দক্ষিনের জানালাটাকে মাঝে মাঝে শত্রু বলে মনে হয়। সেদিনের কথাই ধরুন। মুখের উপর ভারি একটি বই নিয়ে আধশোয়া হয়ে পড়ছিলাম। মুখোমুখি জানালাটা, পাশেই একটি construction site আছে বলে বেশিরভাগ সময় ভারী পর্দা দিয়ে মোটামুটি বন্ধ করে রাখা হয় জানালাটা। কি বুঝে কে জানে, হয়তো একটু বেশি গরম পড়েছিল বলেই আমার ছোটবোন জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিলো। তারপরেই কেন জানি বইয়ের লেখাগুলো ঝাপসা হয়ে উঠল, কারন আর কিছুই নয়, বইয়ের চারপাশ দিয়ে আলোর বন্যা এসে বইটাকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিচ্ছে যে। বইটা সরাতেই হল সামনে থেকে, আহ আলো আর আলো। শেষ বিকেলের সে আলো, আকাশের নিচের দিকটা এখনও লাল, আর উপরের দিকটা অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার অপেক্ষায় গাঢ় নীল। অপূর্ব এ দৃশ্য ছোট্ট একটি জানালার এপাশ থেকে দেখা যে কী কষ্টের তা ঐ মুহুর্তের আমি ছাড়া আর কারও পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব বলে আমার মনে হয় না।
আমার সারাজীবন কেটেছে ছোট বাসা কিন্তু বাসার সামনে বড় একটি উঠোন দেখে, বাসার পাশে বিশাল খেলার মাঠ, প্রচুর গাছপালা, আর সবচেয়ে বড় কথা- বাসার সামনে কোন তালা ঝুলিয়ে রাখতে হয় নি সারাক্ষণ। একটি ঘটনা বলি, আমার বয়স তখন অনেক কম, ক্লাস থ্রি কি ফোরে পড়ি। থাকি ময়মনসিংহ, আমাদের বাসাটা ছিল চারপাশে পাকা দেয়াল আর উপরে টিন এর চাল। চাল ঠাণ্ডা রাখার জন্যই হোক অথবা বৃষ্টির শব্দ কমানোর জন্যই হোক, অথবা আমার বাবার শখ বলেই হোক, চালের উপর সবসময় থাকতো কোন না কোন গাছ, শিম, কাঁকরোল, লাউ, করল্লা যে কোন কিছু একটা। আমার বাবা আবার এসব গাছের যত্ন করতেন অনেক আন্তরিকতার সাথে। শিমের ফুলে যখন আমাদের বাসার ছাদটাকে গোলাপি দেখাতো, বাড়ির পাশের মাঠে বিকেলে খেলতে গিয়ে তাকিয়ে থাকতাম আমি খেলার কথা ভুলে, সত্যিই হয়তো ঐ ছোট বয়সে তেমন করে কখনো খেয়াল করি নি, কিন্তু এখন যখন মাঝে মাঝে জানালাটার কাছে গিয়ে দাড়াই তখন মনে হয় অবশ্যই খেলার কথা ভুলে গিয়ে আমি হয়তো সেদিকেই তাকিয়ে থাকতাম। গোলাপি ফুলগুলো যখন সবুজ বেগুনী মিশেল শিমে রুপান্তরিত হয়েছে তখন মা কত অনুনয় বিনয় করত চালে উঠে কিছু শিম পেরে দিতে, আহ কী ভাবটাই না নিতাম, খেলাধুলা, স্কুল, পড়ালেখায় মহা ব্যস্ত আমি, আমার সময় কোথায় এইসব শিম টিম পেড়ে দেয়ার! প্রথম যখন আমার বাবার লাগানো গাছটায় কাঁকরোল হল, সবুজ সবুজ কাঁটাওয়ালা কাঁকরোলগুলোকে গাছে ঝুলে থাকতে দেখে আমি কী যে অবাক, বাজার থেকে কিনে আনা কাঁকরোল গুলো এভাবে গাছে ঝুলে থাকে! কী আশ্চর্য! কত ঘটনাই না আজ মনে পড়ছে। আরেকটা ঘটনা না বলে পারছি না, তখন বৈশাখ মাস আসছে আসছে অবস্থা। আমাদের বাসার একদিকে ছিল উঠোন যা কিনা বলা যায় অন্দরমহল, আর উল্টো দিকটা খোলা, বাসার ঠিক সামনেই ছিল একটা বিশাল বড় আম গাছ, অবশ্য আমাদের ঐ পাড়াটাতেই ছিল প্রচুর আমগাছ। যাই হোক, সেই আমগাছটা এতো বড় যে ছোট্ট আমি গাছের উপরটা ঠিক মতো দেখতেই পেতাম না। সেই গাছ ভরা আম, গুটি গুটি আমগুলিকেই বাচ্চারা (আমিসহ :P) ঢিল মেরে শেষ করে ফেলে, কিন্তু উপরের আমগুলি ভাগ্যগুণে বেঁচে যায়, বৈশাখ মাস আসতে আসতে সেগুলি বেশ বড়সড়ই হয়ে উঠে। দেখতে দেখতে এল বৈশাখের এক তারিখ, সেবার আমাদের বাসায় ছিল আমার ছোট খালামনি যে কিনা ঢাকা শহরের নিয়মিত বাসিন্দা। কালবৈশাখী ঝড়, সেকি বাতাস! সাথে তুমুল বৃষ্টি, বজ্রপাত। তখন রাত, বাইরে অন্ধকার। হঠাত আমার খালামনি অবাক হয়ে জিগ্যেস করে ‘কিরে! চালের উপর কিসের শব্দ তোদের! আম পড়ছে নাকি!’ সত্যি, একের পর এক আম পরার শব্দ, সেই অন্ধকারে, আমার বাবা আমাদের যন্ত্রণায় টিকতে না পেরে ছাতা মাথায় কিছু আম কুঁড়িয়ে আনলেন, সঙ্গে আমরাও , সেই রাতেই কাঁচা আমের ভর্তা খেলাম আমরা সবাই মিলে, তাও ভাগ্যিস আমার খালামনি ছিল সেদিন, নইলে কি আর এই তুমুল বৃষ্টিতে বাবা বাইরে যেতে দিতেন! মজার ব্যাপার হচ্ছে, পরের দিন ভোরবেলাতে উঠেও আমরা আর আম কুড়াতে পারিনি, কারা যে কখন এসে কুড়িয়ে নিয়ে গেছে আল্লাহই জানে! আজকাল যখন দেখি পহেলা বৈশাখে সেই কালবৈশাখী শহরের তোপে টিকতে পারে না, তখন বড় মায়া লাগে। এরকম আরও কত ঘটনা আছে, লিখে যেতেই ইচ্ছা করছে শুধু, কিন্তু সময় বরই করুণাহীন!
সেই কবেকার কথা এগুলো! এখনও ভুলতে পারিনা, ভুলব কি! বরং আজও কত স্পষ্ট হয়ে আছে সবকিছু! কত কিছু মনে পরছে! অবাক লাগে, এমনিতেতো এসব কিছু মনে থাকে না। মনে পরেও না, মনে হয় সব ভুলে গেছি, এমনি এক জানালার পাশে যখন দাঁড়িয়ে থাকি তখন অবাক লাগে এই ভেবে যে কত খুঁটিনাটিও মনে আছে! মনে পড়ছে। আসলেই মানব ব্রেইন থেকে কিছুই মুছে যায় না, অপেক্ষায় থাকে শুধু উপযুক্ত সময়ের!
এই দক্ষিনের জানালাটা আমার সামনে ঝুলিয়ে দেয় চতুষ্কোণ এক টুকরো আকাশ ঠিক যেন মুলোর মতো, আর আমিও বোকার মতো তার পিছনে ছুটতে ছুটতে হারিয়ে যাই আমার সেই স্মৃতির খোলা মাঠটায়, শুনতে পাই বৃষ্টির একটানা শব্দ, ছুটে বেড়াই শেষ বিকেলের টাটকা হলুদ সোনারঙা আলো গায়ে মাখতে মাখতে… সত্যি দক্ষিনের এই জানালাটাকে মাঝে মাঝে শত্রু বলে মনে হয়।
– ঘাস
নস্টালজিক হয়ে গেলাম।
লেখার হাত ভালো আপনার। 🙂
ভালো লেগেছে 🙂
লেখা চলুক 🙂
…মন কেমন করে দিল লেখাটা…… খুব সুন্দর 🙂
:welcome:
ভাল লেগেছে। বানান বিভ্রাট কমুক! 😀
চমৎকার লিখা আপনার, বেশ অন্যরকম লাগে লিখাগুলো, আর ভাবনাগুলোও ভীষণ অন্যরকম! লিখা চলুক!! অপেক্ষায় থাকলাম আরো লিখার……
:welcome: