমার অভিনব কোন আইডিয়া নেই আর যেই আইডিয়া আছে ঠিক সেরকম কাজ একই মূল্যবোধ নিয়ে আরও কেউ করছে, তাহলে তাদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে যাওয়াটাই হয়তো বা ভাল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।