কি আশ্বর্য্যজনকভাবে মানুষ সেই আদিমকাল থেকে একইভাবে ভালোবেসে আসছে, অথচ কোন ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই! সেই একই রং একই ঢং, ভালোবাসার সেই একই রকম রূপ রস স্বাদ, একই রকম মায়া আহ্লাদ আর আকাংক্ষা, একই রকম স্বার্থপরতা, হিংসা আর অহংকার। কিন্তু না, আর এভাবে চলতে দেয়া যায়না, মানুষ ক্রমাগত সীমালংঘন করে চলেছে, তার আচরণে প্রকৃতি আজ তিক্ত হয়ে গেছে, হয়ে গেছে বিষণ্ন।
আমি মা বাবাকে ভালোবাসতে গিয়ে দেখি সবাই একইভাবে ভলোবাসে, আমি আমার ভাই ও বোনকে ভালোবাসতে গিয়ে দেখি সবাই একইভাবে ভলোবাসে, আমি বন্ধুকে ভালোবাসতে গিয়ে দেখি সবাই একইভাবে ভলোবাসে। এমনকি আমি আমার প্রেমিকাকে ভালোবাসতে গিয়েও দেখি সবাই তার প্রেমিকাকে সেই একইভাবে ভলোবাসে। কিন্তু আমি চাই একটু অন্য রকম করে ভালোবাসতে, নতুন নতুন উপায়ে ভালোবাসতে, নতুন কোনভাবে অভিমান করতে, নতুন কোন পথে স্বপ্ন দেখতে। কারণ, এই প্রচলিত ভালোবাসায় আমার ঘৃণা জন্মেছে, বিরক্তি ধরে গেছে।
কেন আমার সব বিষণ্নতা, কেন এত নির্লিপ্ততা সবখানে বুঝতে পারছিলাম না। তীব্রভাবে আমি সবাইকে কাছে পেতে চাইছি, সব অন্যায়গুলোকে ধ্বংস করতে চাইছি। অথচ কোথায় যেন বাঁধা, কোথায় যেন অপারগতা। শেষে দেখি সমস্যা আমার নিজের মাঝেই, জড়ো হয়েছে বহুকাল আগে থেকেই। ভেবে পেলাম, ঐ চিরায়ত ভালোবাসাই সব অনিষ্টের মূল! সব কাছের মানুষগুলোকে ভালোবাসতে ভালোবাসতে আমি দূরের মানুষগুলোকে ঘৃণা করতে শিখেছি, কাওকে আপন আর কাওকে পর ভাবতে শিখেছি, নিজের ভালোবাসার প্রমাণ দিতে গিয়ে অন্যের ভালোবাসার ক্ষতি করা শিখেছি। বস্তির শিশুগুলোকে দেখলে আমার খুব একটা মায়া লাগেনা, ভুলে যাই যে ওর জায়গাটায় তো আমিও থাকতে পারতাম। আমি ভুলে যাই ওই নোংরা পোষাক পড়ে আমাকেও তো রাস্তায় বাদাম বা ফুল বিক্রি করা লাগতে পারত। কেন আমি ওর জায়গায় নেই? এই না থাকায় আমার নিজের কি কোন কৃতিত্ব আছে? কারণ, আমার জন্মের ওপর তো আমার কোন কন্ট্রোল ছিলনা। এসব ভুলে যাই বলেই পারি কারণে অকারণে ওদের গলা ধাক্কা দিতে, পারি কথায় কথায় কোন রিক্সাওয়ালাকে গালি দিতে, কিংবা বাসার কাজের মানুষটার ওপর নির্যাতন চালাতে। তাছাড়া ওরা তো আমার পরিবারের কেউ না, না আমার সোসাইটির কেউ। আমি তো শিখেছি শুধু কাছের মানুষগুলোকেই ভালোবাসতে হবে, যাদের ভালোবাসলে নগদ লাভ হবে।
নিজেকে ভালোবাসতে গিয়ে আমি হিংসা আর অহংকার করা শিখেছি। আর নয়। আমি চাইনা কাওকে বড় হতে দেখলে আমার হিংসা লাগুক, কাওকে প্রশংসিত হতে দেখলে আমার হিংসা লাগুক, কিংবা কাওকে ক্ষমতাবান হতে দেখলে আমার হিংসা লাগুক। আমি অরো চাইনা আমার শিক্ষা, ধন-সম্পদ, সততা বা সৌন্দর্য্য আমাকে অহংকারী করুক। আমি চাইনা আমার দারিদ্র্য, অপারগতা, গায়ের রং বা বংশ আমাকে হীনমন্য করুক। আমি ভিন্ন কারণে হিংসা করতে চাই, ভিন্নভাবে অহংকার করতে চাই। কিন্তু কিভাবে আমি জানিনা । তাই আমি সব রকম অনুভূতির আমূল পরিবর্তন চাই।
মানুষ কি নির্লজ্জের মত সৌন্দর্য্যকে পূঁজা করে যাচ্ছে আদিমকাল থেকে! কারণ সে সৌন্দর্য্যকেই ভালোবেসে যাচ্ছে নিষ্ঠুরের মত, সত্যকে নয়। শেলী কিটস যখন বলেন “Truth is beauty, beauty is truth”, আমরা বুঝে না বুঝে নতুন করে সুন্দরের প্রেমে হাবুডুবু খাই, কিন্তু ভাবিনা শুধু সুন্দর নয়, প্রকৃতিতে অনেক অসুন্দরও সত্য। বাইরের আবরণের ভেতরে যে সম্পদের ভান্ডার থাকতে পারে, রূপের চেয়ে গুণই যে মানুষের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করে আমরা ভুলেই যাই, পরিণামে হই ক্ষতিগ্রস্থ। অসুন্দরকে ভালোবাসতে না পারলে তার গুণাবলির ঝলক দেখব কি করে? কয়লাকে সময় না দিলে হীরক হবে কি করে? সুতরাং প্রয়েজন ভালোবাসার গতি পরিবর্তন, দিক পরিবর্তন, কিংবা আমার অনুভূতির পরিবর্তন।
কেউ আমাকে অবহেলা করলে আমার কষ্ট লাগে, বন্ধু বিশ্বাস ভাঙলে আমার কষ্ট লাগে, প্রিয়জন ভুল বুঝে চলে গেলেও আমার কষ্ট লাগে। এত কষ্ট পেলে আমার পৃথিবী চলবে কী করে?! শুধু তাই নয়, কষ্ট পেয়ে মাঝে মাঝে কান্নাও আসে। কি অপ্রয়োজনীয় ও লজ্জার ব্যাপার!! এগুলোর পেছনের কারণও ঐ রহস্যময় ভালোবাসা।
দেশের প্রতি প্রেম আমাদের স্বার্থপর করে দিচ্ছে, আমার দেশের ভালোর জন্য আমি অন্য দেশের ভালোটা চাওয়া ভুলে গেছি। কিন্তু ঐ দেশে যে মানুষটা থাকে সেটাও তো আমার ভাই। তবে এই আদর্শ দেশ প্রেমিক প্রেমহীনের তুলনায় ভালো, কিংবা যারা স্বার্থবাদী দেশপ্রেমিক তাদের থেকে ভালো।
দেশে দেশে সৈনিকদের মাঝে দেশপ্রেম বাড়ানোর কৌশল হিসেবে তার দেশ কিভাবে অন্য দেশকে ধ্বংস করে যুদ্ধে জিতেছে তা দেখানো হয়। শেখানো হয় কিভবে নিজের দেশের জন্য অন্য দেশের সম্পদ লুট করতে হয়। স্বজাতিপ্রেমের ঊজ্জ্বল নিদর্শন আমরা দেখি সাম্প্রদায়িক বা গোষ্ঠীগত দাঙ্গার সময়!! ভৌগলিক ভালোবাসা ভূ-লোকের ও তার মানুষের ভাগ্যকে নানা বৈষম্যমূলক শ্রেণীতে ভাগ করে দিয়েছে। কোন কোন বিলাসী দেশে টন টন খাদ্যদ্রব্য সাগরে ফেলা হয়, অপরদিকে একই সময় দূরে কোথাও না খেয়ে মানুষ মারা যায়। তাতে কি? ওরা তো নিজের দেশের মানুষ না। আমি আর সইতে পরছি না। আমি চাই মানুষের ভালোবাসার এই নিয়ম বদলে যাক, তাতে স্বার্থপরতার-ও মৌলিক পরিবর্তন আসবে আশা করা যায়।
আমার এখন হতাশ হতেও বোরিং লাগে। অন্যায়ের কাছে সত্যের পরাজয় দেখতে দেখতে বেশ মানিয়ে নিয়েছি। আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপার আমার ইদানিং কষ্ট পেতেও অসহায় লাগে, অনেক বড় কারণ না হলে গায়েই লাগেনা।পত্রিকায় কত খবর শুনতে পাই, রাস্তায় যেতে পথে কত অন্যায় দেখি, কত সমস্যা, কত দুঃখ চারপাশে . . . এতসব নিয়ে ভেবে আমার কি লাভ? এটাও আজ প্রশ্ন হয়ে গেছে আমার কাছে!! এমনকি কারো নির্দয় বা অনাকাক্ষিত আচরণে অবাক হওয়ার গুণটাও আমার নষ্ট হয়ে গেছে। কোথাও সন্ত্রাসী ধ্বংসের নামে নিরীহ মানুষ মারলেও আমি আজ বিস্মিত হইনা, কষ্ট পাওয়া তো অনেক পরের ব্যাপার। কোন দেশের মানুষ অন্যায়ভাবে আক্রান্ত হলেও আমি গায়েই লাগাই না। কারণ, আমি তো ভালো আছি!! আমি জানি সবকিছুর পরিবর্তন আমি করতে পারব না, কারণ এগুলো পৃথিবীর হাজার বছর ধরে চলে আসা সমস্যা। তাই বলে সাধ্যমত চেষ্টা করার স্পৃহাও কি থাকবে না ??
সুতরাং আমার ভালোবাসার কারণে যেসব অনৈতিক আশা-আকাংক্ষা, ক্ষতিকর অভ্যাসগুলো বা নির্লজ্জ অনুভূতিগুলো আমার মাঝে বাসা বেধেঁছে তাদের বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন দরকার, আর নয়ত পরিবর্তন দরকার ভালোবাসার চরিত্রের। আমি বিশ্বাস করি খারাপ কিছু দেখার চেয়ে চোখ না থাকাটাই উচিত, যদি দৃষ্টিটাকে সংযত করতে না-ই পারি। কথা দিয়ে মানুষের ক্ষতি কারার চেয়ে আমার বোবা হওয়াই যুক্তিযুক্ত, যদি সত্যটাকে বলতে না-ই পারি। কিংবা হাত দিয়ে অন্যায় করার চেয়ে হাত না থাকাই ভালো, যদি তা থেকে বিরত হতে না-ই পারি। একইভাবে, ভালোবাসাটার পবিত্র ও সঠিক ব্যবহার-ই যদি করতে না পারি কি অধিকার এই অনুভূতিটা আমার মাঝে ধারণ করার ?!!
লেখা পড়ে আমি মুগ্ধ, অভিভূত!
এক কথায় অসাধারণ লেখনী!
তোর ঐ ছোট মাথায় এত্ত এত্ত ভালো চিন্তা লুকিয়ে থাকবে আমি কল্পনাই করি নি!
তুই এতটাই ভাবিস!
আমি সত্যিই বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছি চিন্তা করে!
তবে হ্যাঁ, তুই অসংখ্য বানান ভুল করেছিস, টাইপোও আছে বেশ কিছু!
সেগুলো ঝটপট ঠিক করে ফেল।
এই লেখাটা আমি আমার প্রিয় লিস্টে নিতে চাই।
এত কথার মাঝে দেখি ভুলেই গেছি বলতে!
:welcome:
অনেক খুশি হইছি শেষ পর্যন্ত তুই লেখা দিছিস বলে! :happy:
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপু 😀
কিন্তু যা বলতে চেয়েছিলাম তার কতটুকু বলতে বা বোঝাতে পেরেছি জানিনা…
বানান বিভ্রাটের জন্য দুঃখিত, লিখার পর আর না পরেই পোস্ট দিয়েছিলাম। যতটুকু পেরেছি এখন ঠিক করে দিলাম।
আর আমি যেমন এখনো হইনি তেমন প্রশংসা করে আমাকে অনুপ্রাণিত করার জন্য আমি সত্যি আনন্দিত আপু… :happy:
:welcome:
ভালো লেগেছে
আশা করি নিয়মিত লিখবেন 🙂
ধন্যবাদ 😀
আমিও আশা করি নিয়মিত লিখা চালিয়ে যাবো…
চিন্তাগুলি চমৎকার! খুব ভাল লেগেছে।
“আমি মা বাবাকে ভালোবাসতে গিয়ে দেখি সবাই একইভাবে ভলোবাসে, আমি আমার ভাই ও বোনকে ভালোবাসতে গিয়ে দেখি সবাই একইভাবে ভলোবাসে, আমি বন্ধুকে ভালোবাসতে গিয়ে দেখি সবাই একইভাবে ভলোবাসে। এমনকি আমি আমার প্রেমিকাকে ভালোবাসতে গিয়ে দেখি সবাই তার প্রেমিকাকেও একইভাবে ভলোবাসে।” – এই কথাগুলো আমি নিজেও ভাবি মাঝে মধ্যে!
:welcome:
ধন্যবাদ আপু।
কথাগুলো ভাবার মতোই, প্রকাশ করতে পেরে ভালো লাগছে 😀
চিন্তাগুলো দারুণ……আর প্রকাশটাও চমৎকার………
নিয়মিত সরব থাকুন………… 🙂
:welcome:
পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ. . . 😀
শুরুটা খুব ভাল লেগেছে…… 🙂
:welcome:
(আমি ও নতুন, তাই স্বাগতম বলতে হাসি পায় :P)
কয়েকবার পড়লাম, বোঝার জন্য- আমার বোঝাতে কি কোন ভুল হচ্ছে কিনা আর অনেকক্ষণ ভাবলাম মন্তব্য দিবো কিনা! কারন প্রথম লেখায় নেতিবাচক মন্তব্য দিতে চাই না। আবার না বলেও পারছি না।
“খারাপ কিছু দেখার চেয়ে চোখ না থাকাটাই উচিত, যদি দৃষ্টিটাকে সংযত করতে না-ই পারি।
হাত দিয়ে অন্যায় করার চেয়ে হাত না থাকাই ভালো, যদি তা থেকে বিরত হতে না-ই পারি।”
কিন্তু খারাপ কিছু যদি না দেখি তাহলে সে খারাপটা হওয়া বন্ধ করব কিভাবে?
হাত দিয়ে যে শুধু নিজে অন্যায় করি তাতো না, অন্য কেউ তো অন্যায় করা থেকে বিরত করতে পারি। নিজে যদি বিরত হতে না পারি তাহলে অপেক্ষা করি- কোন দিন, কেউ একজন এসে আমার হাতটা ধরে অন্যায় করা থামিয়ে দিবে, তারপর আমি আবার আরেকজনের হাত ধরে থামিয়ে দিবো……
প্রথমবার বলে ক্ষমা করা ঠিক না… :nono:
আপনার প্রশ্নটি অত্যন্ত যুক্তিসংগত। কিন্তু এখানে আমার বোঝানোর দুর্বলতা ছিল সম্ভবত, আমি বলতে চেয়েছি যা দেখা অনৈতিক তা দেখার বিষয়ে…।
আর অন্যায় থেকে বিরত হবার মানসিকতা যার আছে তার তো কারো জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন-ই পড়েনা, যাদের সেই মানসিক শক্তি নেই আমি তাদের হাত থাকার অপ্রয়োজনীয়তার কথা বলেছি।
অন্যায় রোধ করার উপায় দু’টি- আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ এবং সঠিক শিক্ষা। কিন্তু আমি এখানে আত্মসমালোচনা করেছি ও শুধু আমাদের নিজস্ব মানসিক দুর্বলতার জন্য অনুত্প্ত হয়ে ঐ কথাগুলো বলেছি।
ভালবাসার দোষগুণ নিয়ে ভাল একটা লেখা। একটা লেখাতে অনেকগুলো বিষয় নিয়ে এসেছেন আপনি। খুবই ভাল হয়েছে। 🙂
:welcome:
নবীন লেখক যেহেতু, এই সুন্দর লেখাটা একেবারে অসাধারণ দাবী করতে ইচ্ছে করে। কয়েকটা ছবি যোগ করে দিতেন। আর বিভিন্ন ঘটনা এসেছে ভেতরে, সেগুলোর নিউজ লিঙ্ক দেয়া থাকল লেখাটা আরো বেশী শেয়ার হবে। 🙂
এবার আসি বিষয়ে।:clappinghands:
ভালবাসায় অন্ধত্বকে দেখিয়েছেন। “ভালবাসি তাই তোমার কৃত সব কাজ ভাল” এই ধারনাই তো? কিন্তু, যে ভালবাসে, সে জানে, “ভালবাসা কারে কয়?”
এক একধরনের পিছুটান।
আহবানটা হবে, অন্ধত্ব নয়, ভালর প্রতি ভালবাসাই মুখ্য হোক।
অনেক ধন্যবাদ গঠনমূলক মন্তব্যের জন্য। 😀
[যে ভালবাসে, সে জানে, “ভালবাসা কারে কয়?”]
ঠিক বলেছেন। ভালবাসায় অন্ধত্ব থাকে- এটা অস্বাভবিক নয়, সেইজন্যই তো চেয়েছিলাম প্রচলিত ভালোবাসায় যদি কোন গুণগত পরিবর্তন আনা যেত তাহলে পৃথিবীটা আর একটু শান্তিময় হত…
অসাধারণ কথা–ভালর প্রতি ভালবাসাই মুখ্য হোক।