মার্স আন্ডারগ্রাউন্ড হিউম্যান সেটেলমেন্ট- সেক্টর ৭০৪:
সেক্টর ক্যাপিটাল সিচুয়েশন-রুমের মাঝখানে গোল টেবিলটা। তার চারপাশে সব মিলিয়ে দশ জন বসার মতো চেয়ার রয়েছে। এর বেশি আর তেমন কোনো আসবাব নেই ঘরে। তাতেই মনে হচ্ছে ঘরে দম ফেলার জায়গা ফুরিয়ে এসেছে।
মাটির তলায় বসবাস করতে থাকায় অতিরিক্ত জায়গা ব্যবহারের বিলাসিতা থেকে সরে এসেছে মঙ্গলের সমাজ। পুরো মঙ্গল গ্রহকে দুই হাজার সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে। এক একটা সেক্টর মাটির নীচে গড়ে ওঠা এক একটা মেগাসিটির মতো। ছয় বিলিয়ন মানুষ এই মেগাসিটিগুলোতে গড়ে তুলেছে বিজ্ঞানভিত্তিক অভূতপূর্ব এক আধুনিক সমাজ।
সেক্টর ৭০৪ মঙ্গলের সবথেকে এগিয়ে থাকা সেটেলমেন্ট। এর ক্যাপিটাল বিল্ডিঙে মঙ্গলের রাঘব বোয়ালদের যাওয়া-আসা। আর সেইসব রাঘব বোয়ালদের মধ্যে শুধু প্রথম সারির দশজনেরই ঢোকার অধিকার আছে সিচুয়েশন রুমে। যখন মঙ্গলের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পরে, তখনই কেবল সব সেক্টরের সিচুয়েশন রুমে বসে তাদের নিজ নিজ নিরাপত্তা সভা। সেক্টর ৭০৪ এর সিচুয়েশন এবার একটু বেশি উত্তপ্ত।

প্রেসিডেন্ট নোমান রডনির দিকে তাকালো জেনারেল কার্ল। তিনি অনুমতি না দিলে কথা বলা যাচ্ছে না। কিন্তু কার্লের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আর কিছুক্ষণ প্রেসিডেন্ট চুপ করে থাকলে সে আর অনুমতির তোয়াক্কা করবে না।
কার্লকে নিয়ম ভাংতে হলো না। প্রেসিডেন্ট রডনি পরিস্থিতির সাথে সম্পূর্ণ বেমানান ভঙ্গিতে জুটেক্সের জামার হাতা গোটাতে গোটাতে বললেন, ‘তোমরা কি ভেবে দেখেছো? মঙ্গলে কোনো মহাসাগর নেই।‘
কার্লের দিকে তাকিয়ে বাকি কথাটা শেষ করলেন তিনি, ‘আমাদের উচিত একটা মহাসাগর তৈরির প্রোজেক্ট নেয়া, কি বলো কার্ল?’
বিরক্তিটুকু কষ্ট করে গোপন করে জেনারেল কার্ল উত্তর করলো, ‘মি. প্রেসিডেন্ট, আমরা এখনই যদি কোনো পদক্ষেপ না নেই তাহলে সেটি পানির মহাসাগরে বদলে হবে মানুষের রক্তের মহাসাগর’।
নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে প্রেসিডেন্ট রডনি বললেন, ‘আচ্ছা, ঘটনা টেবিলে ছাড়ো কার্ল। আমি আগে সবার কথা শুনতে চাই’।
‘ঘটনা সহজ’, বলল কার্ল, ‘সেক্টরের কৃত্রিম খাদ্য তৈরির ফ্যাক্টরি উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করছিলো কয়েকজন পৃথিবীবাসী। আমাদের ইন্টেলিজেন্স স্কোয়াড তাদের ধরে ফেলে।’ সভার বাকি সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে কার্ল বলল, ‘আমি গত বছর এই সভাতেই বলেছিলাম বর্বর পৃথিবীবাসীদের মঙ্গলে ক্লিয়ারেন্স কমিয়ে আনা হোক’।
কার্লের শেষ শব্দটার আগেই শুরু করলেন কাউন্সেরল তানিয়া ভেলভেট, ‘সেই সিদ্ধান্ত তোমার নেবার কথা নয় কার্ল। কাকে ক্লিয়ারেন্স দেয়া হবে না হবে সেটা আমরা দেখবো’
কার্ল কিছু বলতে যাচ্ছিলো। তাকে থামিয়ে থমথমে গলায় সিনেটর কিশান লেন্সকি বলল, ‘কতোটুকু দেখেছেন তা তো দেখতেই পাচ্ছি আমরা। গত বছর আমাদের সার্ফেস-জুট-মিলে হামলা, আজ ফুড ফ্যাক্টরিতে হামলার পরিকল্পনা, কাল আমাদের এই ক্যাপিটাল মঙ্গলের সন্তানদের হাতে থাকবে বলে মনে হয় না’।
জাস্টিস জেফ হেরিস এতক্ষণ শুনছিলেন। এবার তার প্রৌঢ় চোখ তুলে বললেন, ‘পৃথিবীর ফোর্থ ওয়ার্ল্ড থেকে সস্তায় আমরা জুট নিয়ে আসি আমাদের কাপড়ের জন্য। কখনো ভেবে দেখেছেন ওদের অবস্থা? আর এই ‘মঙ্গলের সন্তান’ বিষয়টি আমাকে একটু খুলে বলুন তো!’
জাস্টিস হেরিস যথেষ্ট বয়স্ক মানুষ। তাই তার উত্তরে লেন্সকি বেশি উত্তাপ ছড়াতে সাহস করলো না, ‘আপনি যথেষ্ট সম্মানিত ব্যক্তি। কিন্তু মঙ্গলের লাল মাটির শপথ, আমরা মঙ্গলের সন্তান। আমি আমার জন্মভূমির প্রয়োজন সবার আগে বিবেচনা করি। এটা আমার অপরাধ? পৃথিবীর নেতারা দুর্নীতিগ্রস্থ আর ওদের চিন্তা প্রাচীনপন্থী। ওদের দুরাবস্থার জন্য আমাদের দায় দেয়াটা কি ঠিক?’।
উত্তর এলো কাউন্সেলর ভেলভেটের মুখ থেকে, ‘ মঙ্গলের লাল মাটির শপথ আমরাও নিয়েছি লেন্সকি। তাই আমরাও মঙ্গলকে বহুজাতিক করে গড়ে তুলতে চাই। কয়েকজন মানুষের আচরণ দিয়ে গোটা সমাজকে বিবেচনা করা যায় না’।
জেনারেল কার্ল সরব হলো এবার, ‘কাউন্সেলর ভেলভেট আশা করি এটুকু তথ্য রাখেন যে মঙ্গলে ঘটা ক্রাইমের অধিকাংশই ঘটে ক্লিয়ারেন্স পাওয়া পৃথিবীবাসীদের দিয়ে। মঙ্গলে বেঁচে থাকার জন্য বিজ্ঞানের বিকল্প নেই। তাই আমাদের আছে সবথেকে উন্নত বৈজ্ঞানিক জীবন ব্যবস্থা। ওরা আসে সেই উন্নত জীবনের জন্য। আর সাথে করে নিয়ে আসে ওদের আদিম প্রবৃত্তি’।
হাই-প্রফেসর আন্ড্রু মাতিন চুপ ছিলেন এতোক্ষণ। কার্লের কথায় যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছেন বোঝা গেলো। তিনি বললেন, ‘মঙ্গলের ইতিহাস জানেন আপনারা? আজ থেকে ছয়শ বছর আগে সেই পৃথিবী থেকেই কিছু দুঃসাহসী মানুষ এসে আমাদের গোড়া পত্তন করেছিলো এই সুন্দর লাল গ্রহটিতে। এর পর থেকে মঙ্গলের সমাজ বিকাশে মঙ্গলবাসী-পৃথিবীবাসী মিলে মিশে এক সাথে কাজ করেছে। যে কৃত্রিম খাবার আমরা খাচ্ছি তা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদেরই আবিস্কার। অথচ সেই ফর্মূলার উপরে কপরাইট বসিয়ে সেই জ্ঞান আমরা নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছি। মঙ্গলের সেটেলমেন্টে রেড-ব্লাড, গ্রিন-ব্লাড এই বিভেদ এর আগে কখনোই ছিলো না। হঠাত কি হলো আমাদের, কারো কাছে কি এর উত্তর আছে?’।
টেবিলের শেষ চেয়ারে নীরবে বসে ছিলেন এম-ভি-আর-নিউজের সম্পাদক কিহোতি উশিরো। হাই-প্রফেসরের কথা শেষে মুখ খুললেন তিনি, ‘আমার কাছে উত্তর আছে প্রফেসর। তবে এটা আসলে কাউকেই স্বস্তি দেবে না। গত নির্বাচনে ন্যাশনালিস্ট পার্টির শোচনীয় পরাজয়ের পর তাদের নেতারা একটা ভয়ংকর প্রোজেক্ট হাতে নেয়। মঙ্গলের বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজকে বিভক্ত করে একটি প্রতিপক্ষ দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। সেই প্রতিপক্ষকে সমাজের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখাতে তাদের বহু টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। সামনের নির্বাচনে এই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে প্রচারণা করে তারা ভোটের মাঠে আবার ফিরতে চায়। আমি জানি এই উত্তরে আপনারা কেউ খুশি নন। কিন্তু বাস্তবতা এমনই’।
উশিরোর কথা শেষ হতেই প্রায় খানিকটা হুংকার দিয়ে উঠলেন সিনেটর কিশান, ‘এসবের কোনো প্রমাণ নেই। সব মিথ্যে, বানোয়াট। প্রেসের কাজই এটা। তোমার এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হালে পানি পাবে না উশিরো’।
সন্দেহের চোখে কাউন্সেলর ভেলভেট বললেন, ‘আপনি এতো উত্তেজিত হচ্ছেন কেন সিনেটর? আর আপনি এতটা নিশ্চতই বা হচ্ছেন কি করে যে উশিরো মিথ্যে বলছে?’।
জাস্টিস জেফ হেরিস মৃদু হেসে বললেন, ‘আমার বৈচারিক চোখ বলছে আমরা মনে হয় আসল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি’।
—————————-
সেদিন মঙ্গলের আন্ডারগ্রাউন্ড সেটেলমেন্টের ছোটো ছোটো সেলগুলোতে রাতের খাবার খেয়ে যখন পরিবারগুলো দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘুমোতে যাবে ঠিক তখনই প্রেসিডেন্ট নোমান রডনিকে রিয়েল-ভিশনে দেখা গেলো। জুটেক্সের মোলায়েম জামার হাতা গোটাতে গোটাতে কথা বলছেন একজন তরুণ প্রেসিডেন্ট,
‘প্রিয় মঙ্গলবাসী, আমরা আমাদের এই লাল গ্রহটিকে অনেক ভালোবাসি। ভালোবাসি এর লাল আকাশ। আপনাদের মতো আমিও আমার শৈশবে অনেক সময় পার করেছি সার্ফেসের ধুলিঝড়ে গ্লাইডার উড়িয়ে। এই ধুলি-মাটি আমার অনেক প্রিয় আপনাদের মতোই। জানি, সময় বড্ডো বেসুরো। তারপরেও আমি আপনাদের একটা গল্প বলি। একবার কিরিটিনা গিরিখাদের মাঝে পথ ভুলে হারিয়ে গিয়েছিলাম আমি। দুই সপ্তাহ আমি একা একা ঘুরে বেরিয়েছি মঙ্গলের গভীরতম গিরিখাদে। খাবার বিহীন, অক্সিজেন প্রায় শেষ। যখন শরীরে আর একটুও শক্তি অবশিষ্ট ছিলো না, মৃত্যুর পর্দাকে প্রায় চোখের সামনে দেখছি ঠিক তখনই সেই পর্দা ছিঁড়ে এগিয়ে এসেছিলো একজন মানুষ। হ্যাঁ, মানুষ, কোনো ঈশ্বর নয়। তার নিজের রিজার্ভ অক্সিজেন ট্যাঙ্ক কখনো আমাকে দিয়ে কখনো নিজের পোশাকে লাগিয়ে তিনি আমাকে দীর্ঘ পথ বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। আমার হৃদয় ভেঙে গেছে যখন জেনেছি সেই মানুষটিকে শেষ বয়সে আমাদের হাসপাতালে সেবা দেয়া হয় নি কারণ সে ছিলো একজন পৃথিবীবাসী। সেদিন আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাবোই। আজ আমি আপনাদের প্রেসিডেন্ট। তাই আমি আপনাদের আস্বস্ত করতে চাই আমরা আসলে এক-অভিন্ন মানব সম্প্রদায়। পৃথিবী, মঙ্গল কিংবা প্রক্সিমা, বার্নার্ড- যেখানেই আমাদের জন্ম হোকনা কেন আমরা সবাই মানব সন্তান। একটি নদীর ধারা থেকে বেশি কিছু পাওয়া যায় না। অনেক নদীর ধারা মিলেই তৈরি করে মহাসাগর। এখন সময় মঙ্গলে একটি মহাসাগর তৈরির। সেই মহাসাগর তৈরির স্রোতে আপনাদের সবাইকে আমন্ত্রণ’।
-সোবহানী সৌরভ