উঁহু, বলিউডের সালমান খান নন। জন্মসূত্রে বাংলাদেশি এই সালমান খান হচ্ছেন একজন শিক্ষাবিপ্লবী, যাঁর নাম জানেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। আমাদের চিরাচরিত একঘেয়ে পড়াশোনার নিয়ম পালটে কীভাবে একে মজাদার করে তুলছেন এই মানুষটা, তা নিয়ে গত বছরের জুলাইতে wired.comএ প্রকাশিত হয়েছিল সাংবাদিক ক্লাইভ থম্পসনের এই লেখাটা ((http://www.wired.com/magazine/2011/07/ff_khan/all/1)) – যার অনূদিত আর কিছুটা রূপান্তরিত সংস্করণ দুই পর্বে পড়তে পারবেন আমার এই ব্লগবাড়িতে।
“এই অঙ্কটা আমার সবচেয়ে প্রিয়!” ফিফ্থ গ্রেডে পড়ুয়া ম্যাথিউ কার্পেন্টারের কথা শুনে ওর কাঁধের ওপর দিকে উঁকি দিয়ে দেখি, একটা ইনভার্স ত্রিকোনমিতিক ফাংশন নিয়ে কাজ করছে সে, cos-1(1) এর মান কত হবে সেটা নিয়ে।
ধূসর টি-শার্ট, আর কালো ঘড়ি পরা গম্ভীর চেহারার ১০ বছরের কার্পেন্টার কিছুক্ষণ ভেবে ‘০ ডিগ্রি’তে ক্লিক করলো, আর সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটার জানিয়ে দিল যে তার উত্তর নির্ভুল। একের পর এক অঙ্ক আসতে থাকলো তারপর, কয়েক মিনিটেই ১০টা ইনভার্স ত্রিকোনমিতির সমাধান করে কার্পেন্টারের কুণ্ঠিত স্বীকারোক্তি, “এগুলো বুঝতে বেশ সময় লেগেছে আমার।” বলে নেয়া ভাল, এ পর্যন্ত তার মোট সমাধান করা অঙ্কের সংখ্যা ৬৪২।

ছোট্ট ম্যাথিউ
ক্যালিফোর্নিয়ার লস আল্টসের সান্টা রিটা এলিমেন্টারিতে পড়ুয়া কার্পেন্টারের মোটেও এত জটিল অঙ্ক নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা না এখন। এই বসন্তে আমি তার যেই রোদ ঝলমলে, কাগজের ফাইটার প্লেন আর গাছের ছবিওয়ালা ক্লাসরুম দেখে এসেছি, সেখানকার বাচ্চাদের এখন করার কথা মৌলিক ভগ্নাংশ, দশমিক আর শতকরা হিসাবের অঙ্ক। হাই স্কুলে যাওয়ার আগে, আর অনেক সময় তখনও কোন ছেলেমেয়ে ইনভার্স ত্রিকোনমিতি নিয়ে পড়াশোনা করে না – জানালেন তার শিক্ষিকা কামি থরডারসন।
কিন্তু গত নভেম্বর থেকে থরডারসন ‘খান একাডেমি’ ((http://www.khanacademy.org/)) ব্যবহার করে ক্লাসে পড়ানো শুরু করেন। ‘খান একাডেমি’ হচ্ছে একটা শিক্ষামূলক ওয়েবসাইট, যেখানে “প্রায় যে কোন বিষয় ফ্রীতে” ((Learn almost anything for free – খান একাডেমির স্লোগান)) শেখার ব্যবস্থা আছে। প্রায় ২৪০০র মত ভিডিওতে সাইটের প্রতিষ্ঠাতা সালমান খানের কাছ থেকে গণিত, বিজ্ঞান, অর্থনীতি আর ফাঁকে ফাঁকে সামাজিক বিজ্ঞানেরও পাঠ নিতে পারেন আগ্রহী যে কেউ। ইচ্ছাকৃতভাবেই সাধারণ, অসম্পাদিত ভিডিওগুলো ৭ থেকে ১৪ মিনিটের মত লম্বা, যেখানে খানের কণ্ঠে শোনা যেতে থাকে কোন গাণিতিক ধারণার ব্যাখ্যা কিংবা সমস্যা সমাধানের উপায়, সেই সাথে স্ক্রীনে ফুটে ওঠে তাঁর হাতে লেখা সূত্র আর ছবি। ‘ওযের জাদুকর’এর মত খানও পর্দার আড়াল থেকে কখনও ভিডিওতে এসে হাজির হন না। ওয়েবসাইটে এমন সফ্টওয়্যারও আছে যেটা সমাধানের জন্য আপনাকে একের পর এক সমস্যা এনে দেবে আর পর পর কিছু প্রশ্নের ঠিক উত্তর দিতে পারলে ‘ব্যাজ’ দেবে উপহার হিসেবে, অনেকটা ভিডিও গেইমের মত। বন্ধুদের মনে একই সাথে ঈর্ষা আর মুগ্ধতা জাগিয়ে কার্পেন্টার এ পর্যন্ত ৫২টা ব্যাজ পেয়েছে।
থরডারসন যেখানে ভেবেছিলেন খান একাডেমি কেবল তার পড়ানোর কাজে নতুন একটা মাত্রা যোগ করবে, সেখানে আজ এটা তাঁর ক্লাসরুমের কাজগুলো পুরোপুরি বদলে দেওয়ার পথে। যেমন, নিজের কিছু লেকচারের বদলে তিনি এখন বাচ্চাদেরকে খানের ভিডিও দেখতে বলেন বাসায় বসে। পরদিন ক্লাসে এসে তারা সে বিষয়ের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামায়। এতকাল স্কুলে যেমনভাবে পড়াশোনা চলে এসেছে সে নিয়ম উলটে দেওয়া হয়েছে, বাসায় বসে ছেলেমেয়েরা লেকচার শুনছে আর ক্লাসে এসে হোমওয়ার্ক করছে। শুনতে অদ্ভুত হলেও ভেবে দেখলে ব্যাপারটাকে যুক্তিযুক্ত মনে হয়। কারণ, হোমওয়ার্ক করার সময়েই বাচ্চারা আসলে ঠেকে যায় আর তখনই ওদের সাহায্যের দরকার হয় বেশি। বরং খান একাডেমির ড্যাশবোর্ড অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে থরডারসন এখন তার চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে – কে কখন সমস্যায় পড়লো সেটাও জানতে পারেন সাথে সাথেই।
ফলাফল হিসেবে থরডারসনের ছাত্রছাত্রীরা আপন গতিতে এগিয়ে যায় পড়াশোনায়। একটু দুর্বলেরা বিশেষায়িত সুবিধা পায়, অন্যদিকে কার্পেন্টারের মত অগ্রসর বাচ্চারা যখন নির্ভুলভাবে একটা বিষয়ের প্রশ্নগুলোর উত্তর করতে পারে তখন সফ্টওয়্যার ওদের সামনে নিত্যনতুন বিষয় নিয়ে আসে। ক্লাসের অর্ধেকেরও বেশি ছেলেমেয়ে এখন বীজগণিত আর জ্যামিতির সূত্র শিখছে। পিছিয়ে পড়াদেরও উন্নতি হচ্ছে ধীরে ধীরে: বছরের মাঝখানে যেখানে ১৩% বাচ্চা মাঝারি বা তার কম স্কোর করেছিল পরীক্ষায়, সেখানে বছর শেষে তাদের সংখ্যা নেমে এসেছে ৩%এ।
বছরের পর বছর ধরে থরডারসনের মত শিক্ষাকর্মীরা ক্লাসে পড়ানো নিয়ে অনুযোগ করে আসছিলেন – তারা একসাথে অনেকজন শিক্ষার্থীকে একই বিষয়ে, একই গতিতে পড়ানোর চেষ্টা করেন আর অবধারিতভাবেই ব্যর্থ হন তাতে। একটু অগ্রসর ছেলেমেয়েদের তখন একঘেয়ে লাগতে শুরু করে, আর পিছিয়ে পড়া বাচ্চারা দিশেহারা হয়ে আগ্রহ হারায় – শেষমেশ দেখা যায় অর্ধেক শিক্ষার্থীই আর ক্লাসে মনোযোগ দিচ্ছে না। ‘৮০র দশকের শুরুতে যখন পারসোনাল কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু হল, শিক্ষাকর্মীরা আশা করেছিলেন যে প্রযুক্তি হয়তো বা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য তার চাহিদা অনুযায়ী আলাদাভাবে শেখার ব্যবস্থা করতে পারবে। কিন্তু ক্লাসরুমে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির জন্য মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার খরচ করার পরেও শেষ পর্যন্ত কোন ফল পায় নি স্কুলগুলো।
খানের ভিডিওগুলো আর যাই হোক, অত্যাধুনিক নয়। তবে ঘরের কোনায় বসে ২৫ ডলারের লজিটেক হেডসেটে রেকর্ড করা এসব ভিডিও দেখেও তাঁর কিছু ভক্তের বিশ্বাস, শেখানোর গোপন সূত্র খুঁজে পেয়েছেন খান। ‘খান একাডেমি’কে এ পর্যন্ত দেড় মিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছে যাঁর প্রতিষ্ঠান, সেই বিল গেট্সও তাদের একজন। “এত গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস – ঠিক এমন কিছুর খোঁজেই ছিলাম আমি,” তিনি বলেন। শিক্ষার প্রথাগত ধারাকে বদলে প্রত্যেকের জন্য যে একে আলাদাভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব, খান সেটা প্রমাণ করেছেন বলে তাঁর বিশ্বাস।
সবাই যে তাঁর সাথে একমত এমন নয়। সমালোচকদের মতে, খানের ভিডিওগুলো ছেলেমেয়েদের সৃজনশীলতা ব্যবহার না করে কেবল বার বার অনুশীলনে উৎসাহ দিচ্ছে, যাতে তারা সত্যিকারের শিক্ষকদের রেখে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এমন কি খান নিজেও স্বীকার করেছেন যে তিনি কোন পেশাদার শিক্ষাবিদ নন, বাচ্চাদেরকে শেখানোর জন্য একটা চমৎকার উপায় বের করেছেন মাত্র। ভাল হোক কি খারাপ, এর অর্থ হচ্ছে স্কুলের এখনকার কারিকুলামকে বদলে দেওয়ার জন্য তাঁর কোন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই।
সীমাবদ্ধতা যাই হোক, খানের সাইট দিনকে দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ২ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ প্রতি মাসে তাঁর ভিডিও দেখে, আর তারা প্রত্যেকেই সেকেন্ডে ১৫টা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে বলে জানিয়েছে। দরকারি আর জটিল বিষয়গুলো বুঝতে ‘খান একাডেমি’ যে শিক্ষার্থীদের কাজে আসছে তা বলাই বাহুল্য। তিনি একাই নন: TED talks থেকে শুরু করে iTunes U আর ইঞ্জিনিয়ার বিল হ্যামাক ধীরে ধীরে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে শিক্ষাকে সহজতর করার চেষ্টা করে চলছেন। আমাদের দেশের স্কুলগুলোতে এসব সাইটের অবদান কী হবে তা এখনও অস্পষ্ট, তবে থরডারসনের ক্লাসের মত জায়গাগুলো থেকে একটু একটু করে বোঝা যাচ্ছে।

ক্লাস নিচ্ছেন থরডারসন
প্রত্যেকের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষাব্যবস্থা ফলপ্রসূ এটা শিক্ষকেরা জানতেন অনেক আগে থেকেই, আর ১৯৮৪ সালে বেঞ্জামিন ব্লুম সেটা হাতে-কলমে প্রমাণ করে দেখান। একদল শিক্ষার্থীকে ক্লাসরুম থেকে বাইরে এনে আলাদাভাবে শেখানোর পর দেখা গেল, তারা ক্লাসে প্রচলিত নিয়মে পড়ুয়াদের চাইতে দুই ধাপ এগিয়ে আছে পড়াশোনায়। ব্লুমের এই গবেষণা শিক্ষাক্ষেত্রে ভালরকম শোরগোল তুললেও শেষমেশ তেমন পরিবর্তন আনতে পারে নি ক্লাসরুমের চিরচেনা গণ্ডিতে। সবচেয়ে বড় কথা যেটা, প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য একজন করে শিক্ষক নিয়োগ করার মত অসম্ভব ব্যয়বহুল একটা ব্যবস্থা নেয়ার সঙ্গতি আছে কোন্ দেশের?
“প্রত্যেকের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষার ব্যবস্থা করাটাই যে শেখানোর সবচেয়ে ভাল উপায় সেটা আমরা সবাই জানি, যা জানি না সেটা হচ্ছে কাজটা কীভাবে সম্ভব করা যায়,” ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেইন ভিউ শহরতলিতে খানের ছোট্ট চার রুমের অফিসে প্রথম যেদিন আমাদের দেখা হল, খান এভাবেই ব্যাখ্যা দিলেন অবস্থাটার। বড় বড় বাদামি দুটো চোখ আর একমাথা কুচকুচে কালো চুলের বছর চৌত্রিশের খান কথা বলতে বলতে চেয়ারে হেলান দিলেন; অনবরত কৌতুক করার ফাঁকে, চটপটে বুদ্ধির পড়ুয়া এই দক্ষিণ এশীয়-আমেরিকানের কথায় হঠাৎ হঠাৎ নিউ অর্লিন্সে বেড়ে ওঠা তারুণ্যের রেশ পাওয়া যায়। তাঁর পুরনো টেলিফোন পোলের তৈরি টেবিলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল বিনিয়োগ, পদার্থবিজ্ঞান আর হৃদরোগের ওপর বই – আগামী ভিডিওগুলোর জন্য। আশ্চর্য দ্রুততায় কাজ করেন খান – সাইটের প্রতিটা ভিডিও তাঁর নিজের করা, একদিন কাজ করতে বসলে আটটার মত ভিডিও শেষ করে ওঠেন তিনি। গণিত আর বিজ্ঞানের কাঠখোট্টা আলোচনা থেকে ব্যবসার খুঁটিনাটি – সবই পাওয়া যায় তাঁর ভিডিওতে। MIT থেকে গণিতে ব্যাচেলর আর কম্পিউটার সায়েন্সে ব্যাচেলর ও মাস্টার ডিগ্রি, সেই সাথে হার্ভার্ডের এমবিএ – একগাদা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এক্ষেত্রে ভাল কাজে দেয়। তবে প্রায়ই নিজের পরিচিত গণ্ডির বাইরে চলে আসেন তিনি – ওয়েব, উইকিপিডিয়া, ব্যক্তিগত লাইব্রেরি আর মেধাবী বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে নতুন সব বিষয় শিখতে চেষ্টা করেন, শেখানোর জন্য অবশ্যই। নানান বিষয়ে একেবারে সাধারণ জ্ঞানের বইও আছে তার অফিসে।
খান কখনোই শিক্ষাবিপ্লবী গোছের কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখেন নি। হাই স্কুলে গণিতে ভাল ছিলেন বলে রিচার্ড ফাইনম্যানের মত তত্ত্বীয় পদার্থবিদ হতে চেয়েছিলেন, তবে পরে বুঝতে পারেন কম্পিউটারেই বেশি ভাল করবেন তিনি। MITর পড়া শেষ করে সিলিকন ভ্যালিতে কিছুদিন কাজ করেন, তারপর হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে আসেন মূলত ‘বিয়ে করতে’ – তার ভাষ্যে। (“সত্যি বলছি!” তিনি বলেন, “বান্ধবী কিংবা স্ত্রী খোঁজার জন্য ৯০ দশকের শেষের দিকের সিলিকন ভ্যালির মত বাজে জায়গা আর হয় না।” কাঙ্ক্ষিতাকে তিনি খুঁজে পেয়েছেন, বিয়েও করেছেন – সেই মেডিক্যাল ছাত্রী এখন মাউন্টেইন ভিউতে ডাক্তারি করেন।)
বিজনেস স্কুল থেকে খান কাজ করতে যান ‘ওল ক্যাপিটাল’এ, সেখানে তিনি বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন কোম্পানি নিয়ে গবেষণা করতেন। নিজেকে অচেনা গণ্ডিতে কেমন করে তাড়াতাড়ি মানিয়ে নিতে হয়, সেটাও ওখান থেকেই শিখেছেন তিনি। (ছোটখাটো ব্যাপারে নিজের সাধারণ জ্ঞানের ভাণ্ডারও সমৃদ্ধ করেছিলেন তিনি তখন, খেতে বসে আমাকে জানালেন একটা গড়পড়তা মুরগি বছরে ক’টা ডিম পারে – “২৬০টা!”) তাঁর বস ড্যান ওল তখন আবিষ্কার করেছিলেন, শেখানোর ব্যাপারে খানের আগ্রহই অন্যরকম। “অফিসে এসে দেখতাম, বোর্ড জুড়ে বিশাল সব সমীকরণ লেখা,” ওল বলেন। জুনিয়র স্টাফদেরকে ফিন্যান্সের খুঁটিনাটি শেখাতেন খান। “তাঁর একটা প্রকৃতিদত্ত গুণ ছিল, আর ছিল নিঃস্বার্থ একটা মন।”
তারপর, ২০০৪এ, দেশের অন্যপ্রান্ত থেকে খানের ১৩ বছরের কাজিন নাদিয়া তাঁর কাছে গণিত পড়তে চাইলো। খান তাকে ফোনে পড়া দেখিয়ে দিতে রাজি হলেন। গণিতের ধারণাগুলো তার কাছে স্পষ্ট করার জন্য ইয়াহু মেসেঞ্জারে বসে খান ড্রয়িং উইন্ডতে নানান সমীকরণ লিখতেন, নাদিয়া দেখতো। কোনদিন দুজনের সময় না মিললে খান নিজের লেকচারটা ভিডিও রেকর্ড করে রাখতেন – মাইক্রোসফ্ট পেইন্টে লিখতে লিখতে কথা বলতেন ভিডিওতে।
একদিন নাদিয়া জানালো যে সে আর ফোনে কথা বলতে চায় না, খান যেন তাকে ভিডিও রেকর্ড করেই দেন লেকচারগুলো। কারণ তাহলে সে ভিডিওটা যতবার খুশি দেখতে পারে, জটিল জায়গাগুলো কয়েকবার করে শুনতে পারে, আবার যেগুলো আগে থেকেই জানে সেগুলো বাদ দিয়ে যেতে পারে। “সে সরাসরি বলেছিল, ‘আপনাকে সরাসরি শোনার চেয়ে ভিডিওতেই বেশি ভাল লাগে আমার’,” খান জানালেন।
তখনই খান বুঝতে পারলেন, যে জিনিসটা আমার আগে থেকেই জানা থাকার কথা অথচ এখনও বুঝতে পারছি না, সেটা বার বার চর্চা করতে হলে একা থাকাটা জরুরি, কারণ তাহলে কারও সামনে বিব্রত হতে হয় না। লেকচারের গতির ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ চলে আসার পর নাদিয়া আরও তাড়াতাড়ি শিখতে শুরু করলো। “কেউ যখন আপনার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার বলতে থাকে ‘বুঝতে পেরেছো তো?’ – ওটা হচ্ছে কোন কিছু শেখার জন্য সবচেয়ে খারাপ সময়।”
দেশে গণিত শিক্ষার অবস্থা যে কতটা খারাপ সেটাও তিনি আবিষ্কার করেন তখন। আরও কিছু কাজিনকে পড়াতে গিয়ে (তাঁর ফ্রী পড়ানোর খবর ততদিনে জেনে গিয়েছিল সবাই) তিনি দেখলেন, তাদের ভিত একেবারে নড়বড়ে। সাধারণ ভাগের প্রশ্ন করলেও তারা উত্তর দিচ্ছিল আস্তে-ধীরে, তার ওপর আবার অনুমান করে। খান চাইছিলেন যে তারা প্রশ্ন করামাত্র উত্তর দেওয়ার মত চটপটে হয়ে উঠুক, কারণ তা না হলে আরও কঠিন বিষয়গুলো বুঝতে কষ্ট হবে তাদের জন্য।
তিনি ঠিক করলেন, কাজিনদের জন্য তাদের দরকারি অনুশীলনের ব্যবস্থা করবেন। স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদেরকে প্রশ্ন করবে এমন জাভা মডিউল তৈরি করলেন। পর পর ১০টা প্রশ্নের ঠিক উত্তর দিতে পারলে সফ্টওয়্যার তাদেরকে পরের পর্বে নিয়ে যাবে, আরও কঠিন প্রশ্ন থাকবে সেখানে। (তারা আসলেই অনুশীলন করছে কিনা জানার জন্য খান চাইলেই অনলাইন ডাটাবেইজ দেখে নিতে পারবেন।) খান নিজের অজান্তেই ‘দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা’ চালু করছিলেন, যেখানে শিক্ষার্থীদেরকে নতুন কিছু শিখতে হলে আগের জিনিসগুলো পুরোপুরি আয়ত্ত করেছে কিনা তার প্রমাণ দিতে হয়।
দুনিয়ার অন্যান্য জায়গাতেও খবর ছড়িয়ে পড়লো দ্রুত। খান আবিষ্কার করলেন, হাজার হাজার মানুষ ইউটিউবে তার ভিডিও দেখছে – কেউ পদার্থবিজ্ঞান তালগোল পাকিয়ে ফেলা ছাত্র, কেউ আবার অসমাপ্ত কলেজ ডিগ্রি ফিরে পেতে পুরনো পড়া ঝালাই করতে আসা উৎসুক মানুষ। খান দিন দিন নিজের সাইট নিয়ে আরও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, রাত জেগে নতুন সব ভিডিও তৈরি নিয়ে। আশ্চর্য উৎসাহী সব ইমেইল আসতে শুরু করলো তাঁর ভক্তদের কাছ থেকে।
“কোন কিছু ঠিকভাবে উপস্থাপন করা হলে যে সেটা যে কেউ বুঝতে পারি, তা আমি আপনার কাছ থেকে শিখেছি,” ১৯ বছরের টম ব্রান্নান লিখেছে, সে পেনসিলভানিয়ার একটা কলেজে ভর্তি হতে যাচ্ছে। গণিতে সি পাওয়ার পর টম ‘খান একাডেমি’ থেকে এমন কিছু শিখেছে, যার ফলে স্কুলের শেষ পরীক্ষাগুলোতে দারুণ কৃতিত্ব দেখিয়ে এখন কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশনের স্বপ্ন দেখছে সে। “পাঠ্যবই দেখে ‘ইউনিট সার্ক্ল’ শিখতে গিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছিলাম আমি,” লিখেছে টম। “আপনার ভিডিও দেখেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেছে।”
২০০৯এ খান নিজের শখকেই মূল পেশা হিসেবে নেওয়ার পরিকল্পনা করলেন। একটা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান শুরু করে, সিলিকন ভ্যালির বিনিয়োগকারী জন ডোর স্ত্রী অ্যান ডোর কাছ থেকে অল্প কিছু ডোনেশনও পেলেন। চাহিদা তখন তুঙ্গে, দশ হাজার-বিশ হাজার মানুষ তাঁর ভিডিও দেখছে প্রতি মাসে। খান তড়িঘড়ি করে আরও নতুন নতুন ভিডিও তৈরিতে মন দিলেন।
তারপর, গত গ্রীষ্মে ডো ‘অ্যাস্পেন আইডিয়াজ ফেস্টিভ্যাল’ থেকে তাকে টেক্সট করে জানালেন, “বিল গেট্স তোমার কাজ নিয়ে কথা বলছেন মঞ্চে।” অ্যাস্পেনের সেই অনলাইন ভিডিওতে ডায়াল করে খান দেখলেন, কোনদিনও তাঁর দেখা হয় নি যেই গেট্সের সাথে, তিনি খানের প্রশংসা করছেন, বলছেন যে তাঁর ছেলেমেয়েরাও ‘খান একাডেমি’র সাহায্য নিয়ে পড়াশোনা করে। (“শুনে আকাশ থেকে পড়েছিলাম আমি,” খানের মন্তব্য।) তার অল্প কিছুদিন পরেই খান গেট্সের সাথে দেখা করেন, আর ‘বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেট্স ফাউন্ডেশন’ থেকে দেড় মিলিয়ন ডলার অনুদান পান। গুগ্ল থেকে পান আরও ২ মিলিয়ন ডলার।
“গণিতই সব জায়গায় সবচেয়ে বেশি ঝামেলা করে,” খান বলেন। বেকারত্ব নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠান দেখেছে, গণিতেই বেশিরভাগ মানুষ হোঁচট খায় চাকরি নিতে গিয়ে। নার্সিং কিংবা পুলিশের চাকরিতে কেন যোগ দিচ্ছেন না, এমন প্রশ্ন করলে অনেকেরই উত্তর থাকে – গণিতের জন্য।
এতসব জনপ্রিয়, শিক্ষামূলক ইউটিউব ভিডিওর ভিড়ে ‘খান একাডেমি’ যে কারণে আলাদা তা হচ্ছে এর বাস্তবিকতা: এলিমেন্টারি আর হাই স্কুলের একেবারে মৌলিক সব সমীকরণগুলো যেন সহজ হয়ে যায় সবার কাছে, তা-ই এর লক্ষ্য। এধরনের ভিডিওগুলো সাধারণত খুব একঘেয়ে হয়, কিন্তু খান এমন ঘরোয়াভাবে লেকচার দেন যা শ্রোতাদের মনোযোগ ধরে রাখতে বাধ্য। এভাবে পড়ানোর ঢং যে মেকি এমনও না, বরং তিনি যেভাবে প্রস্তুতি নেন তারই ফলাফল এটা – খান বলেন। তিনি কখনোই স্ক্রিপ্ট লেখেন না – বরং একটা বিষয় যতক্ষণ পর্যন্ত না উৎসাহী কোন ৭ বছরের বাচ্চাকে বোঝানোর মত করে বুঝতে না পারেন, ততক্ষণ সেটা নিয়ে পড়াশোনা করতে থাকেন। (বীজগণিতের মত সহজ কিছু হলে ১০ মিনিটেই হয়ে যায় প্রস্তুতি, যেখানে জৈব রসায়নে চাই কি ৭ দিনও লাগতে পারে!) খান কখনও কাটাছেঁড়াও করেন না ভিডিওতে, হয় এক বসায় পুরোটা শেষ করে ফেলেন, নয় তো পছন্দ না হলে আবার শুরু থেকে রেকর্ড করেন।
খান যে কখনো ভিডিওতে নিজের চেহারা দেখান না – এর একটা ভাল দিক আছে বলে তার ধারণা। স্ক্রীনে কেবল তাঁর হাতের লেখাই দেখা যায়। “এতে করে যেটা হয় – আপনার মনে হবে না যে সামনে দাঁড়িয়ে লেকচার দিচ্ছে কেউ,” খান বলেন। “বরং মনে হয়, আমরা দুজন বন্ধুর মত টেবিলে বসে একসাথে কোন কিছু নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি।”

সালমান খান
(চলবে)
josh!
কোন্টা? 😀
একটানে পড়ে গেছি, অবশ্যই পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
খান একাডেমির বিষয়ে এত গোড়া থেকে জানতাম না।
এত অসাধারণ শুরুর ইতিহাসটা! :clappinghands:
😀
পরের পর্ব শীঘ্রই আসছে ইনশাআল্লাহ্।
আমাদের দেশে একটা জিনিস কাজ করে সেটা হল বেশীর ভাগ ছাত্র-ছাত্রী প্রাইভেট পড়ে। তবে দেশের বাইরে প্রক্ষাপট আলাদা। তবে আমার আজ মনে হয় দেশে ১৯৯১/১৯৯৩ (সঠিক মনে নাই )সালে যদি ইন্টারনেট সংযোগে সাবমেরিন ক্যাবল সরকার আনতো তাহলে আমার সবদিক থেকেই লাভবান হতাম। এখনো সংযোগ স্পী ড তেমন সস্তা বা ভাল না সব জায়গায়। আমি নিজের কথা বলতে পারি হাইস্কুলে থাকতে বিভিন্ন কারণে আমি প্রাইভেট পড়িনি, তবে খান একাডেমী থাকলে হয়তো কাহিনী অন্যরকম হতো !! সেই ব্যাপার এখন করতে হচ্ছে যদিও দেশের বাইরে আণ্ডার গ্রাড পড়তে আসার পর… আমাকেই সব একা করতে হয়েছে !! ইউটিউব আমার পাশে ছিলো সবসময়। এর প্রয়োজনীয়তা অনেক বিশেষ করে যারা একা পড়াশুনা করে। লেখার জন্য ধন্যবাদ 😀
সেটাই। খান একাডেমির মত সাইট প্রাইভেট পড়ার প্রবণতা কমিয়ে দিতে পারে নিঃসন্দেহে, আমাদের দেশে যদি জনপ্রিয় হয়। কিংবা যারা একা পড়ে তাদের জন্যও চমৎকার সাহায্য হতে পারে।
তা যদি হয়, তাহলে অল্পবয়সীদের ইন্টারনেট ব্যবহারে সুপারভিশনও দারুণ দরকারি। 🙂
“কেউ যখন আপনার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার বলতে থাকে ‘বুঝতে পেরেছো তো?’ – ওটা হচ্ছে কোন কিছু শেখার জন্য সবচেয়ে খারাপ সময়।”
এই কথাটা আগে কখনো মাথায় আসে নি।
ইম্যিউনোলজির ভিডিওগুলো দেখলাম। ভালোই লাগলো। শুধু স্কুল স্টুডেন্ট না আন্ডার গ্রাজুয়েট মেডিকেল স্টুডেন্টদেরও ভালো লাগবে ভিডিওগুলো। যদিও এই বিষয়গুলোর উপরে ভিডিও খুব কম। তবে ভালো লাগছে এই ভেবে যে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে উনার পড়াশোনা না করলেও বিশেষ কোন ক্ষতি হত না। কিন্তু এর পরও এই বিষয়গুলো নিয়ে তিনি সিরিয়াস পড়াশোনা করেছেন এবং রীতিমত লেকচার দিচ্ছেন। নিজে জানার এবং অপরকে জানানোর এমন আগ্রহ এ যুগে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
দেখবো দেখবো করে আমার দেখাই হচ্ছে না ভিডিওগুলি। 🙁
ঠিক এই একই কথা আমার মাথাতেও এসেছে। যেসব বিষয় নিয়ে তাঁর পড়াশোনা না করলেও হত, সেটা অন্যকে জানানোর জন্য পড়ছেন এবং এতটা শ্রম দিচ্ছেন (দিনে ৮টা ভিডিও তৈরির কথা শুনে হিংসা হচ্ছিল, অতটা প্রোডাক্টিভ কবে হতে পারবো সেটা ভেবে) – এই মানসিকতাটা প্রচণ্ড শ্রদ্ধা জাগায় মনে।
চমৎকার পোস্ট! 🙂
চমৎকার মন্তব্য! :happy:
ওরেব্বাস! পুরো খান একাডেমীই দেখি উঠে আসলো এক লেখাতে। দারূণ এটা কাজ করেছেন
ধন্যবাদ। লেখার বাকিটা আজকালের মধ্যে পেয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ্। 🙂
ফার্মেসীতে ১ম বর্ষে আমাদের পরিসংখ্যান পড়তে হয় যা কি না আমার জন্য বিভীষিকার মত!!! তবে এবার পরীক্ষার ঠিক আগের মুহূর্তে খান একাডেমির কয়েকটা ভিডিও দারুন কাজে লেগেছিল… … …
ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রিতেও কয়েকটা টপিকের উপর উনার ভিডিও দেখেছিলাম।
তখন অবশ্য এত ইতিহাস জানা ছিল না… … … তবে বেশ অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে যে আন্ডার গ্রেডে আমরা যা পড়ছি, এমন সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয় নিয়েও উনি এত পড়াশুনা করেছেন!! 😯
শ্রদ্ধা করতে বাধ্য । :huzur:
(এইসব মানুষদের দেখে যখন নিজের দিকে তাকাই আর “প্রোডাক্টিভিটি” শব্দটা নিয়ে চিন্তা করি তখন… … … নাহ্ , থাক হতাশার কথা বলব না 😛 )
😛
আমি কখনোই পড়াশোনার কাজে দেখি নি ‘খান একাডেমি’র ভিডিও। কী যে মিস করেছি!
“কেউ যখন আপনার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার বলতে থাকে ‘বুঝতে পেরেছো তো?’ – ওটা হচ্ছে কোন কিছু শেখার জন্য সবচেয়ে খারাপ সময়।” I can feel it..its my problem too.
খান একাডেমির কথা শুনেছিলাম। খুব সুন্দর ডিটেইলে তুলে ধরে বেশ ভালো কাজ করেছ।
ভয়ানক শ্রদ্ধায় পাগল হয়ে গেলাম! স্লোগানটা অসাধারণ মনে ধরল! এই নিঃস্বার্থ মানুষগুলোই বারবার আমাকে প্রেরণা দেয়।
অনুবাদ করেছি শুধু। 😀
আসলেই অনুপ্রেরণা পাওয়ার মতন মানুষ সব।